হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোভিড-১৯ চিকিৎসক দল। করোনা রোগীর বাসা থেকে ফোন করলেই হাসপাতাল সুবিধা সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সসহ সেখানে চলে যাবেন গণস্বাস্থ্যের চিকিৎসক দল।
এ বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে শুরুতেই যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি। প্রথম থেকেই বলে এসেছি যে, করোনা রোগীদের জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অক্সিজেন। সেই অক্সিজেন আমরা নিজেরাই খুব সহজে উৎপাদন করতে পারি। একটা ছোট আকারের অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করতে ৩০ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে এই অর্থ খরচ করা কোনো বিষয় না। হাসপাতালগুলোকে এই অর্থ অনুদান হিসেবে দিলে তারা নিজেরাই প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন উৎপাদন করে নিতে পারে। এক বছর ধরে এই কথাগুলো সরকারকে বলেও কিছু হলো না। এখন করোনা আবার ভয়াবহ আকার ধারণ করল। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই। এখন পর্যন্ত অক্সিজেনের তেমন বড় সংকট হয়তো দৃশ্যমান হয়নি। তবুও, অক্সিজেনের অভাবেও মানুষ মারা যাচ্ছে।’
‘শিল্প-কারখানার অক্সিজেন চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, তাতেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। তারা অনেক বড় বড় সিলিন্ডার ব্যবহার করে। কিন্তু, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ছোট সিলিন্ডার প্রয়োজন। সেটার ব্যবস্থা বাংলাদেশ সেভাবে নেই। সামনে হাসপাতালে মানুষের ভিড় আরও বাড়তে পারে। চিকিৎসক হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, সব মানুষের হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। এখন আমাদের সেবা দেওয়ার এখানে দুটো বিষয়। প্রথমত, অধিক সংখ্যক পরীক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষায় শনাক্ত হয়ে কেউ যদি আমাদেরকে ফোন করে, তাহলে আমাদের চিকিৎসক দল সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবে। একইসঙ্গে বাড়ির লোকজনকে তাপমাত্রা, ব্লাড প্রেসার ও অক্সিজেন লেভেল মাপা শিখিয়ে দেবে। আমরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এই সেবাটা দেবো। যাতে হাসপাতালে ভিড় কমে এবং মানুষের মাঝে আতঙ্কও কমে। ফলে করোনা নিয়ে মানুষের মাঝে অহেতুক আতঙ্ক ছড়াবে না’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার এখন যেই অবস্থা চলছে, এই সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কাজ শুরু করলে ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে এর ইতিবাচক ফল দৃশ্যমান হবে। সরকারের কাছে কোনো ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেয়েও বড় প্রত্যাশা হলো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা যাতে তৈরি করা না হয়। আমরা সবার আগে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট তৈরি করেও অনুমোদন পাইনি। স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে চেয়েছি, সেখানেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করছি, সেখানে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। প্লাজমা সেন্টার করেছি, সেখানে কোনো সহযোগিতা পাইনি। কাজেই মহামারিকালে সরকারের কাছে সহযোগিতার চেয়েও কোনো ধরনের অসহযোগিতা না করার প্রত্যাশা থাকবে। আমাদেরকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেওয়া হোক। আমরা দেশের জনমানুষের জন্যে কাজ করছি। আমাদের কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। আমাদের উদ্দেশ্য বৈষম্য দূর করে চিকিৎসা সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সবাইকে সেবা দিতেই আমাদের এই উদ্যোগ।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত রোগীর বাসা থেকে ফোন করলেই সেখানে চলে যাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোভিড-১৯ চিকিৎসক দল। আজ থেকেই ঢাকার ভেতরে এই সেবা দেওয়া হবে। যেমন: কেউ একজন রাজধানীর কলাবাগান থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফোন করল কিংবা অ্যাপসের মাধ্যমে জানাল, তার বাড়িতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গাড়ি যাবে। সেই গাড়িতে এক্সরে ও ইসিজি মেশিন, ভ্যান্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় সব থাকবে। চিকিৎসক দল প্রথমে পরীক্ষার জন্য রোগীর রক্তসহ প্রয়োজনীয় নমুনা নিয়ে চলে আসবে। আগে যদি পরীক্ষায় রোগীর করোনা পজিটিভ থাকে, তাহলে তার বাড়ি গিয়ে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে আসা হবে। এ ছাড়া, বুকের এক্স-রে, ইসিজিসহ যেসব টেস্ট করানো প্রয়োজন, সবই করা হবে। মোট কথা একজন করোনা রোগীর বাড়িতে একটা হাসপাতাল চলে যাবে।’
‘গণস্বাস্থ্যের ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম যে ওষুধ দেবে, তার জন্যে কোনো টাকা নেবে না। এ ছাড়া, করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য যেসব পরীক্ষা করা হবে, সেগুলোর প্রায় অর্ধেক মূল্য নেবে তারা। যেমন: বিভিন্ন পরীক্ষায় খরচ হলো ১০ হাজার টাকা, রোগীর পরিশোধ করতে হবে ছয় হাজার টাকা। একইসঙ্গে করোনায় আক্রান্ত রোগীর বাড়ির একজন লোককে গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যাতে তিনি করোনা রোগীর দেখাশোনা করতে পারে। গত ২৩ এপ্রিল থেকেই এই কার্যক্রম শুরু করেছি আমরা। এই প্রশিক্ষণ নিতে কোনো খরচ নেই। এর জন্যে বাড়িতে থার্মোমিটার, পালস অক্সিমিটার ও ব্লাড প্রেসার মেশিন থাকতে হবে’, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া, এখন যে কেউই গণস্বাস্থ্যের হাসপাতালে এসে করোনার চিকিৎসা নিতে পারবেন। ৪০ শয্যার একটা ইউনিট করেছি আমরা। পাঁচটি করোনা আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, ভ্যান্টিলেটর, ইসিজিসহ সব সুবিধা নিয়ে করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এগুলো করা হয়েছে। তারপর করোনা আইসোলেশন সেন্টারও করা হয়েছে। এখানে এখনই যেকোনো লোক এসে ভর্তি হতে পারবে।’
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের বীর উত্তম মেজর হায়দার মিলনায়তনে ‘গণস্বাস্থ্য ভ্রাম্যমাণ করোনা চিকিৎসাসেবা’র উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। উদ্বোধনকালে নতুন এই উদ্যোগ বিষয়ে ব্রিফ করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটা যদি আমরা ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারি, তাহলে যারা করোনায় আক্রান্ত তাদের জন্যে কী ধরনের সুবিধা হবে, তা আপনারা বুঝতে পারছেন। এই ধরনের সুবিধা মানুষের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, কিন্তু, চিকিৎসা পাচ্ছে না কিংবা পেলেও যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি সুশিক্ষিত একটি দল নিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে সেবাটা দিতে পারি, তাহলে এটা যে জনসাধারণের জন্যে কত বড় উপকারে আসবে, তা বোঝা যাচ্ছে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জানিয়েছে, প্রথমে এই সেবা দেওয়ার জন্যে ঢাকার ধানমন্ডি, কলাবাগান, পুরান ঢাকা ও মিরপুর এলাকাকে নির্বাচন করা হয়েছে। আপাতত সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই সেবা দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে তিনটি দল এই সেবা প্রদান করবে। আইসিইউ সুবিধাযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রতিটি দলে থাকবে সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসক, নার্স, প্যাথলজি টেকনোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবক। দলটির সঙ্গে যাবে একটি মোটরসাইকেল এবং পোর্টেবল এক্সরে মেশিন। সরাসরি রোগী বা তার পরিবার কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে থেকে ফোন পেলে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দলটি উপস্থিত হবে নির্দিষ্ট বাসায়। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও এক্সরে করে ক্যাসেট নিয়ে মোটরসাইকেল বাহক ফিরে যাবেন হাসপাতালে। চিকিৎসক রোগের উপসর্গ বিবেচনা করে রোগীদেরকে চারটি ভাগে ভাগ করবেন। মৃদু, সহনীয়, সহনীয় উপসর্গের সঙ্গে সহরোগ যেমন: ডায়াবেটিস, হার্ট বা কিডনি ডিজিজ, স্ট্রোক, হাঁপানি ইত্যাদি ও তীব্র করোনা রোগী।
চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে জানানো হয়েছে, প্রথম তিন ধরনের রোগীকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। মোবাইলে পাওয়া এক্সরের ছবি দেখে চিকিৎসক তাদের জন্যে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দিবেন। টেকনিশিয়ান প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করবে। করা হবে ইসিজিও। নার্স রোগী ও রোগীর লোকজনকে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও পালস অক্সিমিটারের ব্যবহার শিখিয়ে দিবেন। প্রয়োজন হলে প্লাজমারও ব্যবস্থা করবেন এবং তা বাসাতেই দেওয়া হবে। তীব্র করোনা রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে। সরবরাহ করা ওষুধ ও পরামর্শের জন্যে কোনো অর্থ দিতে হবে না। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ বিল করা হবে। তবে, সেটিও প্রায় অর্ধেক।
গণস্বাস্থ্যের ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের চিকিৎসাসেবা পেতে ০১৭০৯-৬৬৩৯৯৪ ও ০৯৬০২১১১৯৪০— এই দুটি নম্বরে ফোন করতে হবে। এ ছাড়াও, ‘সিওডিসিরেড এসওএস’ (CodcRed SOS) অ্যাপসের মাধ্যমেও এই সুবিধা পাওয়া যাবে।