ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর বক্তব্যে হইচই পড়ে যায়

জ্ঞাণতাপস ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর বক্তব্যে হইচই পড়ে যায়। এক সময় ব্রিটিশদের কাছে লিখিত প্রস্তাব করা হয়, ভারতের রাষ্ট্র ভাষা যাই হোক, তবে বাঙালিদের ভাষা হবে বাঙলা।

এর পর কোনো এক সময় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা দিলেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। হিন্দিকে সমগ্র ভারতের ভাষার দাবী ওঠার পর থেকে ভারতের মুসলমানরা ক্ষেপে যায়। তাদের পক্ষ থেকে দাবী ওঠে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার।

উপমহাদেশে তখন ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল। হিন্দি হিন্দুদের ভাষা- অন্যদিকে উর্দু-আরবি মুসলমানদের ভাষা- এই ধরনের মতবাদ ছিল। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করতো বাঙলাও হিন্দুদের ভাষা। তাই ধর্মীয় মতবাদের উপর দেশভাগের পর পাকিস্তানীরা চাপ সৃষ্টি করে বাঙলা ভাষার উপর। যার ফলেই জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের।

ভাষার জন্য বাঙালির আন্দোলন ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় বিশ দশকে। বিশেষ করে বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৯ সাল নানাভাবেই গুরুত্বপুর্ণ ছিল। এ সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত পর্বে উপনীত করে ভাষা আন্দোলনকে। বাতলে দেয় বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তির পথ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম সফল গণবিস্ফোরণের স্মৃতি উজ্জ্বল করে রাখতে এ বছরের ১১ মার্চ পালিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’। চলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত।

পুর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারী কর্মকান্ড ও শিক্ষার একমাত্র ভাষা এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে উত্তাল তখন পুর্ব পাকিস্তান। ঠিক তখনই, এ বছরের ৯ মার্চ, আরবি হরফে বাংলা লেখার এক উদ্ভট প্রস্তাব করে পাকিস্তান সরকার। খাজা নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগে দেওয়া এ প্রস্তাবের মুল উদ্দেশ ছিলো- হিন্দুয়ানী বাংলা হরফ থেকে বাংলাকে মুক্ত করে ইসলামী ভাবাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করা।

সে লক্ষ্যে মৌলানা আকরাম খানকে চেয়ারম্যান করে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। সরকারি উদ্যোগেই তৈরি হয় একটি বড় আকারের তহবিলও।

এ উদ্ভট প্রস্তাবের পক্ষে পার্লামেন্টে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও সাধারণ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যেই সরকার গোটা পাকিস্তানে একই হরফ প্রচলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এ কাজের জন্য আরবি হরফই সবচেয়ে উপযুক্ত।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ পুর্ব পাকিস্তানের সকল ভাষাতত্ত্ববিদ একযোগে আরবি হরফে বাংলা লেখার এ উদ্ভট প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে তিব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ থেকে পিছু হটে সরকার। তবে অনঢ় থাকে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষেই।

আসে ২৩ জুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গী ও নায্য দাবি দাওয়া পুরণে অস্বীকৃতি- ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ করে তোলে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষকে।

বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি মুসলীম লীগের পক্ষপাতিত্ব নতুন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে পুর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের।

মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলীম লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক (টাঙ্গাইল) এবং যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

একই সময়ে পীর মানকি শরীফ এর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানেও গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে এই দুই দল একীভূত হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে। আহ্বায়ক হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

মাওলানা ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত- টানা আট বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নেতৃত্ব দেন ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। পুর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও সংগঠনটি সোচ্চার ছিলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর