ঢাকা ১২:৪২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোজার প্রাণশক্তি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১
  • ১৬০ বার

হাদিসে ব্যবহৃত ‘ঈমান’ (বিশ্বাস) ও ‘ইহতিসাব’ (সওয়াবের আশা) শব্দদ্বয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সব অঙ্গীকারকে সত্যজ্ঞান করা এবং প্রতিটি কাজে আল্লাহর কাছে প্রতিদান প্রত্যাশা করা; একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশা করা, সব কাজের আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনা করা। ঈমান ও ইহতিসাব মানুষকে মাটির পৃথিবী থেকে আরশে আজিমে পৌঁছে দেয়। আর গুণের অভাবে আমল প্রতিদানহীন হয়ে যায়। মুসলিম সমাজের আসল রোগ নিয়ত বা উদ্দেশ্যহীন কাজ করা। বেশির ভাগ কাজে তারা কোনো নিয়ত করে না। আমরা অজু করি কিন্তু তার নিয়ত করি না, আমরা নামাজ আদায় করি কিন্তু তাতে বিশ্বাস ও প্রতিদানের আশা থাকে না। বরং সমাজের অন্য ১০ জনের দেখাদেখি করি। রমজান মাসেও মুসলিম সমাজে একটি পরিবেশ তৈরি হয়। বহু মুসলিম শুধু সামাজিক লজ্জার ভয়ে রোজা রাখে। পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ম হিসেবে রোজা রাখলে তাতে কোনো প্রাণ থাকে না। মানুষ অসুস্থ হলে পানাহার ত্যাগ করে, সফরেও খাবারের সংকট থাকে। তাই রোজার উদ্দেশ্য শুধু পানাহার ত্যাগ করা নয়। রোজার মূল্য উদ্দেশ্য আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা। তিনি যা কিছু ত্যাগ করতে বলেছেন তা ছেড়ে দেওয়া। রোজাদার যখন বিশ্বাস করবে—আল্লাহ যা বলেছেন সত্য বলেছেন, তিনি আমাকে প্রতিদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমি অবশ্যই তাঁর সেই প্রতিদান পাচ্ছি, তখন সে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে পাবে।

নিয়ত, বোধ ও অনুভূতি ছাড়া ইবাদত অর্থহীন। এক ব্যক্তি বলছিলেন, ইফতারের অপার্থিব প্রশান্তি লাভের জন্য আমি রোজা রাখি। অথচ আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস নেই। রোজার কল্যাণ লাভের জন্য দিনে কয়েকবার নিয়ত বিশুদ্ধ করে নেওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টি সব সময় স্মরণে রাখা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই—রোজা ছাড়া। তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব। আর রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯২৭)

আল্লাহ যেন বলছেন, বান্দা আমার জন্য তার সব প্রিয় জিনিস ত্যাগ করে। এ জন্য আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেব।

ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে ঘোষিত পাঁচটি ইবাদত পরস্পরকে শক্তিশালী করে। একটি ইবাদত অন্যটি পালনে সহায়ক হয়, তা পালনের শক্তি জোগায়। একটি খাবার যেমন অন্য খাবারের জন্য সহায়ক হয়। একটি ইবাদতও অন্য ইবাদতের জন্য সহায়ক হয়। ইসলামের ইবাদতগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, প্রতিটি ইবাদতের পৃথক বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব থাকলেও তা কোনোভাবেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রোজাও ইসলামের অন্য ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রোজা অবশিষ্ট ১১ মাসের ইবাদতের শক্তি জোগায়, রোজার কারণে অন্যান্য ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়, তাতে প্রশান্তি মেলে।

রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। রোজার মাধ্যমে মানুষ রিপু ও প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের শক্তি পায় এবং তা সহজ হয়ে যায়, দ্বিন পালনের আগ্রহ তৈরি হয়, ইবাদতে তৃপ্তি এনে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

তাকওয়ার সাধারণ অর্থ আল্লাহকে ভয় করা। কিন্তু অনেকে তার অর্থ করে ‘বিবেচনা’ দ্বারা। অর্থাৎ এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া যে আল্লাহ কোন কাজে সন্তুষ্ট হবেন এবং কোন কাজে অসন্তুষ্ট হবেন, আল্লাহ কোন কাজ বৈধ করেছেন এবং কোন কাজ অবৈধ করেছেন। রমজানে দীর্ঘ এক মাস যখন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়গুলো বিবেচনা করে চলবে, পাপ-পঙ্কিলতা ত্যাগ করবে, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করবে, তখন তা তার অভ্যাসে পরিণত হবে। এ জন্য রমজানে ভালো কাজ বেশি বেশি করা উচিত এবং নিন্দনীয় ও পাপের কাজ পরিহার করা উচিত। রমজানে কোনো ব্যক্তি ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ ত্যাগ করার অনুশীলন করলে তার জীবন বদলে যাবে। আর কেউ যদি রোজা রেখে পাপ পরিহার করতে না পারে তার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা হলো, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

রোজার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহমুখী হওয়া। বান্দা আল্লাহমুখী হয় তার স্মরণ, জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে। সুতরাং যে রোজা রাখল অথচ সে তিলাওয়াত করল না, দান করল না, ভালো কাজ করল না, তারাবি পড়ল না, তার রোজা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না। রোজা ফলপ্রসূ হয় তাহাজ্জুদ, তাওবা ও দোয়ার মাধ্যমে।

সর্বোপরি স্মরণ রাখা উচিত, আমরা আল্লাহর মর্যাদা ও শান অনুযায়ী ইবাদত করতে পারি না, তাঁর কাছে ঠিকমতো ক্ষমাও প্রার্থনা করতে পারি না। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি নফল ইবাদত করা এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করা। যেন আল্লাহ অনুগ্রহবশত আমাদের ইবাদত-বন্দেগিগুলো কবুল করে নেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

রোজার প্রাণশক্তি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা

আপডেট টাইম : ০৯:৫৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১

হাদিসে ব্যবহৃত ‘ঈমান’ (বিশ্বাস) ও ‘ইহতিসাব’ (সওয়াবের আশা) শব্দদ্বয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সব অঙ্গীকারকে সত্যজ্ঞান করা এবং প্রতিটি কাজে আল্লাহর কাছে প্রতিদান প্রত্যাশা করা; একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশা করা, সব কাজের আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনা করা। ঈমান ও ইহতিসাব মানুষকে মাটির পৃথিবী থেকে আরশে আজিমে পৌঁছে দেয়। আর গুণের অভাবে আমল প্রতিদানহীন হয়ে যায়। মুসলিম সমাজের আসল রোগ নিয়ত বা উদ্দেশ্যহীন কাজ করা। বেশির ভাগ কাজে তারা কোনো নিয়ত করে না। আমরা অজু করি কিন্তু তার নিয়ত করি না, আমরা নামাজ আদায় করি কিন্তু তাতে বিশ্বাস ও প্রতিদানের আশা থাকে না। বরং সমাজের অন্য ১০ জনের দেখাদেখি করি। রমজান মাসেও মুসলিম সমাজে একটি পরিবেশ তৈরি হয়। বহু মুসলিম শুধু সামাজিক লজ্জার ভয়ে রোজা রাখে। পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ম হিসেবে রোজা রাখলে তাতে কোনো প্রাণ থাকে না। মানুষ অসুস্থ হলে পানাহার ত্যাগ করে, সফরেও খাবারের সংকট থাকে। তাই রোজার উদ্দেশ্য শুধু পানাহার ত্যাগ করা নয়। রোজার মূল্য উদ্দেশ্য আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা। তিনি যা কিছু ত্যাগ করতে বলেছেন তা ছেড়ে দেওয়া। রোজাদার যখন বিশ্বাস করবে—আল্লাহ যা বলেছেন সত্য বলেছেন, তিনি আমাকে প্রতিদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমি অবশ্যই তাঁর সেই প্রতিদান পাচ্ছি, তখন সে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে পাবে।

