হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনার পেটে গেছে জিডিপি (গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাকশন বা মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি। এক্ষেত্রে দুই অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে সরকারি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ কম অর্জন হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থাৎ ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ কম হয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাথমিক হিসাবে প্রবৃদ্ধির অর্জন ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কমেছে ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
তবে গত অর্থবছরের তুলনায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলারে, যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৪ ডলার (১ লাখ ৭১ হাজার ৬০৮ টাকা)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সারা বিশ্বের মতো কোভড-১৯ মহামারি আমাদের সব কিছুই তছনছ করে দিয়েছে। এই অবস্থা না থাকলে অবশ্যই আমরা ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতাম। তবে এটুকু বলতে পারি এত কিছুর পরও যা অর্জন হয়েছে সেটিও কম নয়। চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) করোনা অব্যাহত থাকলেও ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করছি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগের হিসাবটা ছিল অতিরঞ্জিত। অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে যে প্রাথমিক হিসাব দেওয়া হয়েছিল সেটি অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে মেলেনি। কিন্তু এখন চূড়ান্ত হিসাবে যে তথ্য এসেছে সেটি বাস্তবসম্মত বলা যায়। এছাড়া গত অর্থবছরের যে প্রাথমিক হিসাব দেওয়া হয়েছে সেটিও মানানসই। কেননা রপ্তানি ও ভোক্তা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই অর্থবছর তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি যে কিছুটা বাড়বে এটিই স্বাভাবিক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রবৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট সূচকগুলো কিছুটা দুর্বল ছিল। করোনার অতিমারির কারণে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হানে। সেটি দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জন কম হয়েছে।
বিবিএসের হিসাবে বলা হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা অঙ্কে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ১১ টাকার ৬ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ হিসাবে কম অর্জন হয়েছে ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তবে করোনা মহামারির কারণে পরবর্তীতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ সময় ধরা হয় ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এ হিসাবেও কম অর্জন হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ। এদিকে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা অঙ্কে হয়েছে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের সরকারের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে কম অর্জন হয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে সেটি পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। এটি অনুমোদন পেতে কিছুটা সময় লেগেছে। এজন্যই দেরি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণেই ওই অর্থবছর প্রবৃদ্ধি এত কম হয়েছে। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরেরও একই কারণেই প্রাথমিক হিসাবে কম প্রবৃদ্ধি পাওয়া গেছে। কেননা প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে দেশের মোট উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর। করোনা মহামারির কারণে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এটা সবারই জানা বিষয়। ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাথমিক হিসাবে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে হয়েছে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শিল্প খাতে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া সেবা খাতে গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে হয়েছিল ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত ৬ এপ্রিল প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২০-২১ অর্থবছর বাড়তে পারে। তবে সেটি হতে পারে ৫ শতাংশ। এর আগে গত বছরের অক্টোবরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল এই বছরে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। নতুন প্রতিবেদনে ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলা হয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে পারে ২ দশমিক ৬ শতাংশ হতে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে যেটি অর্জিত হবে সেটিকেও কম হিসাব দেখছে না বৈশ্বিক আর্থিক এ সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানি, শক্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং চলমান টিকাদান কর্মসূচির কারণে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ প্রদর্শন করছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রবৃদ্ধির গতি কমে গিয়েছিল।
যার ফলে দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দারিদ্র্য হ্রাসের প্রবণতাটি বিপরীত হয়ে যায়। তবে আশার কথা হলো অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে কারখানাগুলো পুনরায় খোলা হয়েছিল এবং রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়। তবে চলমান কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে অর্থনীতি উচ্চতর ঝুঁকির মুখোমুখি রয়েছে।