ঢাকা ০১:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক কলস পানির জন্য হাঁটতে হয় তিন থেকে চার কিলোমিটার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২০:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪
  • ৩ বার

পয়তাল্লিশ বছর বয়সী রহিম মিয়া পেশায় একজন দিনমজুর। তার ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন ২০-২৫ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী পুকুরের পানি শোধন করে লিটার প্রতি ১ টাকা দরে বিক্রি করেন। সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ২ টাকা প্রতি লিটারও কিনতে হয়। দিনমজুরির আয়ে যেখানে সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম অবস্থা, সেখানে সুপেয় পানি কেনা তার জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

তবে শুধু রহিম মিয়া নন উপকূলের প্রায় প্রতিটি ঘরের চিত্র অনেকটা একই। সুপেয় পানির দীর্ঘদিনের সংকট এখন চরমে পৌঁছেছে। লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে রামপালসহ পুরো বাগেরহাট জেলার বাসিন্দারা সুপেয় পানির অভাবে দিন পার করছেন।

পানি আনতে হাঁটতে হয় তিন থেকে চার কিলোমিটার 

রামপাল উপজেলার পেড়িখালি ইউনিয়নে ফুল পুকুর নামে একটি সরকারি পুকুর রয়েছে। এই পুকুরে পানি বিশুদ্ধ করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) বসানো হয়েছে। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে পিএসএফ এখনো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

ফুল পুকুরের পিএসএফ থেকে পানি নিতে আসা ইশীতা পাল বলেন, তিন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে সরকারি পুকুরের পিএসএফ থেকে পানি নিতে হয়। এই পানি কতটা নিরাপদ তা জানি না, বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছি।

স্থানীয়রা বলছেন, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা পানি কিনে ব্যবহার করেন বা দূরবর্তী স্থান থেকে সংগ্রহ করেন। আর যাদের তেমন সুযোগ নেই তারা পুকুর বা অন্য অস্বাস্থ্যকর উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করেন।

জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রকোপ

রামপাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলার ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার যোগ্য নয়। উপজেলায় ২ হাজার ২২০টি নলকূপের মধ্যে ৫০০টি অকেজো। গ্রীষ্মকালে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে ভোগেন।

রামপাল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হুরায়রা খানম বলেন, বর্ষায় ঘোষিয়া খালি চ্যানেলের লবণ পানি পুকুরগুলোতে ঢুকে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। এই লবণ পানি শুধু পানির সংকটের সঙ্গে ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের কষ্টে জর্জরিত জনজীবন

বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য উপকূলবাসীর এই হাহাকার নতুন কিছু নয়। যুগের পর যুগ অতিবাহিত হলেও পানি সমস্যার সমাধান হয়নি এ অঞ্চলে।
৮৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে পানির কষ্ট দেখে আসছি। পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কত সরকার এলো-গেল, কিন্তু আমাদের পানির কষ্ট দূর হলো না।

স্থানীয় অপর এক বাসিন্দা হালিমা বেগম বলেন, পানি সংগ্রহ করতে দিনে এক ঘণ্টা করে হাঁটতে হয়। প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে পানি আনি। চোখ থেকে লবণ পানি ঝরলেও কখনো মিষ্টি পানি পাইনি। লবণাক্ততার কারণে তার বাড়ির ইট-বালু দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। ইটের যদি এমন অবস্থা হয়, তবে আমাদের শরীরের কী হচ্ছে আল্লাহ জানেন।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রভাব

পল্লী চিকিৎসক ইমরান হোসেন বলেন, লবণাক্ততার কারণে এলাকায় চর্মরোগ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এখানকার নারীরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোজাফফর হোসেন বলেন, সংকট এবং অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, ফ্লুরোসিস, চর্মরোগ ও আর্সেনিকোসিস রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তিনি নিরাপদ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ বলেন, উপকূলীয় ৭৩ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। লবণাক্ততা শুধু মানুষের জীবন নয়, কৃষি, পশুপালন এবং পরিবেশের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

সংকট নিরসনে পরিকল্পনা

রামপাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরান হোসেন বলেন, বাজেট অনুযায়ী কিছু পরিবারে পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংকি দেওয়া হচ্ছে। সামনে নতুন প্রকল্প আসলে পুকুর সংস্কারসহ টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিশ্রুতি নয়, দরকার কার্যকরী পদক্ষেপ

চাকশ্রী এ বি সি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিম ফকির বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বা বৈশ্বিক লক্ষ্য মাত্রায় ৬ নম্বর গোলে নিরাপদ পানির কথা বলা হয়েছে। দেশ এসডিজি গোল লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের পানির সংকট আরও বেড়ে যাচ্ছে। এখন যদি সরকার নিরাপদ পানির দিকে নজর না দেয়, তাহলে এই উপকূলের মানুষের কষ্টের শেষ হবে না।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফাইট ফর কোস্টাল রাইটস অ্যান্ড জাস্টিস (এফএফসিআরজে)-এর সদস্য নাইমা আফরিন বলেন, পানির অপর নাম যদি জীবন হয়, তাহলে উপকূলের মানুষগুলো মৃত মানুষের জীবনযাপন করছে। সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর করেছি, কিন্তু বাস্তবায়ন দেখিনি। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানি এখন সোনার হরিণ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারের উদ্যোগ জরুরি। না হলে, এই জনপদে জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