নিয়ত, বোধ ও অনুভূতি ছাড়া ইবাদত অর্থহীন। এক ব্যক্তি বলছিলেন, ইফতারের অপার্থিব প্রশান্তি লাভের জন্য আমি রোজা রাখি। অথচ আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস নেই। রোজার কল্যাণ লাভের জন্য দিনে কয়েকবার নিয়ত বিশুদ্ধ করে নেওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টি সব সময় স্মরণে রাখা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই—রোজা ছাড়া। তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব। আর রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯২৭)

আল্লাহ যেন বলছেন, বান্দা আমার জন্য তার সব প্রিয় জিনিস ত্যাগ করে। এ জন্য আমি নিজেই তাকে এর প্রতিদান দেব।

ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে ঘোষিত পাঁচটি ইবাদত পরস্পরকে শক্তিশালী করে। একটি ইবাদত অন্যটি পালনে সহায়ক হয়, তা পালনের শক্তি জোগায়। একটি খাবার যেমন অন্য খাবারের জন্য সহায়ক হয়। একটি ইবাদতও অন্য ইবাদতের জন্য সহায়ক হয়। ইসলামের ইবাদতগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, প্রতিটি ইবাদতের পৃথক বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব থাকলেও তা কোনোভাবেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রোজাও ইসলামের অন্য ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রোজা অবশিষ্ট ১১ মাসের ইবাদতের শক্তি জোগায়, রোজার কারণে অন্যান্য ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়, তাতে প্রশান্তি মেলে।

রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। রোজার মাধ্যমে মানুষ রিপু ও প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের শক্তি পায় এবং তা সহজ হয়ে যায়, দ্বিন পালনের আগ্রহ তৈরি হয়, ইবাদতে তৃপ্তি এনে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

তাকওয়ার সাধারণ অর্থ আল্লাহকে ভয় করা। কিন্তু অনেকে তার অর্থ করে ‘বিবেচনা’ দ্বারা। অর্থাৎ এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া যে আল্লাহ কোন কাজে সন্তুষ্ট হবেন এবং কোন কাজে অসন্তুষ্ট হবেন, আল্লাহ কোন কাজ বৈধ করেছেন এবং কোন কাজ অবৈধ করেছেন। রমজানে দীর্ঘ এক মাস যখন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়গুলো বিবেচনা করে চলবে, পাপ-পঙ্কিলতা ত্যাগ করবে, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করবে, তখন তা তার অভ্যাসে পরিণত হবে। এ জন্য রমজানে ভালো কাজ বেশি বেশি করা উচিত এবং নিন্দনীয় ও পাপের কাজ পরিহার করা উচিত। রমজানে কোনো ব্যক্তি ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ ত্যাগ করার অনুশীলন করলে তার জীবন বদলে যাবে। আর কেউ যদি রোজা রেখে পাপ পরিহার করতে না পারে তার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা হলো, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

রোজার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহমুখী হওয়া। বান্দা আল্লাহমুখী হয় তার স্মরণ, জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে। সুতরাং যে রোজা রাখল অথচ সে তিলাওয়াত করল না, দান করল না, ভালো কাজ করল না, তারাবি পড়ল না, তার রোজা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না। রোজা ফলপ্রসূ হয় তাহাজ্জুদ, তাওবা ও দোয়ার মাধ্যমে।

সর্বোপরি স্মরণ রাখা উচিত, আমরা আল্লাহর মর্যাদা ও শান অনুযায়ী ইবাদত করতে পারি না, তাঁর কাছে ঠিকমতো ক্ষমাও প্রার্থনা করতে পারি না। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি নফল ইবাদত করা এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করা। যেন আল্লাহ অনুগ্রহবশত আমাদের ইবাদত-বন্দেগিগুলো কবুল করে নেন।