ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে স্বামী আবুল প্রসঙ্গে নিজের অনুভূতির কথা এভাবেই প্রকাশ করেন স্ত্রী হালিমা খাতুন।
আর হাসপাতাল শয্যায় শুয়ে আবুলেরও সহজ সরল স্বীকারোক্তি- ‘আমি সুস্থ হলে ওর জন্যই হব।’
শুক্রবার সকাল ১১টা। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের অস্ত্রোপচার কক্ষে আবুলের ডান হাতে ড্রেসিং চলছে। বাইরে দাঁড়িয়ে স্ত্রী হালিমা খাতুন। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘ওর যখন ব্যথা হয় তখন কষ্টে রাগ দেখায়। ওর কষ্টে আমিও মনে খুব কষ্ট পাই। আমার বুকে ব্যথা করে। আল্লাহকে বলি, তুমি তাড়াতাড়ি ওর কষ্ট কমিয়ে দাও।’
হালিমার বাড়ি খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামে। ২০১১ সালে পরিবারের নিষেধ অমান্য করে মাধ্যমিক পাস করা হালিমা নিজের ইচ্ছায় ভালোবেসে বিয়ে করেন বিরল রোগে আক্রান্ত আবুল হোসেন বাজনদারকে।
ব্যক্তিগত জীবনে হালিমা বেশ ভালো ছাত্রী ছিলেন। গরীব ঘরে জন্মানোর পরও লেখাপড়ায় বেশ আগ্রহ ছিল হালিমার। তাই তো শিক্ষকদেরও নজরে আসেন তিনি। শিক্ষকরাও তার পড়ালেখার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করেন।
শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে ২০১০ সালে শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এ-মাইনাস পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন চালনা মহিলা কলেজে।
তারপর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও আর পড়াশুনা চালাতে পারেননি হালিমা। চলে আসেন আবুলের পরিবারে। শুরু হয় সংসার। ২০১৩ সালে তার কোল জুড়ে আসে একটি কন্যা শিশু।
আবুলের অভাবের সংসারে দীর্ঘ সময় কেমন কেটেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে হালিমা বলেন, ‘সব সময় অভাব থাকত। তবু কখনও কষ্ট হয়নি। মানুষের বাড়িতে কাজ করেছি। সংসারের যতটুকু পারছি দিতে চেষ্টা করছি। কখনও খেয়ে, কখনও না খেয়ে, আবার কখনও আধা পেট খাইয়াও কাটাইছি। তবু শান্তি পাইছি মনে মনে। কষ্ট হইলেও ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে থাকতে পেরেছি।’
প্রেমের বিয়ে আবুল ও হালিমার। আবুলের শরীরে তখনই বিরল এ রোগের দেখা মিলছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না মোটেই।
তারপরও কেন পরিবারের অমতে বিয়ে- এমন প্রশ্নের সাবলিল উত্তর হালিমার- ভালো বাসছি যখন তখন কি আর রোগ শোক মনে থাকে। ওরে ভালোবাসছি তো বাসছিই। রোগের কারণে কি আর ছাড়তে পারি?
আর আপনার প্রতি আবুলর ভালবাসা- এমন প্রশ্নেও বিব্রত নন হালিমা । বললেন, ‘ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু রোগ-শোকের কারণে সে ভালোবাসা দেখাতে পারে না। যখন ওর যন্ত্রনা হয় ও খুব কষ্ট পায়। তবুও রাগারাগি করে না।’
আবুল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন- এমন আশা নিয়ে প্রতিদিন কাটছে হালিমার। বললেন, ‘সেবা করে আর ডাক্তারদের সহায়তায় ও অবশ্যই সুস্থ হবে।’
‘ছবিতে (সিনেমায়) দেখছি, ‘ভালোবেসে বউ (স্ত্রী) চাইলে আর সেবা করলে স্বামী ফিরে আসেই’-বলেই লাজুক হাসেন হালিমা।
অন্যদিকে, স্ত্রী হালিমাকেও অসম্ভব ভালবাসেন আবুল। স্ত্রী প্রসঙ্গে আবুল বলেন, ‘ও দিনরাত আমার সেবা করে যাচ্ছে। আমি আর আমার মেয়ে ওর জন্যই বেঁচে আছি। ও খুব ভালো । আমার খুব খেয়াল রাখে। আমি রাগ দেখালেও কোনো সময় আমারে রাগ দেখায় না। আমি সুস্থ হলে ওর জন্যই হব।’
গত ৩০ জানুয়ারি ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন ট্রি-ম্যান খ্যাত আবুল হোসেন বাজনদার। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি তার ডান হাতে প্রথম অস্ত্রোপচার করা হয়। ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি তার ওই হাতের ড্রেসিং করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ১৮ ফ্রেব্রুয়ারি তার অস্ত্রোপচার করা হয়।
চিকিৎসকরা জানান, আবুলের হাতে আরও ১২ থেকে ১৫ টি অস্ত্রোপচার করতে হবে। আবুল সুস্থ হয়ে উঠবেন।