এক কলস পানির জন্য হাঁটতে হয় তিন থেকে চার কিলোমিটার

আপডেট টাইম : ১১:২০:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

পয়তাল্লিশ বছর বয়সী রহিম মিয়া পেশায় একজন দিনমজুর। তার ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন ২০-২৫ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী পুকুরের পানি শোধন করে লিটার প্রতি ১ টাকা দরে বিক্রি করেন। সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ২ টাকা প্রতি লিটারও কিনতে হয়। দিনমজুরির আয়ে যেখানে সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম অবস্থা, সেখানে সুপেয় পানি কেনা তার জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

তবে শুধু রহিম মিয়া নন উপকূলের প্রায় প্রতিটি ঘরের চিত্র অনেকটা একই। সুপেয় পানির দীর্ঘদিনের সংকট এখন চরমে পৌঁছেছে। লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে রামপালসহ পুরো বাগেরহাট জেলার বাসিন্দারা সুপেয় পানির অভাবে দিন পার করছেন।

পানি আনতে হাঁটতে হয় তিন থেকে চার কিলোমিটার 

রামপাল উপজেলার পেড়িখালি ইউনিয়নে ফুল পুকুর নামে একটি সরকারি পুকুর রয়েছে। এই পুকুরে পানি বিশুদ্ধ করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) বসানো হয়েছে। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে পিএসএফ এখনো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

ফুল পুকুরের পিএসএফ থেকে পানি নিতে আসা ইশীতা পাল বলেন, তিন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে সরকারি পুকুরের পিএসএফ থেকে পানি নিতে হয়। এই পানি কতটা নিরাপদ তা জানি না, বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছি।

স্থানীয়রা বলছেন, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা পানি কিনে ব্যবহার করেন বা দূরবর্তী স্থান থেকে সংগ্রহ করেন। আর যাদের তেমন সুযোগ নেই তারা পুকুর বা অন্য অস্বাস্থ্যকর উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করেন।

জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রকোপ

রামপাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলার ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার যোগ্য নয়। উপজেলায় ২ হাজার ২২০টি নলকূপের মধ্যে ৫০০টি অকেজো। গ্রীষ্মকালে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে ভোগেন।

রামপাল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হুরায়রা খানম বলেন, বর্ষায় ঘোষিয়া খালি চ্যানেলের লবণ পানি পুকুরগুলোতে ঢুকে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। এই লবণ পানি শুধু পানির সংকটের সঙ্গে ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের কষ্টে জর্জরিত জনজীবন

বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য উপকূলবাসীর এই হাহাকার নতুন কিছু নয়। যুগের পর যুগ অতিবাহিত হলেও পানি সমস্যার সমাধান হয়নি এ অঞ্চলে।
৮৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে পানির কষ্ট দেখে আসছি। পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কত সরকার এলো-গেল, কিন্তু আমাদের পানির কষ্ট দূর হলো না।

স্থানীয় অপর এক বাসিন্দা হালিমা বেগম বলেন, পানি সংগ্রহ করতে দিনে এক ঘণ্টা করে হাঁটতে হয়। প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে পানি আনি। চোখ থেকে লবণ পানি ঝরলেও কখনো মিষ্টি পানি পাইনি। লবণাক্ততার কারণে তার বাড়ির ইট-বালু দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। ইটের যদি এমন অবস্থা হয়, তবে আমাদের শরীরের কী হচ্ছে আল্লাহ জানেন।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রভাব

পল্লী চিকিৎসক ইমরান হোসেন বলেন, লবণাক্ততার কারণে এলাকায় চর্মরোগ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এখানকার নারীরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোজাফফর হোসেন বলেন, সংকট এবং অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, ফ্লুরোসিস, চর্মরোগ ও আর্সেনিকোসিস রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তিনি নিরাপদ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ বলেন, উপকূলীয় ৭৩ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। লবণাক্ততা শুধু মানুষের জীবন নয়, কৃষি, পশুপালন এবং পরিবেশের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

সংকট নিরসনে পরিকল্পনা

রামপাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরান হোসেন বলেন, বাজেট অনুযায়ী কিছু পরিবারে পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংকি দেওয়া হচ্ছে। সামনে নতুন প্রকল্প আসলে পুকুর সংস্কারসহ টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিশ্রুতি নয়, দরকার কার্যকরী পদক্ষেপ

চাকশ্রী এ বি সি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিম ফকির বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বা বৈশ্বিক লক্ষ্য মাত্রায় ৬ নম্বর গোলে নিরাপদ পানির কথা বলা হয়েছে। দেশ এসডিজি গোল লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের পানির সংকট আরও বেড়ে যাচ্ছে। এখন যদি সরকার নিরাপদ পানির দিকে নজর না দেয়, তাহলে এই উপকূলের মানুষের কষ্টের শেষ হবে না।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফাইট ফর কোস্টাল রাইটস অ্যান্ড জাস্টিস (এফএফসিআরজে)-এর সদস্য নাইমা আফরিন বলেন, পানির অপর নাম যদি জীবন হয়, তাহলে উপকূলের মানুষগুলো মৃত মানুষের জীবনযাপন করছে। সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর করেছি, কিন্তু বাস্তবায়ন দেখিনি। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানি এখন সোনার হরিণ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারের উদ্যোগ জরুরি। না হলে, এই জনপদে জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।