হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই দিনটি ছিল বৃহিস্পতিবার। এদিন কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিস ভবনে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডাররা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এই অনুষ্ঠানে সেক্টর কমান্ডাররা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, সামরিক বিজয়ই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় দেশকে শত্রুমুক্ত করা।
আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনী নৌ ও বিমান শাখা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে পরিষদের সদস্যরা বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করেন।
সিলেটের শাহবাজপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর এক গেরিলা অভিযান চালায়। এ অভিযানে পাকহানাদার বাহিনীর ১৩ জন সৈন্য নিহত হয়। বল্লার রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৬০ জন সৈন্যকে চারদিক থেকে ঘিরে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৫১ জন সৈন্য নিহত হয়।
দৈনিক যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন ও জিকরগাছা দখল করে নিয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে এসেছে। অবশ্য এ অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীকে পাকসেনারা আগেই হত্যা করেছে। পাকশি সেতুর অধিকার নিয়ে পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি গ্রাম মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। পাকশী সেতুর এক প্রান্তে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। মুক্তিফৌজের মতে এই অঞ্চলে অন্তত দু’শ’ কমান্ডো সক্রিয় রয়েছে।
দি স্টেটসম্যানের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণহত্যা প্রশ্নে আইরিশ এমপি স্যার এন্থনি এজমন্ড এবং উইলিয়াম লোগান বুধবার কলকাতায় এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভারতে অনুপ্রবেশ দেশটির অর্থনীতিতে একটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
জামায়াতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর মিয়া তোফায়েল কুষ্টিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চিরদিনের জন্য পাকিস্তানে বাঙালীদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ক্ষমতা দখল করে দাবি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বাঙালীদের এক চিরস্থায়ী দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
ইসলামাবাদে জনৈক সরকারি মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রশ্নটি বর্তমানে বিবেচনা করছেন। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের জনৈক মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি নয়া তালিকা পেশ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সাহায্য প্রেরণ অব্যাহত থাকবে।
মুখপাত্র আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। অবশ্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো ফর্মুলার প্রস্তাব দেয়নি।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধূরী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট পুর্নবিবেচনা করার আবেদন জানান। তারা জাতিসংঘ মহাসচিব উ’থান্টের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ডা. এ এম মালিককে তার বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি শামসুল হুদা ঢাকা সিটি কমিটি বাতিল করে এ এইচ মোহাম্মদ হোসেনকে প্রেসিডেন্ট ও নাসির উদ্দিনকে সেক্রেটারি করে নতুন কমিটি গঠন করেন।
কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাদ আহমদ রাজাকারদের দুস্কৃতকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজাকাররা দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) উৎখাত ও জনসাধারণের মধ্যে মনোবল সুদৃঢ় করার কাজ করে যাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক দেশপ্রেমিক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। রাজাকাররা ইতিমধ্যে বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে ও দুষ্কৃতকারী দমন করেছে।