এক পরিসংখ্যানে নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদের ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে। ইউনিসেফের ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ কোটি নারী তথাকথিত শাস্ত্রীয় রীতি পালনের নাম করে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। এদের অর্ধেকই থাকেন বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশে। ৩০ টি দেশের ওপর গবেষণা শেষে নতুন এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ জিরো টলারেন্স ফর এফজিএম-কে সামনে রেখে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
যৌনাঙ্গচ্ছেদ হলো বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত থাকা এক প্রথা, যে প্রথা অনুযায়ী নারীর যৌনাঙ্গের বাহ্যিক অংশ সাধারণত একটি ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা হয়। এটি করা হয়, নারীর সতীত্ব রক্ষার কথা বলে। আসলে নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে পুরষতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকেই এমনটা করা হয়। রীতি অনুযায়ী যে নারীরা যৌনাঙ্গচ্ছেদে বাধ্য হন, তাদের অনেকেই আবার এটাকে সম্মান আর সতীত্বের জায়গা থেকে দেখে থাকেন। ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে এই যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই এই কাজের সময় চেতনানাশক ব্যবহার করা হয় না। ফলে নারীরা তীব্র ব্যথা পান এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ইউনিসেফের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে বর্তমানে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার নারীর সংখ্যা ২০১৪ সালের চেয়ে ৭ কোটি বেশি। ইন্দোনেশিয়াকে হিসেবের অন্তর্ভূক্ত করার পর এ সংখ্যা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ইউনিসেফ জানায়, ইন্দোনেশিয়াতে ২০০৬ সালে নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ নিষিদ্ধ করা হলেও দেশটিতে এখনও ওই প্রথা অব্যাহত আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার নারীদের অর্ধেকেরই বসবাস ইন্দোনেশিয়া, মিশর ও ইথিওপিয়ার। আর মোট নারী জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশকে যৌনাঙ্গচ্ছেদ করিয়ে ব্যাপকতার দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে সোমালিয়া।
প্রতিবেদন তৈরিকারী গবেষকদের একজন ক্লডিয়া কাপ্পা। তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়াতে যে এতো বেশি সংখ্যক যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে তা গবেষকদের ধারণার বাইরে ছিল। ক্লডিয়া বলেন, ‘আগে যে সমস্যাটি কেবল আফ্রিকার বলে বিবেচিত হতো তা এখন গোটা বিশ্বের সংকট বলে বিবেচিত হচ্ছে।’
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার নারীদের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখের বয়স ১৪ বছর কিংবা তারও কম। এরমধ্যে বেশিরভাগ কিশোরীই তাদের বয়স ৫ বছর হওয়ার আগেই যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার হয়েছে।
গিনিতে বেআইনি ঘোষণার পরও দেশটির প্রায় ৯৭ শতাংশ নারীকে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার হতে হয়। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রামকর্তাদের নির্দেশে পরিবারের কাছ থেকে তাদেরকে জোর করে যৌনাঙ্গচ্ছেদের জন্য নিয়ে আসা হয়। তথাকথিত এই রীতি পালনের সময় এক ৫ বছর শিশুকে মারা যেতে দেখেছেন বলেও জানান ইউনিসেফের গবেষকরা।
তারা বলেন, ‘একটি গ্রামে বড়দিন উদযাপনের দুইদিন পর গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ৫ বছর বয়সী শিশু কোম্বাসহ ১১ জন নারীকে জঙ্গলে নিয়ে যায়। এরমধ্যে কারও কারও পরিবারকেও জানানো হয়নি। কাউকে আবার জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রচণ্ড রক্তপাতের কারণে একদিন পর মারা যায় কোম্বা।’
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরে যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। ক্লডিয়া কাপ্পা বলেন, বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়ছে আর জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা খুব কঠিন কাজ। ক্লডিয়া বলেন, সব মহাদেশেই নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে, অন্যান্য দেশে পুরনো ঐতিহ্যের অভিবাসনের কারণে এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে এরপরও কিছু আশার বাণী শুনিয়েছেন গবেষকরা। তারা জানান, কিছু দেশে যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনা কমছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩০ বছরে লাইবেরিয়ায় ৪১ শতাংশ, বুরকিনা ফাসোতে ৩১ শতাংশ, কেনিয়াতে ৩০ শতাংশ এবং মিশরে ২৭ শতাংশ যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনা কমেছে।
২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ৫ হাজার ৪৮৪ জন নারী যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান