হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্তমান সময়ে বিশ্বের সেরা ফি-কিক এক্সপার্ট কে? চোখ বুজেই ফুটবলের আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসির নাম মুখে আনবেন। পরিসংখ্যানই মুখে মেসি নাম এনে দেবে। বর্তমানে জাতীয় দল ও ক্লাব মিলিয়ে ফ্রি-কিক থেকে করা মেসির গোলসংখ্যা ৫৮। তার নিকটতম প্রতিন্দ্বন্দ্বী পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ৫৭।
মাত্র এক গোল বেশি হলেও ফ্রি-কিকে অবিসংবাদিত সেরা মেসি, এটা নেইমারভক্তরাও স্বীকার করবেন।
তবে ফুটবলের ‘দ্য বুলেট ম্যান’ খ্যাত ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী তারকা রবের্তো কার্লোস এমন একটি ফি-কিকে গোল করেছেন, যা মেসিরও কাছেও অসাধ্য।
নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে কার্লোসের ওই ফ্রি-কিকটি কখনও নিতে পারেননি মেসি। মেসি তা নিজেই জানিয়েছেন। এমন ফ্রি-কিক নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হয়।
অবিস্মরণীয় সেই ফ্রি-কিককে ফুটবলের ভাষায় ‘বানানা কিক’বলা হয়। মানে কলার আকারের সঙ্গে তুলনা করা হয় একে।
অবিশ্বাস্য সেই ফ্রি-কিকটি কালোর্স করেছিলেন ১৯৯৭ সালে ৩ জুন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। কিকে স্পট ছিল গোলপোস্ট থেকে ৩৫ মিটার দূরে। সাদাচোখে গুরুত্বহীন ফ্রি-কিক। কারণ ফ্রি-কিকের স্থান থেকে কোনো সরলরেখা বরাবরই গোলপোস্ট দেখা যাচ্ছিল না। তার ওপর প্রতিপক্ষের মানবপ্রাচীর।
এমন পরিস্থিতিতে কালোর্স সিদ্ধান্ত নিলেন বহুদিন ধরে করা প্রশিক্ষণটা বাস্তবায়নে। দেখা যাক না কি হয়। এমনিতেই এতোদূর থেকে গোল হওয়ার নয়। আর ম্যাচটিও ছিল প্রীতি ম্যাচ, অতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
দূর থেকে দৌড়ে এসে শট নিলেন। বলটি ঘূর্ণিপাক খেতে খেতে সামনে ‘দেয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের থেকে দূরে উড়ে গেল। চোখ বুজেই সবাই ধরে নিলেন, বল গোলপোস্ট থেকে অনেক দূরে চলে যাবে কর্ণার ফ্ল্যাগের দিকে। গোলরক্ষকেরও দরকার পড়বে না এ নিয়ে কিছু ভাবার।
কিন্তু সবাই যখন ধরেই নিয়েছেন লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে চলেছে শটটি, তখনই সেই বল বাঁক নেওয়া শুরু করল বামদিকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে গেল জালে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না ফ্রান্সের গোলরক্ষক ফাবিয়ান বার্থেজের
কি কেরামতি লুকিয়েছিল কার্লোসের সেই শটে যে, বল বুমেরাংয়ের চরিত্রে রূপ নিল। বলের পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তি কাজ করেছিল?
সেই ফ্রি-কিক নিয়ে এখনও এই প্রশ্ন চলছেই।
ফ্রি-কিকটি নিয়ে গবেষণার পর বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে সব কারিশমা কার্লোসের বুটের লাথিতে। তিনি এমনভাবে আর এমন শক্তিতে বলে লাথি মেরেছিলেন যা বলে অন্যরকম এক ঘূর্ণন গতি এনে দেয়।
কার্লোস লাথিটা মেরেছিলেন বলের ডানদিকে নিচের কোণে যাতে বলটি ফ্রি-কিকের স্থান থেকে ডানদিকে কোণাকুণি উঁচুতে উঠে যায় এবং একইসঙ্গে নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরতেও থাকে।
বলটি তার গতিপথের শুরুতে একটি আপাত সরলরেখা বরাবর-ই হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল। এ সময় ডানদিকের বায়ুপ্রবাহ বলের ঘূর্ণনের বিপরীত অভিমুখে চলে উচ্চচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে এবং বামদিকের বায়ুপ্রবাহ বলের ঘূর্ণনের সম-অভিমুখে চলে নিম্নচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে।
এই দুই অঞ্চলের বায়ুচাপের পার্থক্যের কারণে বলটি উচ্চবায়ুচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নবায়ুচাপ অঞ্চলের দিকে বাঁক নেয়। এভাবেই অবিশ্বাস্যভাবে বাঁক নিয়ে প্রবেশ করে জালে। পদার্থ বিদ্যার গতি অধ্যায়ের ভাষায় এই ঘটনাটি ‘ম্যাগনাস এফেক্ট’ বলে।
১৬৭০ সালে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন টেনিস খেলতে গিয়ে সর্বপ্রথম ‘ম্যাগনাস এফেক্ট’-এর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন ও নথিবদ্ধ করেন।
তবে ফুটবলপ্রেমীরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র নন তারা সহজ ভাষায় একে ‘বানানা কিক’ বলেন।
ক্যারিয়ারের বাকিটা সময় কার্লোসকে ওই ফ্রি-কিকের রহস্যের কথা জিজ্ঞেস করা হতো।
তিনি বলতেন, ‘সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না কী করে ওটা করলাম। কঠিন পরিশ্রমের ফল পেয়েছিলাম। গোলটা হওয়ার পর অসম্ভব ভালো লেগেছিল। সুন্দর গোল ওটা। যেটা আমার কাছে খুব স্পেশাল।’
ভক্তদের এখন চাওয়া একটাই- কার্লোসের মতো অমন একটি ফ্রি-কিকের পালক যুক্ত হোক মেসি খাতায়। মেসি কি পারবেন অমন ‘বানানা কিক’নিতে?
প্রসঙ্গত, ইতালির কিংবদন্তি পাওলো মালদিনির সঙ্গে রবের্তো কালোর্সকেও ইতিহাসের সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে ধরা হয়। ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আক্রমন্মুখো ডিফেন্ডার তিনি। একজন ডিফেন্ডার হয়েও তার গোল সংখ্যা ১১৭। তার কিকে গতি ছিল অবিশ্বাস্য, ঘন্টায় ১৬৯ কিলেমিটার বেগে ছুটত বল!