হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইউক্যালিপটাস মূলত একটি কাঠের গাছ। যা প্রকৃতিগত ভাবে অষ্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। যদিও এর আবহাওয়াগত অভিযোজন ক্ষমতার কারণে প্রায় সব মহাদেশেই দেখতে পাওয়া যায়।
সারা বিশ্বে ইউক্যালিপটাসের প্রায় ৭০০ প্রজাতি আছে তবে পাপুয়া নিউ গিনি ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এর প্রাকৃতিকভাবে বিস্তার রয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মাত্র ১৫টি প্রজাতি চালু করা উদ্ভিদ হিসেবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বেশ কিছু জায়গায় উদাহরণস্বরুপ ভারতে, বাংলাদেশে ইউক্যালিপ্টাস গাছকে নীলগিরি বা নীলগিরি গাছ নামে ডাকা হয়। এই গাছের তেলের অনেক ব্যবহার রয়েছে। বিশেষত অ্যান্টিসেপটিক ও পরিষ্কারক হিসেবে, মশা নিধনেও এই তেলের ভূমিকা রয়েছে।
কাঠ হিসেবে এর রয়েছে ব্যবহার, বেশ সুদর্শন এর পাতা ও মসৃণ কান্ড। এদের ফুল সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ছাড়াও বেশ স্বাদিষ্ট মধু প্রস্তুতে কাজে লাগে। বেশ কিছু ইউক্যালিপটাস এর প্রজাতিতে গাম নিঃসরণের কারণে এদেরকে গাম ট্রি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তবে এর ক্ষতিকর কিছু দিক আছে। এই গাছটিতে অধিক পরিমাণে তেল থাকায় এটা বেশ দাহ্য এবং খোদ এর আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়াতে একে অগ্নি সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
তাই আবাসিক এলাকায় বা ঘরবাড়ির কাছে এটাকে কম লাগানো হয়। তবে বড় বড় সড়কের ধারে সারিবদ্ধভাবে লাগানো থাকে আর বসন্তে এর চমক লাগানো ফুল দেখে প্রায় চেনাই যায় না যে সারাবছর অনাড়ম্বর থাকা এই বৃক্ষটিকে।
ইউক্যালিপ্টাস গাছ আশপাশের প্রায় ১০ ফুট এলাকার ও ভূগর্ভের প্রায় ৫০ফুট নিচের পানি শোষণ করে আকাশে উঠিয়ে দেয়। এই গাছ রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই পানি শোষণ করে বাতাসে ছাড়ে। এর ফলে মাটিতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এই গাছের কাঠের গুণাগুণ তেমন ভালো নয়।
এ গাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই গাছের আশপাশে অন্য প্রজাতির গাছ জন্মাতে পারে না। এ গাছ মাটিকে শুষ্ক করে ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। আর ইউক্যালিপ্টাস গাছ কেটে ফেললে মাটির উর্বরতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি সংসদীয় কমিটি উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে ক্রমশ বাড়তে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের জায়গায় প্রচলিত ফলজ গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাস গাছের জায়গায় কাঁঠাল, জাম, নিম বা এ ধরণের গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে। তবে ইউক্যালিপটাসের রোপণ নিষিদ্ধ করার পরেও গাছটির বিস্তার সেখানে বাড়ছে।
ওই কমিটির সদস্য গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলছেন সরকারের মুজিববর্ষ পালনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলছে।
এ আলোচনার সময় কৃষিমন্ত্রী নিজেই ইউক্যালিপটাস গাছ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরেন। জনস্বার্থে ও পরিবেশ বিবেচনায় ক্ষতিকর গাছের জায়গায় ফলজ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষ রোপণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানান।
এতো ইউক্যালিপটাস কীভাবে এলো?
