‘পাখির রাজ্য’ কল্পনা করতে পছন্দ করেন? তবে, চোখ বুজুন। কল্পনা করুন। শীতের কুয়াশা সমৃদ্ধ ঘাসের চাদরে গরম এক কাপ কফি নিয়ে বসে আছেন। আপনার সামনে বেশ বড় একটা জলাশয়। সেখানে হাজার হাজার পাখি। ছোট পাখি, বড় পাখি, রং-বেরঙের পাখি। মাথার উপর দিয়ে সাঁই-সাঁই করে পাখি উড়ে যাচ্ছে। যেদিকে তাকাবেন শুধু পাখি আর পাখি। দু’কানে পাখিদের কলকাকলি। যার সুর ও শব্দ কান ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে প্রাণে। আপনি পরম সুখে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন তাদের মাঝে। আপনি আপন মনে পাখির মতো গেয়ে উঠছেন।
এবার চোখ খুলুন। আচ্ছা, আপনাকে যদি বলা হয়, আপনি যা কল্পনা করছেন সেটা কোনো কল্পনার বিষয় নয়। বরং খুবই বাস্তব, নিরেট সত্য। বোকা ভেবে হাসছেন? তবে শুনে রাখুন, এটি কল্পনা নয় বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এটিই। বিশ্বাস হচ্ছে না! না হলে একবার ঘুরে যান, দেখে যান, হৃদয় জুড়িয়ে যান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রকৃতির পুণ্যভূমি। বছরের ছয় ঋতুতে এটি ছয় রকমের রূপ ধারণ করে। তবে শীতকালে যেন সেটা বহুগুণ বেড়ে যায়। আর এ সৌন্দর্য বৃদ্ধির বড় অলংকার অতিথি পাখি। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে এখানে। তাদের আগমনে ক্যাম্পাস মুখর হয়ে ওঠে। তার সেই মুখরতা ও সৌন্দর্য নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। মুখরিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসের আশপাশও।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও হাজারো অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। অতিথি পাখির কলকাকলি, খুনসুটিতে মেতে উঠেছে সারা ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে হাসছে লাল শাপলা আর এর মাঝে জলকেলীতে ব্যস্ত পাখিরা। পাখিদের উচ্ছ্বাস ও দুরন্তপনা দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসছে পাখিপ্রেমীরা। তাদের উপস্থিতিতে ক্যাম্পাস যেন আরও উতলা।
ঢাকা থেকে বন্ধুদের নিয়ে পাখি দেখতে এসেছেন আলতাব হোসেন। অবাক দৃষ্টিতে পাখিদের জলকেলী দেখতে দেখা গেল তাকে। কেমন দেখছেন, প্রশ্ন করাতে চমকে উঠলেন যেন। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আচ্ছা এটা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি নাকি বার্ডস ইউনিভার্সিটি? এতটুকুন জায়গায় এত পাখি কীভাবে আসতে পারে!’
প্রতি বছরের সেপ্টেম্বরে-অক্টোবরে হিমালয়ের উত্তরে প্রচণ্ড শীতের প্রভাবে তুষারপাত হয়। শীত ও ভারী তুষারপাতে টিকতে না পেরে পরিযায়ী পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে পাড়ি জমায় এ দেশে। মূলত বাংলাদেশে অক্টোবরের শেষ থেকেই অতিথি পাখিদের আগমন। মার্চের শেষের দিকে গরম পড়তে শুরু করলে পাখিরা আবার ফিরতে শুরু করে আপন নীড়ে।
ক্যাম্পাসে দু’ধরনের পাখি দেখা যায়। এক ধরনের পাখি জলাশয়ে এবং অন্য ধরনের পাখি গাছের ডালে অবস্থান নেয়। এদের অধিকাংশই হাঁস জাতীয়। সচরাচর যেসব পাখি দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— জলময়ূর, ডুবুরী, খোঁপা ডুবুরী, ছোট পানকৌড়ি, বড় পানকৌড়ি, শামুকভাঙ্গা (শামুক খোলা), কালোকুট, কাদাখোঁচা (চ্যাগা), জলের কাদাখোঁচা পাখি, ছোট জিরিয়া, বাটান, চা পাখি, সবুজ পা, লাল পা পিও, লাল লতিফা (হটটিটি), গঙ্গা কবুতর, কাল মাখা গঙ্গা কবুতর লেঞ্জা, কুন্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, নীলশির, গ্যাডওয়াল, লালশির, পাতারি হাঁস, বামনীয়া, ভুটি হাঁস, কালো হাঁস, চখাচখি, বালি হাঁস, বড় সরালী, ছোট সরালী, রাজহাঁস, কানি বক, ধূসর বক, গো-বক, সাদা বক, ছোট বক, মাঝলা বক, কালিম (কায়েন) প্রভৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি লেকের মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, সুইমিংপুলের পাশের লেক, পরিবহন চত্বরের পাশের জলাশয় ও ডব্লিউআরসির ভেতরের জলাশয়ে পাখির আগমন ঘটে। এগুলোর মধ্যে ডব্লিউআরসির ভেতরের জলাশয়ে সবচেয়ে বেশি পাখির আনাগোনা দেখা যায়। এ জলাশয়গুলোকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে কমপক্ষে ৮০ প্রজাতির পাখির আগমন ঘটে। ১৯৮৮ সালে ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে প্রথম অতিথি পাখি আসে। প্রথম বছর ৩ প্রজাতির ৮৫০টি পাখি আসে। ১৯৯০ সালে অতিথি পাখির বিচরণ ঘটে সবচেয়ে বেশি। সে সময় পিন্টেল, নাকতা, কোবার্ড, গারাগানিসহ মোট দশ প্রজাতির ১০ হাজার ৫০০ পাখির সমাগম ঘটে।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পাখি গবেষক ড. মো. মোস্তফা ফিরোজ এ বিষয়ে বললেন, ‘অতিথি পাখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বের বিষয়। এত জায়গা থাকতে তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেই অস্থায়ী আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে পাখির সংখ্যা যাতে না কমে সেদিকে সবার নজর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে দর্শনার্থীদের। তারা ক্যাম্পাসে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করছেন। যত্রতত্র হর্ন বাজাচ্ছেন। এতে পাখিরা ভয় পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক-সময় পাখিরা আর এখানে নাও আসতে পারে। তাই পাখি দেখার সময় যেন পাখিরা ভীত না হয় এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্ রাখার জন্য দর্শনার্থীদের অনুরোধ করছি।’