ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যে ক’টি উল্লেখ করার মতো ঐতিহাসিক দিন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু এদিন বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের নির্যাতনের চূড়ান্ত জবাব দেন। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণে পাকিস্তানিদের দ্বারা নিষ্পেষিত বাঙালিরা বুঝে নিয়েছিল তাদের করণীয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা তথা মুক্তির জন্য যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে পুরো জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে এক সুতোয় বাঁধা পড়ে।
মার্চের শুরু থেকে বিক্ষোভে মেতে ওঠা ক্ষুব্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের আজকের দিনটির অপেক্ষায় ছিল। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালি পেয়েছিল হাজার বছর ধরে চাওয়া স্বাধীনতার অদম্য আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের সবুজ সঙ্কেত। পরাধীনতার শৃঙ্খলাবদ্ধ বাঙালি জাতি তখন মুক্তির জন্য মুখিয়ে আছে। যে কোনো ধরনের লড়াই সংগ্রাম বা প্রাণের বিনিময়ে বাঙালিরা মাতৃভূমি রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সবাই টানটান উত্তেজনায় গভীর আগ্রহে অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন বাঙালি জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে কী দিকনির্দেশনা দেবেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের মনের ইচ্ছা, আগ্রহ আর আবেগ ধরতে পেরে অগ্নিঝরা একাত্তরের এইদিনে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সাত কোটি মানুষের মনের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন নিশঙ্কচিত্তে। মাত্র ১৯ মিনিটের কালজয়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন বাঙালি জাতির জন্য একটি অম্লান ইতিহাস।
‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’ এবং ‘এবারের সংগ্রম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণাটি বাঙালিদের মাঝে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল। মুক্তিকামী বাঙালির প্রাণস্পন্দন ও প্রত্যাশাকে হৃদয়ে ধারণ করা বঙ্গবন্ধুর দেয়া সে ভাষণ ৪৫ বছর ধরে একই আবেদন নিয়ে বাঙালিদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটানা কোনো ভাষণ এভাবে শোনার এবং অনুপ্রাণিত করার নজির নেই। ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
একাত্তরের এদিনে রেসকোর্স ময়দানে সারাদেশ থেকে ছুটে আসা স্বাধীনতা পিপাসু মানুষের ঢল নামে। মিছিল আর স্লোগানের উত্তাপ রেসকোর্সজুড়ে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, স্লোগান আর ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে ভাসছে পুরো রেসকোর্স। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে তখন ঘুরে ফিরছে এই স্লোগানগুলো। স্লোগানমুখর রেসকোর্সে জনসমুদ্রের মঞ্চে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…’ এমন নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকা বাঙালি কালবিলম্ব না করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়।
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পরে বাঙালি তাদের করণীয় বুঝে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু যেমন পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বর্ণনা দিয়েছেন তেমনি সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বাঙালিদের করণীয় বাতলে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের শুধরানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই আমলে নেয়নি শাসক পাকিস্তানি গোষ্ঠী। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে বাঙালীদের রাতের অন্ধকারে নির্বিচার হত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদাররা।
অবিস্মরণীয় এই দিনটিকে প্রতিবছর বাঙালি জাতি গভীর আবেগ, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কৃতজ্ঞ বাঙালি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সোমবার ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকালে ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জমায়েত ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকেলে আলোচনা সভা। পাশাপাশি সারাদেশে আওয়ামী লীগের শাখাসমূহ এবং সহযোগী ও সমমনা সংগঠনগুলো কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালন করবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর