নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায় পাটি বুনে তিন শতাধিক পরিবার তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের কুমারপাড়া গ্রামের তিন শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার পাটি বুনে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এলাকায় হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি পরিবার স্বল্প পরিসরে মুর্তা দিয়ে পাটি বুননের কাজ করতেন। ঐতিহ্যবাহী এ পাটি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ওই গ্রামে অধিকাংশ পরিবার পাটি তৈরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। দিনভর পরিবারের নানা বয়সী সদস্যরা পাটি বুননের কাজ করে তাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছেন। একটা সময় ছিল এ গ্রামের পরিবারগুলো খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করত। অভাবের তাড়নায় গ্রামের পুরুষেরা বিভিন্ন মিল-কারখানায় শ্রমিকের কাজসহ অন্যের জমিতে দৈনিক মুজরীর ভিত্তিতে কাজ করতেন। গৃহস্থালীর কাজের বাইরে গৃহবধূদের কোনো কাজই ছিল না। নারীরা বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাতেন। এখন তারা দিনভর পাটি বুনার কাজে ব্যস্ত সময় কাটান। নারীরাও এখন ঘরে বসেই এই কাজ করে বাড়তি আয়ে করছেন। পাটি বুনে তারা আর্থিক সংকট দূর করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য তারা সঞ্চয়ও করছেন। অনেকে এ কাজ করে জমিও কেনেছেন। ওই গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীই লেখাপড়ার পাশাপাশি পাটি বুনার কাজ করে তাদের লেখাপড়া খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছেন।
কুমারপাড়া গ্রামের পাটি বুনন কারিগর হরিপদ জানান, নানা প্রতিকূল পরিবেশেও তারা তাদের পূর্ব পুরুষের এ পেশা ধরে রেখেছেন। তাদের তৈরী পাটি সৌখিন ক্রেতাদের ঘরে দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্য বর্ধন করছে। এই পাটি উপজেলাসহ এর আশপাশে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি ও গাঁয়ে হলুদের পাটি বুনে আসছেন। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে শিখা চন্দ্র দে ও স্ত্রী রেনু রানী দে দিনভর বাড়িতে বসে পাটি বুননের কাজ করে থাকেন। এরই মধ্যে বড় মেয়ে প্রতিভাকে বিয়ে দিয়েছেন। এলাকায় বেশ কয়েকজন নারী দৈনিক মজুরীতে তার বাড়িতে পাটি বুননের কাজ করছেন। তিনি জানান, একটি বড় আকারের পাটি তৈরি করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। পাটি বিক্রির আয় দিয়ে তিনি ৩৫ শতক জমি বন্ধক নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির চাষ করেছেন। সেখান থেকেও তার ভালো আয় হচ্ছে।
একই গ্রামের উর্ষা রানী জানান, ১০ বছর ধরে তিনি পাটি বুননের কাজ করছেন। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলেন তিনি। পরে পাশের বাড়ির হরিপদ চন্দ্র দে’র পরামর্শে তিনি পাটি তৈরির কাজ শিখেন। পরে স্থানীয় প্রশিকা নামের একটি এনজিও থেকে দশ হাজার ঋণ নিয়ে মুর্তা দিয়ে পাটি বুনন শুরু করেন। তিনি জানান, একটি শীতল পাটি বুনতে খরচ পড়ে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মতো। খরচ বাদে একটি পাটি বিক্রিতে লাভ হয় ১০০ টাকার মতো। একটি গায়ে হলুদের পাটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ২০০ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। তার বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে ২০টি পাটি তৈরি করা হচ্ছে। এ কাজ করে তিনি তার ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়াচ্ছেন। সংসারের যাবতীয় খরচ শেষে কিছু টাকা সঞ্জয় করছেন। তার বাড়িতে বাসরী রানী নামে এক নারী শ্রমিক পাটি বুনার কাজ করেন। তিনি জানান, স্বামীর একার আয়-রোজগারে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো তার। প্রতি সপ্তাহে তিনি ছোট অথবা বড় সাইজের দু’টি পাটি বুনতে পারেন। এতে সপ্তাহ শেষে তিনি যে টাকা মজুরী পান তাতে তিনি সংসারের খরচ মিটাতে পারছেন। পাটি তৈরির কাজ করার পর থেকে তার সংসারে বাড়তি খরচের এখন আর কোনো চাপ নেই বলে জানান তিনি। সংসারের যাবতীয় খরচ শেষে তিনি কিছু টাকা সঞ্চয় করছেন। ওই গ্রামের চিনি লাল চন্দ্র দে জানান, তিন মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তার। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি মুর্তার পাটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রি করছেন। শীতল পাটি ও গাঁয়ে হলুদের পাটি মিলে তার বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে ৩০টি পাটি বুনতে পারেন। পাটিগুলো উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি এলাকায় ৬০ শতাংশের একটি জমি কেনেছেন। সেখানে মুর্তার চাষ করেছেন। পাটি তৈরির কাঁচা মাল তিনি তার জমিতে উৎপাদিত মুর্তা থেকে সংগ্রহ করেন। পাটি বিক্রি করে প্রতি মাসে তিনি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো আয় করছেন।
পাটি তৈরীর কারিগর পরিমল চন্দ্র দে জানান, পোলামাইয়ারে স্কুলে পড়াইতাছি, বাড়িতে ছিল ছনের ঘর, টাকা জমিয়ে পাকা ঘর দিয়েছি। সংসারে এখোন কোনো অভাব নেই। একই গ্রামের মনতা নারী দে জানান, তার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ্য হয়ে বিছানাই পড়ে আছেন। ছেলে মেয়ে নিয়ে সাত সদস্যের পরিবার তাদের। সংসারে টানাটানি গেলেই থাকতো। ১৯৯০ সালে স্থানীয় একটি সমবায় সমিতি থেকে নয় হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মুর্তা দিয়ে পাটি বুননের কাজ শুরু করেন। বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয়না, পাইকাররা বাড়ি থেকে পাটি নিয়ে যাচ্ছেন। ঘরে বসেই আয় করা যাচ্ছে। মনতা জানান, এতে আমাদের সংসার আগের তুলনায় ভালো চলছে। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া খরচ দিতে পারছি। তাদের ভালো খেতে দিতে পারছি। খরচ বাদে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করছি। তিনি নিজে পাটি বুনন করেন, এবং তাদের বাড়িতে ওই এলাকার পাঁচ জন নারী শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ইতি মধ্যে তিনি সমিতির ঋণ পরিশোধ করে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে ৯০ শতাংশের দু’টি জমি কেনেছেন। ওই এলাকার পাইকারী পাটি বিক্রেতা শুনীল চন্দ্র দে জানান, তাদের গাঁয়ে তৈরীকৃত পাটি তিনি পাইকারী কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। তিনি আরও জানান, অনেক বড় বড় মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পাটির অর্ডার দিয়ে যায়। মান ও প্রকার ভেদে একটি পাটির মূল্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হয়ে থাকে।
দুপ্তারা ইউপি চেয়ারম্যান শাহীদ মোশারফ জানান, দুপ্তারা ইউনিয়নের কুমারপাড়া এলাকায় স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকে মুর্তার দিয়ে পাটি তৈরি করা হচ্ছে। তারা তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। এতে ওই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবারের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দারা খেয়ে পড়ে অনেক ভালো আছেন। তিনি জানান, স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদা পুরণে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ওই এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার।
সংবাদ শিরোনাম
পাটি বুনে সচ্ছলতা এসেছে তিন শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবারে
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১১:৩৮:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ মার্চ ২০১৬
- ৪৭১ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