হাওর বার্তা ডেস্কঃ টাংগুয়া প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের নাম। এটিকে বলা হয় সৌন্দর্যের জলকন্যাও। টাংগুয়ার হাওর কতটা সুন্দর তা লিখে বা মুখে বলে বোঝানো মুশকিল। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মধ্যে প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঘন নীল জলরাশি নিয়ে শুয়ে আছে টাংগুয়ার হাওর। হাওর ও তার জলরাশি যেন প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে অপার মহিমায়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি এটি। হাওরের সৌন্দর্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতের মেঘালয় পাহাড়।
মেঘালয় থেকে হাওরে নেমে এসেছে ত্রিশটিরও বেশি ঝরনা। মূল হাওর অবশ্য ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। বাকি অংশে আছে কিছু গ্রাম ও কৃষিজমি। বর্ষাকালে পুরোটাজুড়ে বিশাল হাওরে এবং গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়। এ সময়ে হাওরে প্রবেশ করলে অথৈ পানি, জলাবন, নীল আকাশ ও পাহাড় ঘেরা অপরুপ সৌন্দর্য শুধু আপনার চোখই জুড়াবে না, শীতল করবে মনকেও।
দেশের বৃহত্তম এ বিশাল হাওরের কথা হয়তো শুনে থাকবেন। যেখানে আনাগোনা করে শ্রাবণের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সে মেঘ কখনো কখনো জমাট-আবার কখনো হালকা বাতাসে দলছুট হয়ে পাগলা ঘোড়ার মত উত্তরে দাঁড়ানো আকাশছোঁয়া বিশাল খাসিয়া পাহাড়ে গিয়ে আঁছড়ে পড়ছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পাহাড় ও হাওরের জলরাশি তার নিচে জলজ উদ্ভিদ দেখতে হাজারো পর্যটক ছুটে চলেছেন, ঘুরছেন টাংগুয়ায়। টাংগুয়ায় বর্ষায় এক রূপ, শীতে অন্যরূপ। এই ভরা বর্ষায় হাওরের নীল পানিতে অর্ধডোবা হিজল-করছ গাছের পরশে কেউবা নৌকায়, কেউবা স্পিডবোটে ঘুরছেন আপন মনে বৃক্ষলতার সঙ্গে মিতালী করতে করতে।
বর্ষায় বিশাল হাওরে সাগরের মত ঢেউ; শীতকালে কুয়াশা ঢাকা প্রান্তরে অতিথি পাখির কলকাকলী; এক নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের আবির্ভাব ঘটে। হাওরটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বকোণে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা জুড়ে। উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। হাওরটির আয়তন প্রায় ৪ হাজার একরের মত। বর্ষাকালে এর আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার একরের বেশি। শীত যত বাড়ে অতিথি পাখির আগমনও বাড়ে।
সুনামগঞ্জ এসে আপনি আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে পাবেন, আর সেটি হল হাসন রাজার বাড়ি। তবে এই বাড়ি দেখতে হলে আপনাকে রাতে সুনামগঞ্জ এক রাত কাটাতে হবে। আর এছাড়াও রাতের বেলা সুরমা নদীর অপরূপ দৃশ্যও দেখে নিতে পারেন। নদীর এই দৃশ্য দেখে পরদিন সকালে হাছন রাজার বাড়ী দর্শন করে চলে আসুন আবদুজ জুহুর সেতুতে। সেখান থেকে আপনি আপনার পছন্দমত বাহনে করে চলে যান তাহিরপুর, সময় লাগবে কম বেশি দুই ঘন্টা। যেতে পথে আপনি দেখতে পাবেন শাহ আরেফিনের মাজার, বারেকেরটিলা, যাদু কাটা নদী, লাউরের গর, ইন্ডিয়ার বর্ডার সংলগ্ন অপরূপ কিছু ঝর্না।
হাওরের এসব সৌন্দর্য দেখতে আমরা ১০-১২ জন সহকর্মী-বন্ধু সম্প্রতি গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের টাংগুয়ায়। রাত ১০ টার বাসে করে আমরা ভোর ৬টায় গিয়ে পৌঁছলাম সুরমা পারে। এরপর সিএনজি করে তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। খানাখন্দকে ভড়া ভাঙা রাস্তায় যেতে খানিকটা কষ্টই হচ্ছিলো। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার প্রয়াসে সে কষ্ট আমাদের ছুঁতে পারেনি। তাহির উপজেলায় পৌঁছে নাস্তা সেরে ট্রলারে উঠলাম। প্রতিকূল আবহাওয়ায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলেছি হাওরের প্রথম আকর্ষণ ওয়াচ টাওয়ারে। ইতিমধ্যেই আমরা হাওরে প্রবেশ করেছি। ১০-১৫ মিনিট পরেই আমরা ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পেলাম। টাওয়ার থেকে পুরো হাওর আমরা এক নজরে দেখে নিলাম। টাওয়ারে নিচেই সচ্ছ পানি সাথে ছোট-বড় বিভিন্ন গাছগাছালি। এটাকে ছোট একটি সোয়াম ফরেস্ট বলাই যেতে পারে। এখানে এসেই ভ্রমণপিপাসুরা মেতে উঠেন জলকেলিতে। আমরাও নিজেদের আর ধরে রাখতে পারলাম না। একই সঙ্গে আমরা গসলটাও সেরে নিলাম এখান থেকেই। এরমধ্যেই দুপুর হয়ে এলো। তাই নৌকায় বসেই সবাই মিলে দুপুরের খাবারও সেরে ফেললাম। হাওরের ৫ কেজি ওজনের রুই আমাদের জন্য রান্না করে রেখেছিলেন আমাদের মাঝির। বেশ স্বাদেই খেলাম, একটু আলাদা; হাওরের মাছ বলে কথা।
যাই হোক; এরপর আমাদের যাত্রা হাওরের অন্যতম আকর্ষণ নীলাদ্রি লেক ও টেকের ঘাটে। এখানে না এলে আপনার ভ্রমণটি অপরিপূর্ণ থেকে যাবে। ভারতের মেঘালয় ঘেসে এই লেকের অবস্থান। উপরে সবুজ পাহার নিচে সচ্ছ পানি এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করেছে। সারা দিন টাংগুয়ার হাওরের বুকে ঘোরাফেরার পর, নীলাদ্রির নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত আপনার স্মৃতির পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রতি বছর বিশেষ করে পূর্নিমা রাতে নীলাদ্রি লেকে পর্যটকরা ভিড় করে থাকেন শুধু পূর্ণ জোসনা উপভোগ করার জন্য। গভীর রাতে পূর্ণ চাঁদের আলোর ঝলকানি আর অথৈ জলরাশি যেন অনেকদিন বাদে প্রেম-মিলনের চমকপ্রদ দৃশ্য। এ দৃশ্য সত্যিই আপনার মনকে শুধু শীতলই করবে না সাথে স্বর্গীয় সুখানুভুতি যোগ করবে। তাইতো থেকে থেকে বেজে উঠছে হৃদয় স্পর্ষ করা গানও। এভাবে গান-আড্ডায় ট্রলারের মধ্যেই আমাদের সারা রাত কাটলো।শুধু আমরা ছিলাম না! অন্তত ৯০ থেকে ১০০টি ট্রলার সারা রাত ভাসমান অবস্থায় কাটিয়েছে। এ রাতে কিযে দৃশ্যের অবতারণা করেছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
পরদিন সকালে একটু প্রাতভ্রমণে বের হলাম নীলাদ্রি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থান লাকমাছড়ায়। এখানকার পাহাড়ি ঝর্নায় ঠান্ডা পানির শ্রোত আপনাকে কিছুটা হলেও শীতল করবে। অনেকে এটিকে মিনি বিছনাকান্দি বলে থাকেন। আমাদের পরবর্তী যাত্রা হাওরের আকেটি র্আর্ষণীয় স্থান যাদুকাটা নদী। তাই সেখান থেকে দ্রুতই ট্রলারে ফিরে এলাম। এবার যাত্রা যাদুকাটা নদী। নদীতো বটেই সাথে এখানকার পাহাড় আর মেঘের খেলা যেন আরেকটি সাজেক। মালেকের টিলায় উঠে আকাশ-পাহাড়ের সেই চুম্বন দৃশ্য সরাসরি না দেখলে চরম মিস করবেন। আমরা তা উপভোগ করে নদীতেই গসল সেরে ফেললাম। এর পাশেই রয়েছে শিমুল বাগান। আমরা সেটাও মিস না করে অল্প সময় নিয়ে দেখে ফেললাম। কারণ আজই আমাদের ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরতে হবে। কিন্তু এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছেড়ে সত্যিই ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। অবশেষে আমরা মন ভার করে রওনা করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
পরিশেষে একটু বলতে হয়- হাওরের এসব স্যৌন্দর্য বর্তমানে প্রচুর ভ্রমণপিপাসুদের নজড় কেড়েছে। তাই প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসছেন হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। তবে কিছু কারণে হওরের সৌন্দর্য ও পরিবেশ বিপন্নও হচ্ছে। যত্রতত্র প্লাস্টক ও ময়লা ফেলার কারণে হাওরের পানি দূষিত হচ্ছে। এছাড়া রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভালো না। পরিবেশগত দিক ও সেই সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে টাঙ্গুয়ার মতো সিলেটের আরো অনেক পর্যটন এলাকা দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য বিপুল সম্ভাবনা বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বন্ধুবর আব্দুল্লাহ আল নাঈম আমাকে এমনটাই জানালেন। তারমতে, এতো সুন্দর একটি স্থান এটি, সেই তুলনায় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। রাস্তাঘাট ভালো হলে এখানে দেশি-বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। এতে দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অপার সম্ভাবনা বয়ে আনতে পারে।