ঢাকা ০৮:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাতলার শাপলা বিল: বিস্তৃত লাল গালিচার নিরব কান্না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৪২:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • ১৯৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিবছর সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস আসলেই ফেসবুকে টাইমলাইন জুড়েই থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শাপলার বিল আর পদ্মবিলের ছবি। এসব দেখে মনটা হুহু করে ওঠে। কবে যাবো সেই লাল চাদরের বিলে। কিন্তু যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয় না। এ মাসে সেই স্থিরতা কাটিয়ে দিল আকাশের জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার চাঁদ। একদিকে ঝলসানো রুটির মত স্বচ্ছ পূর্ণিমার চাঁদ অন্যদিকে সপ্তাহান্ত। একেবারে সোনায় সোহাগা। অভিযাত্রীর কয়েকজনকে নক করে বললাম ভরা পূর্ণিমায় জলে ভেসে কোথাও যাওয়া যায় কিনা। অনেকের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হল লঞ্চে ভেসে ভেসে জীবনানন্দের ভূমি বরিশালে যাওয়ার। সিদ্ধান্ত মতোই কাজ।

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাত নয়টার সুন্দরবন-১১ লঞ্চে আমরা আট অভিযাত্রীর দল উঠে পরলাম। সারারাত চাঁদের মাদকতা আর জলের কলকাকলিতে একাকার হয়ে গেল গান-গল্প,আড্ডা। চোখের পলকেই চাঁদটা যেন একদিক থেকে আরেকদিকে হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উন্মুক্ত খোলা আকাশে রহস্যের জট পাকিয়ে চাঁদের বুক দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দুরন্ত মেঘদল। আহা, বিস্তুত জলরাশির বুকে সোনালি চাদের আভা তার চাকচিক্য দিয়ে অদ্ভুত এক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। হঠাৎই মনে হল, স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে চাদের এই অপার্থিব রূপ দেখেই তো একটি জন্ম কাটিয়ে দেয়া যায়। বৃথা কেন জীবনের এই ব্যস্ততা! পৃথিবীর এই রূপ পেছনে ফেলে কিসের মোহে ছুটে চলা যান্ত্রিক জীবনের পথে। হায় দীনতায় ভরা মানব জীবন!!

যাই হোক, প্রশান্তিময় চন্দ্রাভিযান শেষে ভোরবেলা বরিশাল শহরে পা রাখতেই শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভুত হল। যে শিহরণ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় পথে প্রান্তরে, একাকীত্বে কিংবা অনেকের মাঝে। বলছি, জীবনানন্দভূতির কথা। এই মাটি যে আমার জীবন কবির জন্মস্থান। তাই তো এত আপনার মনে হচ্ছে। মনটা ছটফট করছে, কখন যাবো জীবনানন্দের সেই নিবাসে।

ভাবতে ভাবতে গ্রুপ থেকে সিদ্ধান্ত হল যেহেতু এখনও ভোর। তাই উজিরপুরের লাল শাপলার সেই বিলে যাওয়া যাক। হাতে সময়ও অফুরন্ত। ভাবামতোই কাজ। লঞ্চঘাট থেকে ৪০০ টাকায় একটি অটো গাড়ি ভাড়া করা হল। সেটি আমাদের নিয়ে যাবে বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামে। ভোরবেলা আমাদের অটো ছুটছে পিচঢালা বিস্তৃত রাজপথ দিয়ে। পথের দুপাশের বয়সী গাছের ডালে তখন পড়েছে ভোরের প্রথম আলো। রোদের লাল আভায় সবুজ পাতাগুলো কমলাবর্ণ ধারণ করেছে। আহা, প্রকৃতির এই রূপই তো জীবনানন্দকে শুদ্ধতম কবি হিসেবে গড়ে তুলেছে। অটো চলছে। উজিরপুরে পৌঁছে যতোই সামনে এগুচ্ছি ততোই চোখে পড়ছে একটা পর একটা শাপলার বিল। বিলগুলোকে ঘিরে বাহারী নৌকা নিয়ে বসে আছে মাঝিরা। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় পর্যটক বেশ চোখে পরার মত।

