হাওরত বার্তা ডেস্কঃ স্বর্ণ চোরাকারবারি গোল্ডেন মনিরের হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট -সিআইডি)। ১২ বছরে মনির ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১২৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (হিসাব) লেনদেন হয়েছে ৯০০ কোটি টাকার।
তার সোনা চোরাচালান ও অবৈধ কারবারের সিন্ডিকেটে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এদেরও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। এরই মধ্যে তাদের অপরাধ সংশ্লিষ্ট ও অপরাধলব্ধ আয়ে কোনো সম্পদ করেছেন কিনা- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা মনির ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের তথ্য চেয়ে রেজিস্ট্রার অব জয়েনস্টক কোম্পানি, রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ), বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ), বিএফআইইউকে (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) চিঠি দিয়েছে। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তদন্ত কর্মকর্তাদের এই চিঠিকে পাত্তা না দেওয়ায় মামলার অনুসন্ধান কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। সিআইডি, দুদক ও বিএফআইইউ সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘গোল্ডেন মনিরের অপরাধলব্ধ আয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরও ৪-৫ জনের নাম এসেছে। অনুসন্ধান কাজে এখন পর্যন্ত কোনো তদবির বা চাপ নেই। অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধেই তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধেই মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। এক্ষেত্রে কারও রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া হবে না।’
গত বছরের ২১ নভেম্বর মেরুল বাড্ডার বাসায় অভিযান চালিয়ে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে মাদক ও অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। এখনো তিনি কারাবন্দি। র্যাবের নিয়মিত মামলার জের ধরে অপরাধলব্ধ আয়ের অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে।
গ্রেফতারের সময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নব্বইয়ের দশকে গাউসিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন মনির। সময়ের ব্যবধানে মনির শীর্ষ স্থানীয় স্বর্ণ চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। এরপর টাকার প্রভাবে সে জালজালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য প্লটের মালিক হন।
পুলিশ জানায়, গোল্ডেন মনির র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর দায়ের করা নিয়মিত মামলার তদন্ত করছে র্যাব। তবে মনির ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের অনুসন্ধান করছে সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম ইউনিট। অনুসন্ধান কাজে নেমে মনির ও তার সিন্ডিকেটে জড়িতদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যে বিস্ময়ে হতবাক তদন্ত কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে অন্তত ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মনিরের মালিকানা নিশ্চিত হয়েছে তারা।
এর মধ্যে আছে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের বিশাল শপিংমল গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার, আল সাফা টাওয়ার, অটো কার সিলেকশন, গালফ অটো, মনির বিল্ডার্স ও স্বদেশ প্রপার্টিজ। স্বদেশ প্রপার্টিজে মনির ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। আর কয়েকজন স্বর্ণ চোরাকারবারি মিলে জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেছেন বলে সিআইডির কাছে তথ্য রয়েছে।
একই ব্যক্তিরা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে ৯০ কাঠা জায়গার ওপর তৈরি করছে আল সাফা টাওয়ার। এছাড়া মনিরের বাড্ডা ডিআইটিতে ৩০টি ও রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে ১টি প্লটের সন্ধান পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তারা প্লটগুলো সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে ২৫ ফেব্রুয়ারি দরকারি তথ্য চেয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয়। কিন্তু রাজউক এখনো সেই চিঠির জবাব দেয়নি।
অনুসন্ধান কাজে নেমে সিআইডি জানতে পেরেছে, মনিরের প্লটের বেশির ভাগই তার আত্মীয়স্বজনের নামে। মনিরের কল্যাণে তার স্ত্রী-সন্তান, বোন, ভগ্নিপতি, ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের স্টাফদের অনেকেই কোটি কোটি টাকা, প্লট ও দামি গাড়ির মালিক। মনিরের এক ভগ্নিপতি হাসান আলী। পেশায় ক্ষুদ্র ছাপাখানা ব্যবসায়ী। অথচ বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্টের ১৩ নম্বর রোডের এক নম্বর প্লটের মালিক হাসান। আড়াই কাঠার প্লটটিতে একতলা ভবন করে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। সেখান থেকে মাসে ১ লাখ টাকা ভাড়া পান তিনি।
তার প্রিমিও ব্র্যান্ডের গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ২২-৯১৬০। হাসানের স্ত্রী নাসিমা আক্তার। পেশায় গৃহিণী। তিনিও ডিআইটি প্রজেক্টের ১২ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর প্লটের মালিক। আরেক ভগ্নিপতি নাহিদ হোসেন পুরনো ঢাকার মৌলভীবাজারে মসলা ব্যবসায়ী। বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্টের ১০ নম্বর রোডের ৮ নম্বর প্লটটি তার নামে।
তারও আছে প্রিমিও ব্র্যান্ডের গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ৪২-৫৩০০। একই প্রজেক্টে ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর প্লটের মালিক মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার। আর ছেলে রাফি অটোকার সিলেকশনের অংশীদার। শুধু পরিবারের সদস্যদের নামেই নয়, প্রতিষ্ঠানের স্টাফদের নামেও প্লট কিনেছেন মনির। তাদের ভাগ্যেরও বদল হয়েছে। অটোকার সিলেকশনের জিএম আব্দুল হামিদের নামে আছে ৭ নম্বর রোডের ৮৬ নম্বর প্লটটি। বাড্ডা রাজউক প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সদস্যও তিনি। চড়েন প্রিমিও ব্র্যান্ডের গাড়িতে।
সিআইডি নিশ্চিত হয়েছে, স্বদেশ প্রপার্টিজের ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মনির। প্রতিষ্ঠানের নামে কেনা ল্যান্ডক্রুজার পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৫২০০) আছে মনিরের বাসার গ্যারেজে।
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বদেশ প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দিয়ে সিআইডি অফিসে ডাকা হয়। তাতে তিনি পাত্তা না দিলে ৯ মার্চ ফের চিঠির মাধ্যমে গতকাল সোমবার তাকে সিআইডি অফিসে তলব করা হয়। কিন্তু তিনি হাজির হননি। তবে তিনি অনুসন্ধান কাজে সহযোগিতা না করলে মানি লন্ডারিং আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী তথ্য প্রদানে অসহযোগিতার কারণে অভিযোগে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
মনির ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ-কে ২৫ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেয় সিআইডি। চিঠির জবাবে তারা জানান, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মনির ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নামে খোলা ১২৯টি অ্যাকাউন্টে ৯০০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।
আর মনিরের ডিআইটি প্রজেক্টে যে ৩০টি ও পূর্বাচল প্রকল্পে ১ প্লটের তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলোর মালিকানা নিশ্চিত হতে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা। কিন্তু রাজউক এখনো চিঠির কোনো জবাব দেয়নি।
অনুসন্ধানকালে মনিরের সোনা চোরাচালান ও অবৈধ কারবারে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী জড়িত বলে সন্দেহ করছে সিআইডি। এদের বিষয়েও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। গত বছরের ১ ডিসেম্বর দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর চিঠি দিয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন।
চিঠিতে বলা হয়, মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির স্বর্ণ চোরাচালান, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি ও দুই শতাধিক প্লট দখল ও হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুদক কর্মকর্তাদের কি জানিয়েছেন সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রদীপ কুমার বসু বলেন, ‘এটা দুদককেই জিজ্ঞাসা করেন। ওনারাই বলবে। আমি মিটিংয়ে। এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’
এছাড়া একই ধরনের অভিযোগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম শফিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। সিআইডির কাছে তথ্য আছে, মনিরের স্বর্ণ চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। মনিরের সঙ্গে জমজম টাওয়ারের অংশীদারও ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিক।
এ তালিকায় আরও আছেন সিরাজগঞ্জের একটি উপজেলার চেয়ারম্যান মো. রিয়াজ ও তার ভাই হায়দার আলী। হায়দার আলী গ্র্যান্ড জমজম ও আল সাফা টাওয়ারের অংশীদার। এদের ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য জানতে জয়েন স্টক কোম্পানিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এখনো তারা কোনো তথ্য দেয়নি। অনুসন্ধান কর্মকর্তা বলেন, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে সময়মতো তথ্য না পাওয়ায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের কথা স্বীকার করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম শফিক যুগান্তরকে বলেন, আমি জমজম টাওয়ারের অংশীদার এটা ঠিক। জমজম টাওয়ারের পাশে আমার ৫ কাঠা জায়গা ছিল।
টাওয়ার তৈরির সময় আমি জায়গাটি দিয়ে টাওয়ারের অংশীদার হই। এখানে আর অন্য কোনো বিষয় নেই। স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িত থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেন।