মশাবাহিত রোগ ‘জিকা ভাইরাস’ আতঙ্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। রোগটি মোকাবেলায় এরই মধ্যে দুই লাখ সেনা নামিয়েছে ব্রাজিল। সতর্কতায় জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। কলম্বিয়া, ইকুয়েডরসহ বেশ কয়েকটি দেশে দম্পতিদের ‘গর্ভধারণ’ পেছানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারিতে শঙ্কায় পড়েছে চলতি বছরের অলিম্পিকও।
সম্প্রতি রোগটি নিয়ে এখন বাংলাদেশেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞাণীরা এ নিয়ে দেশের মানুষক উদ্বিগ্ন হতে বারণ করেছেন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষনা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর দুই বিজ্ঞাণী অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান ও ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এ রোগ বিস্তারের ঝুঁকি নেই বললেই চলে।তবে সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশের এই দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী থেকে জিকা ভাইরাসের ব্যাপারে নানা তথ্য জানা গেছে।
শুরু উগান্ডায়
জানা গেছে, পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডায় জিকা নামক এক বনাঞ্চলে ১৯৪৭ সালে প্রথম এ ভাইরাসের সন্ধান মেলে। গবেষণা করে বানরের দেহে নতুন এক অণুজীবের খোঁজ পান বিজ্ঞানীরা, যার নাম দেওয়া হয় ‘জিকা ভাইরাস’।
এর সাত বছর পর নাইজেরিয়ায় প্রথম মানবদেহে এ ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে। এরপর দুই দফায় এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে এশিয়া ও মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলে।
গতবছর ব্রাজিলে নতুন করে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে। এরপর মাত্র চার মাসের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় কয়েকটি দেশে।
উপসর্গ
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিকা ভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে এর লক্ষণ স্পষ্ট নয় বলে রোগিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ রোগে আক্রান্তের শরীরে হালকা জ্বর, চোখে লাল হওয়া বা কালশিটে দাগ পড়া, মাথা ব্যথা, হাড়ের গিঁটে ব্যথা ও চর্মরোগের লক্ষণ দেখা যায়। কখনো কখনো রোগিরা গিলিয়ান-ব্যারি সিনড্রোমেও ভুগতে পারেন। এর ফলে সাময়িক পক্ষাঘাত কিংবা ‘নার্ভাস সিস্টেম ডিজঅর্ডারের’ মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম ও বেশি করে তরল খাবার খেতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
উদ্বেগ নবজাতকদের নিয়ে
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, গর্ভবতী মা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার অনাগত শিশুর মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে, মস্তিষ্কের গঠন থাকতে পারে অপূর্ণ। এ রোগকে বলে মাইক্রোসেফালি। এর ফলে আক্রান্ত শিশু ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ হতে পারে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবিকশিত মস্তিষ্ক শিশুর মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। তবে জিকা ভাইরাস ঠিক কীভাবে গর্ভের শিশুর এই ক্ষতি ঘটায় তা এখনো উদ্ঘাটন করা যায়নি।
বাহক মশা
সাধারণত এডিস মশা রোগটির ভাইরাস বহন করে।তবে এডিসের কোন জাত ‘এডিস এজিপ্টি ফারমোসাস’ নাকি ‘এডিস এজিপ্টি’ এর বাহক- তা এখনো আবিস্কার হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিস এজিপ্টি ফরমোসাস ‘নির্বিষ এবং এটি মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। সুতরাং এটি নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভয় হলো এডিস এজিপ্টি নিয়ে। এ মশার কারণে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ‘চিকনগুনিয়া’ নামক একটি মশারও এ ভাইরাস বহন করে।
কিভাবে ছড়ায়
জানা গেছে, ডিম পাড়তে এডিস এজিপ্টি মেয়ে মশার মানবরক্তের প্রয়োজন হয়। আর ওই রক্তের মাধ্যমেই আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সুস্থ দেহে। এ প্রজাতির মেয়ে মশা দিনের বেলাতেও কামড়ায় বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন।
এ মশাটি ১০০ মিটারের বেশি উড়তে চায় না। তবে যানবাহনে চড়ে পৌঁছে যেতে পারে কয়েকশ মাইল দূরে। এ প্রজাতির মশা সাগরে ভাসমান কোনো নৌকায় ওঠার পর পুরো জীবনচক্র সেখানেই কাটিয়ে দিতে পরে।
বংশবৃদ্ধির জন্য এ মশার পরিষ্কার পানি দরকার হয় না। ফুলের টবের মতো ছোট ও বদ্ধ পাত্রে সহজেই ডিম পাড়তে পারে। নগরের ঘিঞ্জি পরিবেশও এই মশা বিস্তারের সহায়ক।