ঢাকা ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারত নয়, ভারত-শাসন হতাশ করেছে: অমর্ত্য সেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৩:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
  • ৩৬৫ বার

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, ভারত সম্পর্কে তিনি এতটুকু বীতশ্রদ্ধ নন, কিন্তু ভারত-শাসন তাঁকে নিরাশ করেছে৷‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় বিকাশের স্বার্থে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারকে তিনি আরও বেশি মনোযোগী হতে বলেছেন৷ এখানে সেই সাক্ষাৎকারের কিয়দংশ তুলে দেওয়া হল৷

প্রশ্ন: ভারতের উন্নয়নকে আপনি কী চোখে দেখছেন?

অমর্ত্য সেন: ভারতের উন্নয়ন নিয়ে আমার নিজস্ব একটা ধারণা আছে৷ বিশেষ করে, তার বিকাশের ক্ষেত্রে খামতি নিয়ে৷এই খামতি তৈরি হয়েছে বিগত জমানায়৷ কিন্তু সেগুলি পূরণের কোনও ব্যবস্থা বর্তমান সরকার করেনি৷তার উপর সেকুলারিজম, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলি রয়েছে৷ সেগুলির ব্যাপারেও তাদের একটা জায়গায় দাঁড়াতে হবে৷
বস্তুত, গড়পড়তা ভারতবাসীর হয় বুনিয়াদি শিক্ষা নেই, নয়তো উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত৷ একইভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে আমরা যে অবস্থার মধ্যে রয়েছি, তাকে নরক গুলজার বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ রোগীরা জানেন না, তাঁরা কিসের জন্য খরচা করছেন৷ জন পরিষেবা যদি ভালো না হয়, তাহলে তার জন্য সাধারণ মানুষকে অতি সহজেই শোষণের শিকার হতে হবে৷এই বঞ্চনার শিকার আমাদের বিগত জমানাতেও হতে হয়েছে৷ হামেশাই আমাকে ইউপিএ-র সমর্থক বলে ভাবা হত৷ আমি কিন্তু তাদের সমালোচনা করতে ছাড়িনি৷তারাও যেমন জনকল্যাণমূলক কাজগুলি সেভাবে করেনি, এখনও করা হচ্ছে না৷ স্কুলপড়ুয়াদের মিল, সর্বশিক্ষা অভিযানের বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে কিছুই হচ্ছে না৷ তাই আমি হতাশ৷ যদি বিকাশের ক্ষেত্রে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে এবং তার সুফল বণ্টন নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে সরকারকে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে৷

প্রশ্ন: বিকাশের নীতির গতিপথে কি কোনও বদল দরকার?

অমর্ত্য সেন: ভারত যে যে ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে এগিয়েছে, সেগুলির কোনওটিই সাধারণ শ্রমের উপর প্রকৃতপক্ষে নির্ভরশীল নয়৷ বিশেষ শ্রমের উপর নির্ভরশীল৷ যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি৷ এক্ষেত্রে ইনফোসিস একটি অসাধারণ ভালো উদাহরণ৷ আর একটি ক্ষেত্র হল ওষুধ-প্রসাধনী অর্থাৎ ফার্মাসিউটিক্যালস৷ আর তৃতীয়টি হল গাড়ির যন্ত্রাংশ বা অটো পার্টস৷এই ধরনের পণ্য কোনও আনপড় শ্রমশক্তির পক্ষে উৎপাদন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার৷চিনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়৷আমি পেন ধরছি, ফোন তুলছি, ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি৷ সবই চিনে তৈরি৷ কী করে তারা এটা করতে পারছে? তুমি যদি পড়তে, লিখতে এবং গুনতে পার, আর সেইসঙ্গে যদি যথেষ্ট সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও এবং পূর্ণতেজে পুরো সময় পরিশ্রম করতে পার, তাহলে আলাদাভাবে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী না হলেও তোমার চলবে৷চাইলে আমরা ভারতবাসীও এটা অনায়াসে করে দেখাতে পারি৷ এর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির সম্পর্কের বোঝাপড়ায় সামঞ্জস্য আনা অত্যন্ত জরুরি৷ সেটাই এখন এদেশে দরকার৷

প্রশ্ন: মহাত্মা গান্ধীর নামে যে গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত আইন বা ১০০ দিনের কাজের আইন (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট বা এমজিএনরেগা) রয়েছে, তার কি পরিবর্তন দরকার?

অমর্ত্য সেন: সত্যি কথা বললে, আমি এতে অদলবদল আনার পক্ষপাতী৷তা বলে কি এই প্রকল্প পুরোপুরি জলে গিয়েছে? আমি তা মনে করি না৷ গলদ সত্ত্বেও এই প্রকল্পে কিছু কাজ হয়েছে, যা অন্য অনেক ক্ষেত্রে হয়নি৷ তবু এখন দেশে যে সরকার চলছে তাদের ধারণা, তারা অনেক সাফল্য পেয়েছে, আর সে জন্য কৃতিত্বও তাদের প্রাপ্য৷

এখন এই সরকার যদি এমজিএনরেগা-র ছিদ্রগুলি বন্ধ করতে পারে এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ভঙ্গ না করে এই আইনকে আরও বেশি করে সম্পদ-সৃষ্টির কাজে লাগাতে পারে, তাহলেই মঙ্গল৷ যত গুড় ঢালবে, তত মিষ্টি হবে৷ এমজিএনরেগায় প্রচুর টাকার দরকার৷ কিন্তু দেশের গোটা বাজেটের বহরে তুলনামূলকভাবে তার পরিমাণ যৎসামান্য৷ তবু এই প্রকল্প বহু লোকের চক্ষুশূল, তার কারণ এটাই একমাত্র জায়গা যেখান থেকে ভারতের গরিব মানুষ হাতে কিছু পয়সা পায়৷

প্রশ্ন: যেহেতু গরিব মানুষের গলার আওয়াজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিংবা ধনীদের উপরে ওঠে না, সে কারণেই কি এটা ঘটছে?

অমর্ত্য সেন: একেবারে ১০০ শতাংশ খাঁটি কথা৷

প্রশ্ন: আপনি কি ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের সুফলকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতেই এই প্রকল্পের সংশোধন চাইছেন?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ৷তবে আমি মনে করি, কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা করে তবেই কোনও কিছুকে সরাও৷সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে বটে৷তবে তা এই প্রকল্প প্রত্যাহারের একটা ‘ভদ্র পন্থা’ও হতে পারে৷ এটা করো না৷ হ্যাঁ, এটাকে সংস্কার করো৷তার পর যেটা চলছে তার জায়গায় সংশোধিত প্রকল্পটিকে কাজে লাগাও৷ তাই বলে তুমি কিছু সংস্কার করতে চাও এই অজুহাতে চালু প্রকল্পকে লাটে তুলে দিও না৷

প্রশ্ন: এই সরকার রান্নার গ্যাস সরবরাহে ভরতুকি তুলে দিতে চাইছে৷একই জিনিস তারা সার এবং খাদ্য সরবরাহে ভরতুকির ক্ষেত্রেও করবে বলে ভাবছে…..

অমর্ত্য সেন: তেলের দাম যে ভরতুকি পোষাতে কাজে আসে না, সেটা এই সরকার বুঝতে পেরেছে৷ সেইমতো তারা এগতে চাইছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এটা খুবই ভালো৷ এ ব্যাপারে আমি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী৷ যখন কিছু লোক বলে ভারতের ব্যাপারে তারা পুরোপুরি হতাশ তখন আমি তা হই না৷ভারতের ব্যাপারে আমি আদৌ হতাশ নই৷আমি হতাশ ভারত-শাসনের ধরনে৷

প্রশ্ন: ভারত-শাসনের কোন দিকটি আপনাকে হতাশ করছে?

অমর্ত্য সেন: বিষয়টি মূলত এই, একদল রয়েই গিয়েছে যারা ঘাড় ধরে তাদের কণ্ঠস্বর অনবরত তোমাকে শুনিয়েই ছাড়ছে, আর এক অংশের কণ্ঠস্বর শোনাই যাচ্ছে না৷ আমি কোনও সরকারকে উপদেশ দিতে চাইছি না৷ আমি বলতে চাইছি, আমাদের অগ্রাধিকারটাকে প্রাধান্য দিতে হবে৷সর্বাগ্রে মানতে হবে যে, কোনও অর্থনীতির শক্তি নির্ভর করে সাধারণ মানুষের শক্তির উপর৷আর সাধারণ মানুষের শক্তি-সামর্থ্য নির্ভর তার শিক্ষা-অশিক্ষা, তার স্বাস্থ্য-অসুস্থতা, সব কিছুর উপর৷সব সময় যদি কাউকে ভাবতে হয় যে, এর পর অসুস্থ হলে সে আর বাঁচবে তো, কিংবা টাকাপয়সা খরচ করে সুস্থ হতে গিয়ে পুরোপুরি সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে না তো, তাহলে কি তার পক্ষে কখনও পূর্ণ উদ্যমে আপন শক্তি কাজে লাগানো সম্ভব? দরিদ্র সাধারণ ভারতবাসীকে এইসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে, তাদের সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে যত দিন না কোনও সরকার সত্যি সত্যিই উদ্যোগী হবে, তত দিন পর্যন্ত ভারতের প্রকৃত অর্থনৈতিক বিকাশ দূরঅস্ত৷

প্রশ্ন: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা কি আজও আপনাকে বিচলিত করে?

অমর্ত্য সেন: কেন সরে এলাম, তা বলতে কোনও আপত্তি নেই৷ আমার বোর্ড (পরিচালন কর্তৃপক্ষ) চাইছিল, আমি থাকি৷ কিন্তু এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, সরকারপক্ষ চাইছে না আমি থাকি৷ একইসঙ্গে অনুভব করছিলাম যে, আমি যদি থেকে যাই, তাহলে হয়তো আমার ইগো সব দিক থেকে তুষ্ট হবে, কিন্তু নালন্দার পক্ষে কাজের কাজ কিসসু হবে না৷ কারণ, প্রতিটি পদক্ষেপই হয় সরকারের তরফ থেকে আটকে দেওয়া হচ্ছ্লি, নয়তো তাতে বাগড়া দেওয়া হচ্ছিল৷

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ভারত নয়, ভারত-শাসন হতাশ করেছে: অমর্ত্য সেন

আপডেট টাইম : ১২:০৩:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, ভারত সম্পর্কে তিনি এতটুকু বীতশ্রদ্ধ নন, কিন্তু ভারত-শাসন তাঁকে নিরাশ করেছে৷‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় বিকাশের স্বার্থে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারকে তিনি আরও বেশি মনোযোগী হতে বলেছেন৷ এখানে সেই সাক্ষাৎকারের কিয়দংশ তুলে দেওয়া হল৷

প্রশ্ন: ভারতের উন্নয়নকে আপনি কী চোখে দেখছেন?

অমর্ত্য সেন: ভারতের উন্নয়ন নিয়ে আমার নিজস্ব একটা ধারণা আছে৷ বিশেষ করে, তার বিকাশের ক্ষেত্রে খামতি নিয়ে৷এই খামতি তৈরি হয়েছে বিগত জমানায়৷ কিন্তু সেগুলি পূরণের কোনও ব্যবস্থা বর্তমান সরকার করেনি৷তার উপর সেকুলারিজম, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলি রয়েছে৷ সেগুলির ব্যাপারেও তাদের একটা জায়গায় দাঁড়াতে হবে৷
বস্তুত, গড়পড়তা ভারতবাসীর হয় বুনিয়াদি শিক্ষা নেই, নয়তো উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত৷ একইভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে আমরা যে অবস্থার মধ্যে রয়েছি, তাকে নরক গুলজার বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ রোগীরা জানেন না, তাঁরা কিসের জন্য খরচা করছেন৷ জন পরিষেবা যদি ভালো না হয়, তাহলে তার জন্য সাধারণ মানুষকে অতি সহজেই শোষণের শিকার হতে হবে৷এই বঞ্চনার শিকার আমাদের বিগত জমানাতেও হতে হয়েছে৷ হামেশাই আমাকে ইউপিএ-র সমর্থক বলে ভাবা হত৷ আমি কিন্তু তাদের সমালোচনা করতে ছাড়িনি৷তারাও যেমন জনকল্যাণমূলক কাজগুলি সেভাবে করেনি, এখনও করা হচ্ছে না৷ স্কুলপড়ুয়াদের মিল, সর্বশিক্ষা অভিযানের বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে কিছুই হচ্ছে না৷ তাই আমি হতাশ৷ যদি বিকাশের ক্ষেত্রে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে এবং তার সুফল বণ্টন নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে সরকারকে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে৷

প্রশ্ন: বিকাশের নীতির গতিপথে কি কোনও বদল দরকার?

অমর্ত্য সেন: ভারত যে যে ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে এগিয়েছে, সেগুলির কোনওটিই সাধারণ শ্রমের উপর প্রকৃতপক্ষে নির্ভরশীল নয়৷ বিশেষ শ্রমের উপর নির্ভরশীল৷ যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি৷ এক্ষেত্রে ইনফোসিস একটি অসাধারণ ভালো উদাহরণ৷ আর একটি ক্ষেত্র হল ওষুধ-প্রসাধনী অর্থাৎ ফার্মাসিউটিক্যালস৷ আর তৃতীয়টি হল গাড়ির যন্ত্রাংশ বা অটো পার্টস৷এই ধরনের পণ্য কোনও আনপড় শ্রমশক্তির পক্ষে উৎপাদন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার৷চিনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়৷আমি পেন ধরছি, ফোন তুলছি, ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি৷ সবই চিনে তৈরি৷ কী করে তারা এটা করতে পারছে? তুমি যদি পড়তে, লিখতে এবং গুনতে পার, আর সেইসঙ্গে যদি যথেষ্ট সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও এবং পূর্ণতেজে পুরো সময় পরিশ্রম করতে পার, তাহলে আলাদাভাবে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী না হলেও তোমার চলবে৷চাইলে আমরা ভারতবাসীও এটা অনায়াসে করে দেখাতে পারি৷ এর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির সম্পর্কের বোঝাপড়ায় সামঞ্জস্য আনা অত্যন্ত জরুরি৷ সেটাই এখন এদেশে দরকার৷

প্রশ্ন: মহাত্মা গান্ধীর নামে যে গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত আইন বা ১০০ দিনের কাজের আইন (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট বা এমজিএনরেগা) রয়েছে, তার কি পরিবর্তন দরকার?

অমর্ত্য সেন: সত্যি কথা বললে, আমি এতে অদলবদল আনার পক্ষপাতী৷তা বলে কি এই প্রকল্প পুরোপুরি জলে গিয়েছে? আমি তা মনে করি না৷ গলদ সত্ত্বেও এই প্রকল্পে কিছু কাজ হয়েছে, যা অন্য অনেক ক্ষেত্রে হয়নি৷ তবু এখন দেশে যে সরকার চলছে তাদের ধারণা, তারা অনেক সাফল্য পেয়েছে, আর সে জন্য কৃতিত্বও তাদের প্রাপ্য৷

এখন এই সরকার যদি এমজিএনরেগা-র ছিদ্রগুলি বন্ধ করতে পারে এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ভঙ্গ না করে এই আইনকে আরও বেশি করে সম্পদ-সৃষ্টির কাজে লাগাতে পারে, তাহলেই মঙ্গল৷ যত গুড় ঢালবে, তত মিষ্টি হবে৷ এমজিএনরেগায় প্রচুর টাকার দরকার৷ কিন্তু দেশের গোটা বাজেটের বহরে তুলনামূলকভাবে তার পরিমাণ যৎসামান্য৷ তবু এই প্রকল্প বহু লোকের চক্ষুশূল, তার কারণ এটাই একমাত্র জায়গা যেখান থেকে ভারতের গরিব মানুষ হাতে কিছু পয়সা পায়৷

প্রশ্ন: যেহেতু গরিব মানুষের গলার আওয়াজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিংবা ধনীদের উপরে ওঠে না, সে কারণেই কি এটা ঘটছে?

অমর্ত্য সেন: একেবারে ১০০ শতাংশ খাঁটি কথা৷

প্রশ্ন: আপনি কি ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের সুফলকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতেই এই প্রকল্পের সংশোধন চাইছেন?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ৷তবে আমি মনে করি, কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা করে তবেই কোনও কিছুকে সরাও৷সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে বটে৷তবে তা এই প্রকল্প প্রত্যাহারের একটা ‘ভদ্র পন্থা’ও হতে পারে৷ এটা করো না৷ হ্যাঁ, এটাকে সংস্কার করো৷তার পর যেটা চলছে তার জায়গায় সংশোধিত প্রকল্পটিকে কাজে লাগাও৷ তাই বলে তুমি কিছু সংস্কার করতে চাও এই অজুহাতে চালু প্রকল্পকে লাটে তুলে দিও না৷

প্রশ্ন: এই সরকার রান্নার গ্যাস সরবরাহে ভরতুকি তুলে দিতে চাইছে৷একই জিনিস তারা সার এবং খাদ্য সরবরাহে ভরতুকির ক্ষেত্রেও করবে বলে ভাবছে…..

অমর্ত্য সেন: তেলের দাম যে ভরতুকি পোষাতে কাজে আসে না, সেটা এই সরকার বুঝতে পেরেছে৷ সেইমতো তারা এগতে চাইছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এটা খুবই ভালো৷ এ ব্যাপারে আমি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী৷ যখন কিছু লোক বলে ভারতের ব্যাপারে তারা পুরোপুরি হতাশ তখন আমি তা হই না৷ভারতের ব্যাপারে আমি আদৌ হতাশ নই৷আমি হতাশ ভারত-শাসনের ধরনে৷

প্রশ্ন: ভারত-শাসনের কোন দিকটি আপনাকে হতাশ করছে?

অমর্ত্য সেন: বিষয়টি মূলত এই, একদল রয়েই গিয়েছে যারা ঘাড় ধরে তাদের কণ্ঠস্বর অনবরত তোমাকে শুনিয়েই ছাড়ছে, আর এক অংশের কণ্ঠস্বর শোনাই যাচ্ছে না৷ আমি কোনও সরকারকে উপদেশ দিতে চাইছি না৷ আমি বলতে চাইছি, আমাদের অগ্রাধিকারটাকে প্রাধান্য দিতে হবে৷সর্বাগ্রে মানতে হবে যে, কোনও অর্থনীতির শক্তি নির্ভর করে সাধারণ মানুষের শক্তির উপর৷আর সাধারণ মানুষের শক্তি-সামর্থ্য নির্ভর তার শিক্ষা-অশিক্ষা, তার স্বাস্থ্য-অসুস্থতা, সব কিছুর উপর৷সব সময় যদি কাউকে ভাবতে হয় যে, এর পর অসুস্থ হলে সে আর বাঁচবে তো, কিংবা টাকাপয়সা খরচ করে সুস্থ হতে গিয়ে পুরোপুরি সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে না তো, তাহলে কি তার পক্ষে কখনও পূর্ণ উদ্যমে আপন শক্তি কাজে লাগানো সম্ভব? দরিদ্র সাধারণ ভারতবাসীকে এইসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে, তাদের সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে যত দিন না কোনও সরকার সত্যি সত্যিই উদ্যোগী হবে, তত দিন পর্যন্ত ভারতের প্রকৃত অর্থনৈতিক বিকাশ দূরঅস্ত৷

প্রশ্ন: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা কি আজও আপনাকে বিচলিত করে?

অমর্ত্য সেন: কেন সরে এলাম, তা বলতে কোনও আপত্তি নেই৷ আমার বোর্ড (পরিচালন কর্তৃপক্ষ) চাইছিল, আমি থাকি৷ কিন্তু এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, সরকারপক্ষ চাইছে না আমি থাকি৷ একইসঙ্গে অনুভব করছিলাম যে, আমি যদি থেকে যাই, তাহলে হয়তো আমার ইগো সব দিক থেকে তুষ্ট হবে, কিন্তু নালন্দার পক্ষে কাজের কাজ কিসসু হবে না৷ কারণ, প্রতিটি পদক্ষেপই হয় সরকারের তরফ থেকে আটকে দেওয়া হচ্ছ্লি, নয়তো তাতে বাগড়া দেওয়া হচ্ছিল৷