হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঈদুল আজহা উপলক্ষে সর্বাত্মক লকডাউন শিথিল করেছে সরকার। এই সুযোগে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মাঝেও রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হচ্ছেন মানুষ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করো হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাস ও ট্রেন স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল এবং এসব যানবাহনের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনও বালাই নেই। এমনকি গণপরিবহনের বাইরেও অনেকে পশুবাহী পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে গ্রামে ছুটছেন। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে যানবাহনের ভিড় বেড়েছে।
একইসঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষের ভিড় বেড়েছে মাওয়া ও শিমুলিয়া ঘাটে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রীরা ঘাটে উপস্থিত হয়ে ফেরি ও লঞ্চে নদী পার হচ্ছেন। ফেরিঘাটে দেখা গেছে, যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। সদরঘাটে ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। ভোর থেকে মহাসড়কে যাত্রীবাহী পিকআপ ও মোটরসাইকেলের চলাচলও ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে ১৯ জুলাই ভোর থেকে অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতেরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেছেন, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ বিশেষ করে যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, অর্থাৎ যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে, পশুর হাটে যাওয়া থেকে তাদের নিরুৎসাহিত করতে চাই। একইসঙ্গে যারা টিকা গ্রহণ করেননি, তাদেরও নিরুৎসাহিত করতে চাই। অথচ পশুর হাটগুলোতে বাস্তব চিত্র এর একেবারেই উল্টো।
ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘কারও যদি করোনা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট লক্ষণ যেমন- সর্দি, কাশি, জ্বর অথবা শ্বাসকষ্ট থাকে, অথবা বাড়িতে যদি কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে বলবো— আপনারা পশুর হাটে যাবেন না।’ গত ১৭ জুলাই জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে জমে উঠেছে হবিগঞ্জের সর্ববৃহৎ পশুর হাট ‘জনতার বাজার’। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উভয় পাশে পশুর হাট বসায় সড়কে ছিল তীব্র যানজট। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাস্ক বিতরণ করা হলেও হাটে পুরোপুরিই উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কথা জানিয়েছেন প্রায় প্রতিটি জেলার প্রতিনিধিরাই।
তারা জানাচ্ছেন, সব পশুর হাটেই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। কেবলমাত্র মাইকিং করে দায় সারছেন কর্তৃপক্ষ। এদিকে, একদিনে ফের করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখলো বাংলাদেশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩১ জন, যা গত দেড় বছরের মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১১ জুলাই ২৩০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর, যা আজকের আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছিল। সরকারি হিসাবে দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮ হাজার ১২৫ জন। সোমবার মৃত্যুর এই নতুন রেকর্ডের দিনে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩২১ জন। এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে দেশে মোট শনাক্ত হয়েছেন ১১ লাখ ১৭ হাজার ৩১০ জন। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর পর চলতি বছরের জুলাই মাসে এর ভয়ংকর রূপ দেখা দেয়।
লকডাউন শিথিলের ঘোষণার আগেই স্বাস্থ্য অধিদফতর জুলাই মাসকে কঠিন বলে অ্যাখায়িত করেছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীন হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছে সরকারি এই সংস্থাটি।
গত ১৪ জুলাই অনলাইন বুলেটিনে জুলাই মাস অত্যন্ত কঠিন মন্তব্য করে অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছিলেন, ‘জুনে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল, আর জুলাইয়ের ১৪ দিনে আমরা এত রোগী পেয়ে গেছি।
এই মাসের আরও ১৬ দিন বাকি আছে। যেহেতু সংক্রমণের মাত্রা এখন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, দুই সপ্তাহ পর্যন্ত টানা এভাবে চলতে পারে। মৃত্যু তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এভাবে চলতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ১১ লাখ ছাড়িয়েছে মাত্র ৯ দিনে। গত ১৬ মাসে করোনা মহামারিকালে এক লাখ রোগী শনাক্ত এত দ্রুত সময়ে আর হয়নি। চলতি জুলাই মাসের হিসাবে দেখা যায়, জুলাই মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। মোট শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়ায় গত ৯ জুলাই। ৯ লাখ থেকে ১০ লাখ ছাড়াতে সময় লেগেছে ১০ দিন। আর ১০ লাখ থেকে ১১ লাখ ছাড়াতে সময় লাগলো ৯ দিন।
চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। শনাক্ত হয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। আর সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বগতিতে ধাবিত হচ্ছিল, তখন তা নিয়ন্ত্রণে আনতে ১ জুলাই থেকে দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ দেয় সরকার। কিন্তু তাতে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব ফেলেনি। বরং সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এখনও চলছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শিথিল লকডাউনের কারণে আমাদেরকে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। কারণ, ঈদের পরে চলতি ঊর্ধ্বগতির আরও অবনতি হবে, বাড়বে মৃত্যু। এবার আমরা সবাই সংক্রমিত হয়ে যাবো মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘শিথিল লকডাউনের জন্য আমাদেরকে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে।’
সংক্রমণের এই ধারাবাহিকতায় সরকার ঘোষিত ঈদের দুই দিন পরের লকডাউন ঈদের রাত থেকেই কার্যকর করা উচিদ বলে মনে করেন তিনি। আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমি সবিনয়ে নিবেদন করবো সরকারকে, লকডাউন ঈদের দিন রাত থেকে শুরু করতে। যাতে করে গ্রাম থেকে মানুষের ঢাকামুখী হওয়াটা কিছুটা হলেও বন্ধ হয়, সব যেন বন্ধ করে দেওয়া যায়।’ লকডাউন ঈদের দুই দিন পর থেকে শুরু করলে আবারও হুলস্থূল শুরু হয়ে যাবে, মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা কেন করতে দেবো।’
আরও বলেন, ‘ফরহাদ সাহেব (জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) যে বলছেন, কঠোর লকডাউন দেবেন, সেটা ঈদের দিন রাত থেকে দিক।’ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেনও ঈদের পর রোগী বাড়ার আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, ‘ঈদের এক সপ্তাহ পর সংক্রমণ বোঝা যাবে, আর মৃত্যুর সংখ্যা বোঝা যাবে দুই সপ্তাহ পর থেকে।’ ‘যেহেতু সংক্রমণ এখনও কমছে না, কমার লক্ষণও দেখছি না’ মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘রোগী বাড়তে থাকবে জ্যামিতিক হারে, অন্তত দেড় থেকে দুইগুণ। আর সেই সঙ্গে আনুপাতিকহারে বাড়বে মৃত্যু।’