হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমার কবরের মাটিকে ছোঁয়ে আদর করে এসেছি। জিঞ্জেস করে এসেছি – তুই কি জানিস আমার মৃত্যুর সমন জারি হবে কবে? আধুনিক চিকিৎসা বলে দিতে পারে মানুষের জন্ম কবে হবে। কিন্তু কেউ জানে না গাঢ় অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে মৃত্যু কবে আসবে। সেই মৃত্যুর নীল নীল কষ্ঠের রংই বা কেমন হবে। এই সুন্দর রসে গন্ধে ভরপুর দুনিয়া ছাড়িয়া, কারো কি মরতে ইচ্ছে করে। না, মৃত্যুকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না, বরং আত্ম সমর্পন করতেই হবে।
১৯৯০ এ বাবাকে রেখে এসেছিলাম নয়ন জলে ভিজিয়ে। পাঁছ বছর পর মাকেও রেখে আসি বনানি গোড়স্থানে।সেই থেকে এতিম।বাবা ছোট বেলায় বলতো– আমার কালো মেয়েটিকে ডাক্তার বানাবো।না বাবা পারলাম না। পরিশ্রান্ত দেখলে মা বলতো-চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।হাঁ মা ঝিক ঝাক পথে হাঁটছি।তবে তোমার হাতের দুধ ভাতের মজা পাই না।তোমরা ঘুমাও। আমিও আসবো।
বনানী গোড়স্থানে ১৮ নং রোড়ে আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মো. ইমাম হোসেন ও শ্রদ্ধেয় মাতা আমেনা বেগম যথাক্রমে ১৮৩৮/৮২ ও ১৮৩৮/৮৩ নম্বরে পাশাপাশি দুইটি কবরে শুয়ে আছেন। আমি আত্মীয় স্বজন সবাইকে বলে রেখেছি, বাবার কবরে আমাকে দাফন করার জন্য। সেই কবেরের কথাই বলছি। পৃথিবীতে নারীর ঠিকানা না থাকলেও, এই কবরই হবে আমার শেষ ঠিকানা।
১ মে ২০২০ তারিখে চাকুরী থেকে অবসরে গিয়েছি। শরীরটা বেশী ভালো নয়।স্কয়ার হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলছে। মনটাও আগের মত নেই। মানসিক জোড়ও কমে এসেছে।নানা দুশ্চিন্তা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।মহামারী করোনা ২০২০ এর আতংকে সারা পৃথিবীর মানুষ মৃত্যু ভয়ে হায় হায় করছে। কে কখন মারা যায়,সেই ভয়ে ঘর বন্দি জীবন যাপন করছে। মাথায় রেখে হাত আমিও আতংকিত।
বনানি গোড়স্থানে ০৭ /১২/২০২০ তারিখে ছুটে গিয়েছিলাম, মা বাবার কবর জিয়ারত করতে। মুসলিম ধর্মে মেয়ে মানুষের কবর জিয়ারত করার উপর নিষেধ মানা আছে,। নারীরা কারো কবর জিয়ারত করবে, সেটা হারাম। এ কেমন তর নিয়ম জানি না। তবু আবেগের বশে ছুটে যাই, মা বাবার স্নেহ পরশ গায়ে মাখতে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে স্মরণ ডায়রী উল্টাই। কত মিস্টি মধুর, দুঃখ গাঁথা কথা মনে পড়ে। চাইলেও পারি না মুছে ফেলে দিতে। আল্লাহ র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। মনের অজান্তেই চোখে নেমে আসে পানির ঢল।
দুপুর ১টা, নিরিবিলি ছায়া ঢাকা পরিবেশ। কেউ কেউ কবরের পরিচর্যা করছে, কবরের উপরে ঘাস, ফুল গাছ লাগাছে, আগাছা পরিস্কার করে হুইল পাউডার দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে কবরের প্রাচীর। চুপচাপ নীরবতা। প্রায় সবগুলো কবরই নানা ডিজাইনের টাইলস দিয়ে বাঁধাই করে রেখেছে। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।রাতের আধাঁরে ফ্লাশ লাইটে চকচক করে। সর্বক্ষণ মৃতের আত্মীয় স্বজন এখানে আসে ও দোয়া পাঠ করে।
মা বাবার দুইটা কবর দুই হাতে জড়িয়ে ধরে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় বসে থাকলাম। মনে পড়ে মাকে কত বিরক্ত করেছি, বাবাকেও কম বিরক্ত করিনি। কত পরিশ্রম করেছেন, পেরেশানি হয়েছেন আমাদেরকে কাঙ্খিত লক্ষে্ পোঁছে দিতে। ব্যর্থ হননি। প্রত্যাশারও অধিক সফল অবস্থানে আমদেরকে রেখে গেছেন। বার বার হাত তুলে করি কৃজ্ঞতা জ্ঞাপন। আল্লাহ তুমি তাদের জান্নাত দান করো।
ভাবছি বসে– কবরের অন্ধকারে থাকবো কেমন করে। এর পর — কি হবে। মাথা ঘুরতে থাকে।গলা শুকিয়ে আসে। ইচ্ছে করে কবরের পাশে শুইয়ে থাকি। মরার আগেই মরে যাই। সমাজ তো বুড়ু মানুষ কে পছন্দ করে না। হাত পায়ে শক্তি কমে আসলে, সেই দুর্দিনে কে হবে সাহাযে্ ভরসা। ওল্ড হোমে যেতে হবে না তো?
বহু রতি মহারতি শুয়ে আছেন এখানে। সঙ্গে নিতে পারেননি সূঁই সূঁতা কিছুই। তারপরও সবাই কেন সুনাম, পদবি,খ্যাতি,অর্থের পেছনে দোড়ায়। নিজের স্বার্থে পরের মাথায় ভাঙ্গি কাঁঠাল। কেউ কেউ লুটপাট, দূনীতি,মারামারি, খূনাখুনিতে এগিয়ে দিয়ে রাখে হাত পা। একবারেও ভাবে না, এই দুনিয়া দুনিয়া নয়,আরো দুনিয়া আছে। সেখাবে জবাব দিহি করতে হবে। বিচার হবে দাড়ি পাল্লা ও হঞ্চি ফিতায় মেপে। সেই বিচারের মহান বিচারক আল্লাহ্ আমার। পারবে না কেউ ফাঁকি দিতে, চলবে না ছল চাতুরি।
ঐ গোড়স্থানে রয়েছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও তাঁর সহধর্মিনী আইভি রহমানের কবর। উভয়েই আমার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষের নিবেদিত আওয়ামী আদর্শের নেতা। আরো রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সমাধি। তিনিও সত সততা প্রতীক, জাতীয় নেতা সৈযদ নজরুল ইসলামের যোগ্য সন্তান। ১৯৭৫ এ ১৫ আগস্টে জাতির পিতার সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নিমর্ম ভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারে সদস্যসহ ১৮ জনের সমাধি।
মনে পড়ে পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের কবর কবিতার কথা। চমৎকার চিত্রশৈলী,রুপকল্প, গাঁথুনীর কৌশল। একদিকে রুমান্টিকতা, অন্য দিকে ব্যথা বেদনার করুন সুর ছড়িয়ে আছে কবিতার চরণে চরণে।যত বেদনার সুর থাকুক না কেন, পৃথিবী ছেড়ে যেতেই হবে। নতুনের জন্য ছেড়ে দিতে ঘর বিছানা। কেউ বলবে না কংক্রিট ওয়াল নির্মান করে, যেতে দেবোনা। সোনার কৌটায় লুকিয়ে রাখতে পারবে না। হায় এই দুনিয়া আমার না।
কবর নামা
যতই থাকি আরাম আয়েসে
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে
যেতে হবে, দুরে নয় সেদিন
থাকতে হবে মহা অন্ধকারে।
কেউ হবে না সঙ্গের সাথী
সেই ঘরের শুয়ার বিছানা
দরজা জানালা কেমন হবে
নাই তো কারো কিছু জানা।
বাবা গেলো সেই ঘরে গেলো মা
আমিও যাবো,যেতে হবে জানি
সে কবরের তালা চাবি খোঁজি
কবর নামার প্রহর দিন গুণি।।
সব শেষে –প্রশ্ন রেখে সেই কথাটি বার বার বলতে ইচ্ছে করে–
এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এতো যত্নে গড়িয়াছে সাঁই।
লেখকঃ উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।