ছুটতে ছুটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই সাতলা গ্রামে। বড় সাইনবোর্ডে লেখা সাতলা বিল। বাহাড়ি রঙের কাগজ দিয়ে নৌকা সাজিয়ে পর্যটকদের ডাকছে মাঝিরা। লাল শাপলার টানে সকাল সকাল দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন বয়সের প্রকৃতিপ্রেমি ও ভ্রমণপিপাশুরা। অটো থেকে নেমে বিলে ঘোরার জন্য নৌকা ঠিক করতে গিয়ে দেখি আকাশচুম্বী ভাড়া চাচ্ছে। আসলে শাপলা দেখতে পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত ভীড় করায় বেপরোয়াাভাবে নৌকা ভাড়া বাড়ায় মাঝিরা। এসব দিকে প্রশাসনেরও কোন দৃষ্টি নেই। দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এসে যখন অতিরিক্ত দামে নৌকা ভাড়া করে বিলে ঘোরে তখন আর শাপলাগুলোর প্রতি তারা খুব একটা মায়া দেখাতে পারে না। ছিঁড়ে ছুটে নিয়ে যায় জাতীয় ফুলকে।

তাদেরকে পাত্তা না নিয়ে আমরা এগুলাম আরেকটিু সামনে। ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে বিলের ধারের একটি পাড়ায় গেলাম আমরা। বিলের পাশে বাড়ি হওয়ায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই ঘাস কাটার জন্য ছোট ছোট নৌকা আছে। তাদের কাছ থেকেই দুটো নৌকা নিয়ে আমরা চারজন করে উঠে পড়লাম। ভাড়াও কম পড়ল, নতুন একটি পরিবারের সাথে সখ্যতাও হল। ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। বিলের শাপলাও কমে যেতে শুরু করেছে। আসলে শাপলা দেখার মোক্ষম সময় ভোরবেলা, রোদ ওঠার আগে। রোদ যতোই বাড়বে ততোই মিইয়ে যেতে থাকে শাপলা। ছোট্ট ডিঙি নৌকা ভাসছে থোকা থোকা লাল শাপলার বুক ছুয়ে ছুয়ে। বিস্তৃত বিলভরা আরো অসংখ্য নৌকা। পর্যটকেরা ঘুরছে। ছবি তুলছে নানান ঢঙে। আর মনের সুখে ছবি তোলার জন্য বিল থেকে শুষে নিচ্ছে থোকা থোকা লাল শাপলা। শাপলা তুলে তুলে বিলকে প্রায় শূন্য করে দিয়ে যাচ্ছেন ভ্রমণকারীরাই। বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যে রূপের টানে এতদূর পথ পাড়ি দেয়া , সুধা মিটিয়ে সেই রূপ আহরণ করে তকে রিক্ত করে দিয়ে ফেলে যাওয়া কোন ধরনের স্বভাব? প্রতিদিনই এভাবে হাজার হাজার শাপলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পর্যটকরে হাতে। আবার নৌকাওয়ালারাও কম যান না। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তারাও শত শত শাপলা তুলে নৌকা সাজান।

আসলে লোকমুখে শুনে এবং ফেসবুকে ছবি দেখে অনেক আগ্রহ জন্মেছিল সাতলার শাপলা বিল দেখার। কিন্তু বাস্তবে এর জীর্ণতা দেখে কষ্ট হয়েছে খুব। মানুষ আপন হাতে প্রতিদিনই বিনষ্ট করছে প্রকৃতি দেবীর এই অমূল্য উপহারকে। প্রত্যেকটা নৌকার পর্যটকরাই মনের আনন্দে শাপলা তুলে ফেলে দেয়। একবারও ভাবে না এভাবে ফুল তুলে নিলে অন্য পর্যটকেরা যারা শাপলার এই বিস্তুত লাল গালিচা দেখতে দূরদুরান্ত থেকে আসছে তারা কি দেখবে। প্রকৃতি অকৃপণভাবে আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা সুধা মিটিয়ে অবহেলায় ছিড়ে ফেলে বড় বড় ক্ষত তৈরী করছি অপরূপ এই লাল গালিচার বুকে।

যতক্ষণ বিলে ছিলাম ততক্ষণে যেন শাপলার এই দুঃখ-যন্ত্রণা টের পেয়েছি। যেভাবে প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা প্রায় ২০০ একরের এই বিলের শাপলার চাদর ক্ষত হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করে। যে বিল দেখতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য পর্যটক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাতলায় আসে, সেই বিল রক্ষণাবেক্ষণে প্রশাসনেরও নেই পর্যাপ্ত নজরদারি। প্রতিদিনই ভোরের লাল আলো ফুটতে ফুটতেই ক্ষত বিক্ষত হওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে সাতলার এই শাপলা বিল। নিঃস্ব বিলের বুকে একাকী হওয়ার আর্তনাদ করে একটা দুটো লাল শাপলা, আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা।

প্রকৃতির এই অকৃত্তিম উপহারকে রক্ষা করা এখন স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন ও পর্যটকদের দায়িত্ব। সাতলা ইউনিয়নের কালবিলা গ্রামে প্রাকৃতিকভাবেই এই শাপলার অবারিত রঙ্গিন রূপে মুগ্ধ হতে হলে এখনই বন্ধ করতে হবে ফুল ছেঁড়া। আগাছা আর লতা পাতায় ভরা বিলে ফুটন্ত কোটি কোটি লাল শাপলা সত্যিই সত্যিই সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ভরে থাকুক জীবনানন্দের ভূমি বরিশালের বুকে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাতলার শাপলা বিল: বিস্তৃত লাল গালিচার নিরব কান্না

আপডেট টাইম : ০৩:৪২:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিবছর সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস আসলেই ফেসবুকে টাইমলাইন জুড়েই থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শাপলার বিল আর পদ্মবিলের ছবি। এসব দেখে মনটা হুহু করে ওঠে। কবে যাবো সেই লাল চাদরের বিলে। কিন্তু যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয় না। এ মাসে সেই স্থিরতা কাটিয়ে দিল আকাশের জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার চাঁদ। একদিকে ঝলসানো রুটির মত স্বচ্ছ পূর্ণিমার চাঁদ অন্যদিকে সপ্তাহান্ত। একেবারে সোনায় সোহাগা। অভিযাত্রীর কয়েকজনকে নক করে বললাম ভরা পূর্ণিমায় জলে ভেসে কোথাও যাওয়া যায় কিনা। অনেকের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হল লঞ্চে ভেসে ভেসে জীবনানন্দের ভূমি বরিশালে যাওয়ার। সিদ্ধান্ত মতোই কাজ।

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাত নয়টার সুন্দরবন-১১ লঞ্চে আমরা আট অভিযাত্রীর দল উঠে পরলাম। সারারাত চাঁদের মাদকতা আর জলের কলকাকলিতে একাকার হয়ে গেল গান-গল্প,আড্ডা। চোখের পলকেই চাঁদটা যেন একদিক থেকে আরেকদিকে হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উন্মুক্ত খোলা আকাশে রহস্যের জট পাকিয়ে চাঁদের বুক দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দুরন্ত মেঘদল। আহা, বিস্তুত জলরাশির বুকে সোনালি চাদের আভা তার চাকচিক্য দিয়ে অদ্ভুত এক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। হঠাৎই মনে হল, স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে চাদের এই অপার্থিব রূপ দেখেই তো একটি জন্ম কাটিয়ে দেয়া যায়। বৃথা কেন জীবনের এই ব্যস্ততা! পৃথিবীর এই রূপ পেছনে ফেলে কিসের মোহে ছুটে চলা যান্ত্রিক জীবনের পথে। হায় দীনতায় ভরা মানব জীবন!!

যাই হোক, প্রশান্তিময় চন্দ্রাভিযান শেষে ভোরবেলা বরিশাল শহরে পা রাখতেই শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভুত হল। যে শিহরণ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় পথে প্রান্তরে, একাকীত্বে কিংবা অনেকের মাঝে। বলছি, জীবনানন্দভূতির কথা। এই মাটি যে আমার জীবন কবির জন্মস্থান। তাই তো এত আপনার মনে হচ্ছে। মনটা ছটফট করছে, কখন যাবো জীবনানন্দের সেই নিবাসে।

ভাবতে ভাবতে গ্রুপ থেকে সিদ্ধান্ত হল যেহেতু এখনও ভোর। তাই উজিরপুরের লাল শাপলার সেই বিলে যাওয়া যাক। হাতে সময়ও অফুরন্ত। ভাবামতোই কাজ। লঞ্চঘাট থেকে ৪০০ টাকায় একটি অটো গাড়ি ভাড়া করা হল। সেটি আমাদের নিয়ে যাবে বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামে। ভোরবেলা আমাদের অটো ছুটছে পিচঢালা বিস্তৃত রাজপথ দিয়ে। পথের দুপাশের বয়সী গাছের ডালে তখন পড়েছে ভোরের প্রথম আলো। রোদের লাল আভায় সবুজ পাতাগুলো কমলাবর্ণ ধারণ করেছে। আহা, প্রকৃতির এই রূপই তো জীবনানন্দকে শুদ্ধতম কবি হিসেবে গড়ে তুলেছে। অটো চলছে। উজিরপুরে পৌঁছে যতোই সামনে এগুচ্ছি ততোই চোখে পড়ছে একটা পর একটা শাপলার বিল। বিলগুলোকে ঘিরে বাহারী নৌকা নিয়ে বসে আছে মাঝিরা। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় পর্যটক বেশ চোখে পরার মত।

ছুটতে ছুটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই সাতলা গ্রামে। বড় সাইনবোর্ডে লেখা সাতলা বিল। বাহাড়ি রঙের কাগজ দিয়ে নৌকা সাজিয়ে পর্যটকদের ডাকছে মাঝিরা। লাল শাপলার টানে সকাল সকাল দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন বয়সের প্রকৃতিপ্রেমি ও ভ্রমণপিপাশুরা। অটো থেকে নেমে বিলে ঘোরার জন্য নৌকা ঠিক করতে গিয়ে দেখি আকাশচুম্বী ভাড়া চাচ্ছে। আসলে শাপলা দেখতে পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত ভীড় করায় বেপরোয়াাভাবে নৌকা ভাড়া বাড়ায় মাঝিরা। এসব দিকে প্রশাসনেরও কোন দৃষ্টি নেই। দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এসে যখন অতিরিক্ত দামে নৌকা ভাড়া করে বিলে ঘোরে তখন আর শাপলাগুলোর প্রতি তারা খুব একটা মায়া দেখাতে পারে না। ছিঁড়ে ছুটে নিয়ে যায় জাতীয় ফুলকে।

তাদেরকে পাত্তা না নিয়ে আমরা এগুলাম আরেকটিু সামনে। ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে বিলের ধারের একটি পাড়ায় গেলাম আমরা। বিলের পাশে বাড়ি হওয়ায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই ঘাস কাটার জন্য ছোট ছোট নৌকা আছে। তাদের কাছ থেকেই দুটো নৌকা নিয়ে আমরা চারজন করে উঠে পড়লাম। ভাড়াও কম পড়ল, নতুন একটি পরিবারের সাথে সখ্যতাও হল। ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। বিলের শাপলাও কমে যেতে শুরু করেছে। আসলে শাপলা দেখার মোক্ষম সময় ভোরবেলা, রোদ ওঠার আগে। রোদ যতোই বাড়বে ততোই মিইয়ে যেতে থাকে শাপলা। ছোট্ট ডিঙি নৌকা ভাসছে থোকা থোকা লাল শাপলার বুক ছুয়ে ছুয়ে। বিস্তৃত বিলভরা আরো অসংখ্য নৌকা। পর্যটকেরা ঘুরছে। ছবি তুলছে নানান ঢঙে। আর মনের সুখে ছবি তোলার জন্য বিল থেকে শুষে নিচ্ছে থোকা থোকা লাল শাপলা। শাপলা তুলে তুলে বিলকে প্রায় শূন্য করে দিয়ে যাচ্ছেন ভ্রমণকারীরাই। বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যে রূপের টানে এতদূর পথ পাড়ি দেয়া , সুধা মিটিয়ে সেই রূপ আহরণ করে তকে রিক্ত করে দিয়ে ফেলে যাওয়া কোন ধরনের স্বভাব? প্রতিদিনই এভাবে হাজার হাজার শাপলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পর্যটকরে হাতে। আবার নৌকাওয়ালারাও কম যান না। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তারাও শত শত শাপলা তুলে নৌকা সাজান।

আসলে লোকমুখে শুনে এবং ফেসবুকে ছবি দেখে অনেক আগ্রহ জন্মেছিল সাতলার শাপলা বিল দেখার। কিন্তু বাস্তবে এর জীর্ণতা দেখে কষ্ট হয়েছে খুব। মানুষ আপন হাতে প্রতিদিনই বিনষ্ট করছে প্রকৃতি দেবীর এই অমূল্য উপহারকে। প্রত্যেকটা নৌকার পর্যটকরাই মনের আনন্দে শাপলা তুলে ফেলে দেয়। একবারও ভাবে না এভাবে ফুল তুলে নিলে অন্য পর্যটকেরা যারা শাপলার এই বিস্তুত লাল গালিচা দেখতে দূরদুরান্ত থেকে আসছে তারা কি দেখবে। প্রকৃতি অকৃপণভাবে আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা সুধা মিটিয়ে অবহেলায় ছিড়ে ফেলে বড় বড় ক্ষত তৈরী করছি অপরূপ এই লাল গালিচার বুকে।

যতক্ষণ বিলে ছিলাম ততক্ষণে যেন শাপলার এই দুঃখ-যন্ত্রণা টের পেয়েছি। যেভাবে প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা প্রায় ২০০ একরের এই বিলের শাপলার চাদর ক্ষত হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করে। যে বিল দেখতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য পর্যটক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাতলায় আসে, সেই বিল রক্ষণাবেক্ষণে প্রশাসনেরও নেই পর্যাপ্ত নজরদারি। প্রতিদিনই ভোরের লাল আলো ফুটতে ফুটতেই ক্ষত বিক্ষত হওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে সাতলার এই শাপলা বিল। নিঃস্ব বিলের বুকে একাকী হওয়ার আর্তনাদ করে একটা দুটো লাল শাপলা, আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা।

প্রকৃতির এই অকৃত্তিম উপহারকে রক্ষা করা এখন স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন ও পর্যটকদের দায়িত্ব। সাতলা ইউনিয়নের কালবিলা গ্রামে প্রাকৃতিকভাবেই এই শাপলার অবারিত রঙ্গিন রূপে মুগ্ধ হতে হলে এখনই বন্ধ করতে হবে ফুল ছেঁড়া। আগাছা আর লতা পাতায় ভরা বিলে ফুটন্ত কোটি কোটি লাল শাপলা সত্যিই সত্যিই সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ভরে থাকুক জীবনানন্দের ভূমি বরিশালের বুকে।