দ্বিনি শিক্ষা মুসলিম সমাজের প্রাণশক্তির উৎস

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ জ্ঞানচর্চার সঙ্গে মুসলিম জাতির স্থায়ী সম্পর্ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ আয়াতগুলোয় আল্লাহ না বলেছেন বিশ্বাসের কথা, না তিনি ইসলামের অন্য কোনো মৌলিক বিষয় শিখিয়েছেন, না কোনো ইবাদতের আলোচনা করেছেন; এমনকি এসব আয়াতে প্রচলিত রীতি-নীতি ও মূর্খতার বিরুদ্ধাচরণও করা হয়নি। জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রথম যে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তা হলো ‘পড়ুন’। চিন্তাশীল মানুষের জন্য এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার, গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। উল্লেখিত আয়াতগুলোয় আল্লাহ মুমিনদের পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পাঠ ও আল্লাহর নামের সমন্বয় করার শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর দুর্ভাগ্য আজ জ্ঞানচর্চা থেকে স্রষ্টার নাম বিলুপ্ত হয়েছে। এই আধুনিকতার যুগে আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায় জ্ঞানচর্চায় স্রষ্টার নাম যুক্ত না থাকায় তা কিভাবে মূর্খতায় পরিণত হয়েছে, তা কিভাবে মানুষকে মনুষ্যত্ববিরোধী ও আত্মমুখী করে তুলছে।

পশ্চিমা বিশ্বেও বলতে শোনা যায়, জ্ঞান কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারছে না, মানুষের উপকারে আসছে না। এর কারণ হলো, জ্ঞানচর্চায় শুধু জ্ঞানই আছে, মহান স্রষ্টার নাম নেই, যা জ্ঞানের কল্যাণকর ব্যবহার নিশ্চিত করে। অথচ আল্লাহ জ্ঞানচর্চার সঙ্গে তাঁর নাম সংযুক্ত করেছিলেন। জ্ঞান যখন আল্লাহর নাম থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে অবাধ্য ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তা স্রষ্টা ও তাঁর অস্তিত্ব, মানবকল্যাণ ও মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তা সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অন্যায় ও অবিচারের মাধ্যম হয়। আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান ঠিক যেমন বৈরাগ্য, হিংস্রতা, রূঢ়তা ও আত্মপূজারি মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

মুসলমানের জীবন আবর্তিত হবে পাঠ ও আল্লাহর নামে পাঠের সঙ্গে। মুসলমান পাঠ গ্রহণ করবে আল্লাহ নামের ছায়ায়, তাঁর আনুগত্য ও পথনির্দেশ মোতাবেক। জ্ঞান মুসলিম জাতির জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, তার রুহ বা আত্মার মতো। শর্ত হলো তাতে মহান আল্লাহর নাম যুক্ত থাকতে হবে, তাঁর পথনির্দেশনা মোতাবেক হবে। হেরা পর্বতে প্রথম অবতীর্ণ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুসলিম জাতি কলম ব্যবহার করবে, কলমের মাধ্যমে মানুষকে পথ দেখাবে, কলমের মাধ্যমেই তারা সমাজের রোগব্যাধি ও অনাচার দূর করে মনুষ্যত্বের পথ উন্মুক্ত করবে। কলমের সর্বাধিক সঠিক চর্চা উম্মতি মুহাম্মদিই করবে। আর আল্লাহর নামযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন মাদরাসা বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাদরাসা মুসলিম জাতির সঞ্জীবনী শক্তি। মাদরাসা তাকে ইসলামের পথে অনুপ্রাণিত করে, ইসলাম বোঝার ও তার ওপর আমল করার উৎসাহ জোগায়। পাশাপাশি কালের বিবর্তন যে প্রশ্ন, যে সংকট, যে অপূর্ণতা ও যে পরীক্ষার মুখোমুখি করে তা থেকে উত্তরণের পথ দেখায় এসব মাদরাসা।

মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুসলিম জীবনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম জাতির জীবন-মরণ ও অস্তিত্বের প্রশ্ন। মাদরাসা মুসলিম সমাজের জন্য চিকিৎসালয়; বরং আমি বলব, মাদরাসা মুসলিম জাতির জন্য মেডিক্যাল কলেজের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেডিক্যাল কলেজে মানুষের শারীরিক চিকিৎসা হয়—আমি তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, কিন্তু পরকাল ও পরকালের অন্তহীন জীবন, মানুষের সুপথ লাভ ও পথভ্রষ্টতা, জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং জীবনের সার্থকতার প্রশ্ন সামনে এলে মাদরাসা মেডিক্যাল কলেজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী, এ জীবনের রোগব্যাধিও ক্ষণস্থায়ী। মাদরাসায় চিরস্থায়ী জীবনের চিকিৎসা ও পাথেয় মেলে। সেখানে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, অন্নদাতার সঙ্গে অন্নগ্রহীতার, অক্ষম-অপারগের সঙ্গে সর্বশক্তিমানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এবং এর মাধ্যমে মানুষ জীবনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারে। সুতরাং মানুষ যদি ন্যায়নিষ্ঠ হয়, সুষ্ঠু চিন্তার অধিকারী হয় এবং সে পক্ষপাতদুষ্ট না হয় তবে অবশ্যই মাদরাসার বিরোধী হবে না। উল্টো মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হবে।

মাদরাসা এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা মানুষের জীবন অর্থময় করে, তাদের ভেতর সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব তৈরি করে, যেখানে মানুষ উন্নয়ন, অগ্রগতি ও ন্যায়বিচারের অনুপ্রেরণা পায়; সর্বোপরি মাদরাসা মানুষের ভেতর আল্লাহভীতি তৈরি করে, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়, যেখানে মন্দ কাজ, অন্যকে কষ্ট দেওয়া ও মন্দ স্বভাব পরিহারের শিক্ষা দেওয়া হয়—এমন প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন মেডিক্যাল কলেজের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মানুষ চিরস্থায়ী ও প্রকৃত জীবন থেকে বিমুখ, তারা সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। ফলে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে ইসলামের চেতনা ও অনুপ্রেরণা স্তিমিত করতে চায়। ইউরোপ ও আমেরিকার বস্তুবাদী সভ্যতা ধ্বংসের পথে। তাই তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মুসলিম দেশগুলোতে মূলপন্থীদের (ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রেমী) নিঃশেষ করার আন্দোলন উসকে দিচ্ছে। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ঐশী শিক্ষা ও উপকারী জ্ঞানচর্চা অপরিহার্য, যা মানুষকে আত্মপূজারি হওয়ার পরিবর্তে আত্মত্যাগী হতে শেখায়।

শুধু মুসলিম জাতির জন্য নয়, দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরো দেশের জন্য কল্যাণের ধারক ও বাহক। দেশ ও জাতির বিকাশ তথা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তা প্রয়োজন—যদি দেশ মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ব দেখতে চায়, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পেতে চায়। কেননা কোনো দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি শুধু বস্তুগত উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় সাম্য ও ন্যায়, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার চর্চা। নিশ্চিত করতে হয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কল্যাণবহ অনুশীলন। নতুবা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাষ্ট্র পরিচালনার কলাকৌশল সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিপূজা ও উন্নয়নে ব্যয়িত হবে। (সংক্ষেপিত)

তামিরে হায়াত থেকে আবরার আব্দুল্লাহর ভাষান্তর

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর