ঢাকা ০৭:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:১০:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০২০
  • ২২২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনার নেতিবাচক প্রভাবে পুরো বিশ্বই এখন বিপর্যস্ত। বৈশ্বয়িক এ মহামারীর কারণে মানুষের মধ্যে যখন ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু তখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রে পশ্চাৎমুখী। করোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ধর্ষণ নামক ভয়াবহ ভাইরাস। এ অবস্থায় জাতি বিক্ষুব্ধ, লজ্জিত ও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। সিলেটের ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা শুভবুদ্ধির সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

দেশে যে শুধু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে তাই নয়; বরং এ কুকর্মের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে তা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সময়মতো এসব অপকর্মের প্রতিবাদ না করলে সবাইকেই এর কুফল ভোগ করতে হবে। বাস্তবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনা হারিয়ে ফেলেছি। অথচ দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস পোষণ করেন। এমন দেশে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে, তা বোধগম্য নয়। তবে কিছু মানুষ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদের আওয়াজ ক্ষীণ; অপ্রতুল। দেশে একাধিক কারণে ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানাবিধ অপরাধ ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এর বহুমাত্রিক কারণ বিদ্যমান। সেগুলো হলো-

১. পারিবারিক শিক্ষার অভাব : মা-বাবার জন্য সন্তানসন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র আমানত। শিশু জন্ম নেয়ার পর তার জন্য উত্তম নাম রাখা মা-বাবার দায়িত্ব। নাম সন্তানের চরিত্রে প্রভাব ফেলে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে অনুসরণ করে। পরিবার হলো সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্য-সদস্যা যেমন ভাইবোন নিকটাত্মীয়কেও উত্তম আচরণের অধিকারী হতে হবে। শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবন সর্বাবস্থায় ভালো সঙ্গ দিতে হবে। কথায় আছে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ অসৎ সঙ্গ। অশালীন আচরণ, নেশা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি অসৎ সঙ্গের প্রভাবে বেশি হচ্ছে। ছোটবেলা সন্তানকে থেকে শিক্ষা দিতে হবে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য, দায়িত্ব কর্তব্য কী। হৃদয়ে স্রষ্টার প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং তাঁকে ভয় করার শিক্ষা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বাবা-মা তাদের সামনে উত্তম আদর্শ হবেন। সন্তানের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ; যাতে সব বিষয়ে সন্তানরা মা-বাবার সাথে আলাপ করতে পারে।

২. সমাজে উত্তম নীতি ও আদর্শের মূল্যায়ন না থাকা : সমাজে যারা সৎ, জ্ঞানী, উন্নত চরিত্রের অধিকারী তাদের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা এবং মূল্যায়ন না করায় অসৎ লোকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অসততার সয়লাব। এ থাবা থেকে রাজনীতিবিদ, সমাজপতি, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ কেউ বাদ নেই। জনগণের বিপুল অর্থ আজ তাদের আয়ত্তে। বাহ্যিকভাবে আমরা যতই নিজেদের সুফি বা দরবেশ হিসেবে উপস্থাপন করি না কেন, তা শুধু লোকদেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

৩. নারীর মর্যাদা ও সম্মান লুণ্ঠিত করে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার : নারীকে আজ সেবাদাসী, ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। নারীদেহকে অশ্লীল, অশালীনভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এতে পুরুষের কামভাব ও যৌন আবেদন সৃষ্টি হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির লাগামহীন ছড়াছড়িতে যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের কিছু পদ যেমন রিসিপশনিস্ট, এয়ারহোস্টেস, অফিসের বসের পিএস নির্ধারণে অবশ্যই অবিবাহিত সুন্দরী স্মার্ট মেয়েদের নিয়োগ দেয়া হয়।

৪. ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ও সিনেমায় অশ্লীলতা : দেশে ঠাণ্ডা মাথায় অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যেন অশ্লীলতার সাধারণীকরণ চলছে। পার্টি, নাইটক্লাবে থার্টিফার্স্ট নাইট, ভালোবাসা দিবস উদযাপন উচ্ছৃঙ্খলতার এক নগ্ন রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেখানে নারী-পুরুষ তথা যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশা ধর্ষণকে উসকে দিচ্ছে। অথচ আল কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা যেনা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না।’

৫. নারীর নিরাপত্তার অভাব : নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা এর কারণ। অনেক ক্ষেত্রে রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ওপরে আস্থায় চির ধরেছে। ভিকটিম কোনো নারী এখন থানায় যেতে ভয় পান; কারণ সেখানে ফের ভিকটিম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেই এমন অবস্থা।

৬. বিয়ে কঠিন হওয়া এবং বিবাহবহির্ভূত অনৈতিকতা : যুবসমাজের বেকারত্ব¡, যৌতুকের বোঝা, নারী-পুরুষের অবাধ অনৈতিক সম্পর্ক সামাজিকভাবে বিয়েকে কঠিন করে তুলেছে। পারিবারিক দায়িত্ব কাঁধে না নেয়ার মানসিকতা যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে। পরিণত বয়সে সন্তানদের বিয়ে দিতে অভিভাবকের উদাসীনতাও অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনকেও বিয়েশাদির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

৭. বিচারহীনতার সংস্কৃতি : যারা নারী নির্যাতন, ধর্ষণ করছে; তারা কিছুই পরওয়া করে না। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার পরও ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জামিন পেয়ে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে সমাজের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্যায় করছে। এতে কিছুটা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়া ভূমিকা রাখছে।

নারী নির্যাতন তথা সামাজিক নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে করণীয় :
১. উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ নৈতিক শিক্ষা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ : এ শিক্ষা হতে হবে শিশু বয়স থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত। শিক্ষার শুরু হবে পরিবার থেকে। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হবেন বাবা, মা, বড় ভাই, বোন নিকটাত্মীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই ভালো ও আদর্শ স্কুল ঠিক করতে হবে। যেসব স্কুল আধুনিক শিক্ষার নামে সর্বজনীন শালীনতা শেখানো হয় না; সেসব স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। স্কুল-কলেজের ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে হবে। কর্মস্থলে, অফিস আদালতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনামাফিক কিছু সময়ের জন্য নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টি করতে হবে। কালামে পাকে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা সৎ ও ন্যায্য কাজের আদেশ দিবে; অন্যায় ও অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।’

২. অন্যায়ের প্রতিবাদ করা : অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে শক্তি দিয়ে, কথা দিয়ে, যদি তাও সম্ভব না হয় তবে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। সামাজিকভাবে অন্যায়কারীকে বয়কট করতে হবে। কোনো মা-বাবার সন্তান যদি ধর্ষণকারী হয়; অবশ্যই মা-বাবার দায়িত্ব কুসন্তানকে আইনের হাতে তুলে দেয়া। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
৩. আলেমদের সোচ্চার হওয়া : সমাজের মানুষের মাঝে নৈতিক শিক্ষার দায়িত্ব বিশেষভাবে আলেম সমাজের ওপর বর্তায়। মসজিদের ইমামকে অবশ্যই ইসলামের সঠিক ধারণার অধিকারী হতে হবে। নামাজের আগে বা পড়ে সামজিক অবক্ষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে খুতবায় আলোচনা করতে হবে।

৪. পুলিশ প্রশাসনকে মজবুত নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। রক্ষককে ভক্ষক হলে চলবে না। নারীর সম্মান রক্ষার্থে তাদের আন্তরিক হতে হবে। সৎ ও ত্যাগী পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার কার্যকর ব্যবস্থা এবং অনৈতিক পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. গণমাধ্যমকে সত্য প্রকাশ করে অন্যায়কারীর মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়ে বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

ধর্ষণ তথা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা : ধর্ষকের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ছয় মাসের মাধ্যে রায় চূড়ান্ত করতে হবে। আইন সব পর্যায়ে জামিন অযোগ্য হতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে সর্বস্তরের সিলেবাসে বাধ্যতামূূলক করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মস্থলে নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি থাকতে হবে। সব ধরনের অশ্লীল পত্রিকা, সাহিত্য, ভিডিও প্রচারণা বন্ধ করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখিকা : সেক্রেটারি, নারী অধিকার আন্দোলন

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়

আপডেট টাইম : ০৯:১০:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনার নেতিবাচক প্রভাবে পুরো বিশ্বই এখন বিপর্যস্ত। বৈশ্বয়িক এ মহামারীর কারণে মানুষের মধ্যে যখন ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু তখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রে পশ্চাৎমুখী। করোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ধর্ষণ নামক ভয়াবহ ভাইরাস। এ অবস্থায় জাতি বিক্ষুব্ধ, লজ্জিত ও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। সিলেটের ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা শুভবুদ্ধির সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

দেশে যে শুধু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে তাই নয়; বরং এ কুকর্মের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে তা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সময়মতো এসব অপকর্মের প্রতিবাদ না করলে সবাইকেই এর কুফল ভোগ করতে হবে। বাস্তবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনা হারিয়ে ফেলেছি। অথচ দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস পোষণ করেন। এমন দেশে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে, তা বোধগম্য নয়। তবে কিছু মানুষ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদের আওয়াজ ক্ষীণ; অপ্রতুল। দেশে একাধিক কারণে ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানাবিধ অপরাধ ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এর বহুমাত্রিক কারণ বিদ্যমান। সেগুলো হলো-

১. পারিবারিক শিক্ষার অভাব : মা-বাবার জন্য সন্তানসন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র আমানত। শিশু জন্ম নেয়ার পর তার জন্য উত্তম নাম রাখা মা-বাবার দায়িত্ব। নাম সন্তানের চরিত্রে প্রভাব ফেলে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে অনুসরণ করে। পরিবার হলো সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্য-সদস্যা যেমন ভাইবোন নিকটাত্মীয়কেও উত্তম আচরণের অধিকারী হতে হবে। শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবন সর্বাবস্থায় ভালো সঙ্গ দিতে হবে। কথায় আছে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ অসৎ সঙ্গ। অশালীন আচরণ, নেশা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি অসৎ সঙ্গের প্রভাবে বেশি হচ্ছে। ছোটবেলা সন্তানকে থেকে শিক্ষা দিতে হবে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য, দায়িত্ব কর্তব্য কী। হৃদয়ে স্রষ্টার প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং তাঁকে ভয় করার শিক্ষা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বাবা-মা তাদের সামনে উত্তম আদর্শ হবেন। সন্তানের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ; যাতে সব বিষয়ে সন্তানরা মা-বাবার সাথে আলাপ করতে পারে।

২. সমাজে উত্তম নীতি ও আদর্শের মূল্যায়ন না থাকা : সমাজে যারা সৎ, জ্ঞানী, উন্নত চরিত্রের অধিকারী তাদের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা এবং মূল্যায়ন না করায় অসৎ লোকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অসততার সয়লাব। এ থাবা থেকে রাজনীতিবিদ, সমাজপতি, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ কেউ বাদ নেই। জনগণের বিপুল অর্থ আজ তাদের আয়ত্তে। বাহ্যিকভাবে আমরা যতই নিজেদের সুফি বা দরবেশ হিসেবে উপস্থাপন করি না কেন, তা শুধু লোকদেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

৩. নারীর মর্যাদা ও সম্মান লুণ্ঠিত করে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার : নারীকে আজ সেবাদাসী, ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। নারীদেহকে অশ্লীল, অশালীনভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এতে পুরুষের কামভাব ও যৌন আবেদন সৃষ্টি হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির লাগামহীন ছড়াছড়িতে যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের কিছু পদ যেমন রিসিপশনিস্ট, এয়ারহোস্টেস, অফিসের বসের পিএস নির্ধারণে অবশ্যই অবিবাহিত সুন্দরী স্মার্ট মেয়েদের নিয়োগ দেয়া হয়।

৪. ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ও সিনেমায় অশ্লীলতা : দেশে ঠাণ্ডা মাথায় অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যেন অশ্লীলতার সাধারণীকরণ চলছে। পার্টি, নাইটক্লাবে থার্টিফার্স্ট নাইট, ভালোবাসা দিবস উদযাপন উচ্ছৃঙ্খলতার এক নগ্ন রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেখানে নারী-পুরুষ তথা যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশা ধর্ষণকে উসকে দিচ্ছে। অথচ আল কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা যেনা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না।’

৫. নারীর নিরাপত্তার অভাব : নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা এর কারণ। অনেক ক্ষেত্রে রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ওপরে আস্থায় চির ধরেছে। ভিকটিম কোনো নারী এখন থানায় যেতে ভয় পান; কারণ সেখানে ফের ভিকটিম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেই এমন অবস্থা।

৬. বিয়ে কঠিন হওয়া এবং বিবাহবহির্ভূত অনৈতিকতা : যুবসমাজের বেকারত্ব¡, যৌতুকের বোঝা, নারী-পুরুষের অবাধ অনৈতিক সম্পর্ক সামাজিকভাবে বিয়েকে কঠিন করে তুলেছে। পারিবারিক দায়িত্ব কাঁধে না নেয়ার মানসিকতা যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে। পরিণত বয়সে সন্তানদের বিয়ে দিতে অভিভাবকের উদাসীনতাও অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনকেও বিয়েশাদির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

৭. বিচারহীনতার সংস্কৃতি : যারা নারী নির্যাতন, ধর্ষণ করছে; তারা কিছুই পরওয়া করে না। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার পরও ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জামিন পেয়ে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে সমাজের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্যায় করছে। এতে কিছুটা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়া ভূমিকা রাখছে।

নারী নির্যাতন তথা সামাজিক নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে করণীয় :
১. উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ নৈতিক শিক্ষা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ : এ শিক্ষা হতে হবে শিশু বয়স থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত। শিক্ষার শুরু হবে পরিবার থেকে। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হবেন বাবা, মা, বড় ভাই, বোন নিকটাত্মীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই ভালো ও আদর্শ স্কুল ঠিক করতে হবে। যেসব স্কুল আধুনিক শিক্ষার নামে সর্বজনীন শালীনতা শেখানো হয় না; সেসব স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। স্কুল-কলেজের ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে হবে। কর্মস্থলে, অফিস আদালতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনামাফিক কিছু সময়ের জন্য নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টি করতে হবে। কালামে পাকে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা সৎ ও ন্যায্য কাজের আদেশ দিবে; অন্যায় ও অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।’

২. অন্যায়ের প্রতিবাদ করা : অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে শক্তি দিয়ে, কথা দিয়ে, যদি তাও সম্ভব না হয় তবে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। সামাজিকভাবে অন্যায়কারীকে বয়কট করতে হবে। কোনো মা-বাবার সন্তান যদি ধর্ষণকারী হয়; অবশ্যই মা-বাবার দায়িত্ব কুসন্তানকে আইনের হাতে তুলে দেয়া। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
৩. আলেমদের সোচ্চার হওয়া : সমাজের মানুষের মাঝে নৈতিক শিক্ষার দায়িত্ব বিশেষভাবে আলেম সমাজের ওপর বর্তায়। মসজিদের ইমামকে অবশ্যই ইসলামের সঠিক ধারণার অধিকারী হতে হবে। নামাজের আগে বা পড়ে সামজিক অবক্ষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে খুতবায় আলোচনা করতে হবে।

৪. পুলিশ প্রশাসনকে মজবুত নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। রক্ষককে ভক্ষক হলে চলবে না। নারীর সম্মান রক্ষার্থে তাদের আন্তরিক হতে হবে। সৎ ও ত্যাগী পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার কার্যকর ব্যবস্থা এবং অনৈতিক পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. গণমাধ্যমকে সত্য প্রকাশ করে অন্যায়কারীর মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়ে বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

ধর্ষণ তথা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা : ধর্ষকের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ছয় মাসের মাধ্যে রায় চূড়ান্ত করতে হবে। আইন সব পর্যায়ে জামিন অযোগ্য হতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে সর্বস্তরের সিলেবাসে বাধ্যতামূূলক করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মস্থলে নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি থাকতে হবে। সব ধরনের অশ্লীল পত্রিকা, সাহিত্য, ভিডিও প্রচারণা বন্ধ করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখিকা : সেক্রেটারি, নারী অধিকার আন্দোলন