হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ— এই তিন গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিলেট, যার উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’। এই প্লেটগুলো সক্রিয় থাকায় এবং পরস্পর পরস্পরের দিকে ধাবমান হওয়ায় এখানে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। আর জমে থাকা এসব শক্তি যে কোনো সময় ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে। ফলে অতিমাত্রায় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
গবেষকেরা বলছেন, সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, ঢাকা ও চট্টগ্রাম এই ছয় জেলা মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ। ‘ডাউকি ফল্ট’ ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত ৫০০ থেকে ১ হাজার বছরে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি না হওয়ায় সিলেটের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার যে মানচিত্র রয়েছে, তাতে সিলেট ও চট্টগ্রাম উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল। ‘ডাউকি ফল্ট’ লাইনে থাকা সিলেট অঞ্চলে এর আগে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওপরে থাকা সেই ভূমিকম্পে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
সর্বশেষ গত ৭ জুলাই সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হওয়া এই ভূমিকম্পে দুলেছে দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, শেরপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলা।
সম্প্রতি নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের গবেষকদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূ-গাঠনিক অবস্থানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ঐ গবেষণার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, এখনই বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে এমন কথা বলা না গেলেও দুটি গতিশীল ভূ-গাঠনিক প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে।
গবেষক দলের প্রধান নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার টমসন বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্প কবে ঘটতে পারে, সেই পূর্বাভাস আরো গবেষণা না করে দেওয়া সম্ভব নয়। ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটার মডেল তৈরির মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূ-গাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক প্লেটে চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ১৯ কিলোমিটার গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূখণ্ড তৈরি হয়েছে, তা সেই ভূমিকম্পের প্রভাবে জেলাটিনের মতো কেঁপে উঠতে পারে এবং কিছু কিছু জায়গায় তরলে পরিণত হয়ে গ্রাস করতে পারে ইমারত, রাস্তাঘাট আর মানুষের বসতি। তাদের এই গবেষণায় প্রায় ৬২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে এই ভূমিকম্পের ঝুঁকির আওতায় বলা হয়েছে।
সিলেটে দফায় দফায় ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠাকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আর এই মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে ১ থেকে ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি হবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ভূমিকম্পের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা মহড়া বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে বিপজ্জনক ভূকম্পনের প্রধান উত্স দুটি। এর একটি হলো ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফল্ট। অন্যটি টেকনাফ-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম জানান, বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন ছোট ছোট ভূকম্পন অনুভূত হয়। ফলে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন হিসেবে পরিচিত সিলেটে বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘মাঝারি ভূমিকম্পও আমাদের দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ আমাদের দেশের ভবনগুলো দুর্বল এবং ভূমিকম্প-সহনশীল নয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি যদি আমরা হ্রাস করতে চাই, প্রথম কাজ হবে ভূমিকম্পে ঝুঁকি কেন তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। বিশেষ করে শহর এলাকার কোন জায়গার মাটি দুর্বল, কোন জায়গার শক্তিশালী, তা বিবেচনায় নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হলো নগরবাসীকে সচেতন করা।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। তবে দুটি বিষয় আছে। একটি হলো বিফোর শক। মানে হলো ছোট ছোট ভূমিকম্প হবে, তারপর একদম মেইন শক (বড় ভূমিকম্প) হবে। দ্বিতীয়টি হলো মেইন শক (বড় ভূমিকম্প), তারপর আস্তে আস্তে আফটার শক হবে। অর্থাৎ মূল ভূমিকম্পের চেয়ে ছোট ছোট ভূমিকম্প হবে। সিলেটের ক্ষেত্রে ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমে শক্তি ছেড়ে দিচ্ছে, এমনও হতে পারে।