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাসের সংখ্যা কত বা এগুলোর প্রভাবে কী হচ্ছে তার কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা সরকারের বন বিভাগ বা পরিবেশ বিভাগ বলতে পারেনি।
তবে দুই বিভাগই স্বীকার করছে যে উত্তরাঞ্চলে এই গাছ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান এবং এর কারণ হলো এক সময় সরকারি কর্মসূচি বিশেষ করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতাতেই ইউক্যালিপটাস গাছ ওই অঞ্চলে রোপণ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন মূলত ৮০ দশকে সরকারিভাবে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও পাইনের মতো বিদেশি গাছগুলো বাংলাদেশে আনা হয় এবং বিনামূল্যে বিতরণও করা হয় নানা প্রজেক্টের আওতায়।
পরে ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যাদলিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এবং এরপর বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। রংপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র বলছেন আগে থেকেই ওই এলাকায় ইউক্যালিপটাসের প্রাধান্য রয়েছে।
তার মতে, এখন বনবিভাগ এ গাছটি রোপণ করে না। তবে অনেক আগে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে প্রতি কিলোমিটারে এক হাজার চারা রোপণ করা হয়েছিলো। প্রতি কিলোমিটারে সুবিধাভোগী ছিলো ৫ জন। এদের জন্য দ্রুত অর্থনৈতিক লাভ আসে এমন গাছের চিন্তা থেকে তখন এটা করা হয়েছিলো।
তিনি আরো বলেন, বিষয়টি পরে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হয় এবং পুরো অঞ্চল-জুড়ে বহু মানুষ নিজের জমিতেও ইউক্যালিপটাস রোপণ করেন। নীলফামারীতে তিস্তার অববাহিকা বালুময় এলাকা।
আবার ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে এ গাছের কাঠের চাহিদা অনেক। ফলে ব্যক্তি উদ্যোগে যারা এটি রোপণ করেছেন তারা দেখেছেন ১০ থেকে ১২ বছরে ভালো লাভ পাওয়া যাচ্ছে। এটিও এর বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
ক্ষতির পরিমাণ কেমন?
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন চৌধুরী বলছেন বিষয়টি নিয়ে গবেষণার দরকার এবং তারা এসব বিষয়ে কাজ করতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে যাচ্ছেন।
ফলজ গাছ রোপণের পক্ষে ক্যাম্পেইন করে, এমন একটি সংগঠন ফলদ বাংলাদেশের সংগঠক সঞ্জয় ঘোষ বলছেন বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা ইউক্যালিপটাসের প্রভাব নিয়ে হয়নি।
ক্ষতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক গবেষণা না হলেও পরিবেশ নিয়ে যারা জ্ঞান রাখেন তারা জানেন ইউক্যালিপটাস গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। তাছাড়া এক অঞ্চলের গাছ অন্য অঞ্চলে হলে জৈববৈচিত্রের জন্য তা ভালো হয় না।
সেখানকার মানুষ যুক্তি দেয়, গাছটিতে বেশি যত্ন লাগে না আর ছাগলেও খায় না। তবে এর ভয়ংকর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের কেউ ঠিকভাবে অবহিত করে না।
রংপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র অবশ্য বলছেন বন বিভাগের রিসার্চ সেন্টার থেকে যে তথ্য আসছে তা হলো বাংলাদেশে যেহেতু ব্যাপক বৃষ্টি হয় তাই মরুময়তা ওভাবে চোখে পড়ে না।
তার মতে ইউক্যালিপটাসের ব্যাপক উপস্থিতি ও বিস্তারের প্রবণতার মধ্যেও উত্তরাঞ্চলে শস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং একই সঙ্গে আম, লিচুর মতো ফলের উৎপাদনও ব্যাপক বেড়েছে। তবে রংপুরে পরিবেশ অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর মেজবাউল আলম বলছেন পরিবেশ অধিদফতরের সবসময়ই এ গাছটির বিরোধিতা করছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কী বলছে
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে কাঁঠাল, জাম ও নিম গাছ রোপণের সুপারিশ করা হলেও তারা তাদের এলাকায় গাছটির প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো গবেষণা করেনি বলে জানান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন চৌধুরী।
তিনি বলেন, কোনো গবেষণা না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলেন যে গাছটিতে প্রচুর পানির দরকার হয়। এমনিতেই বরেন্দ্র এলাকায় বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন দরকার হয় সেচের জন্য, তার মধ্যে আবার এই বিপুল সংখ্যক ইউক্যালিপটাস গাছ প্রতিনিয়ত পানি শোষণ করছে। আমরা মানুষকে উৎসাহিত করবো ফলজ বা বনজ উদ্ভিদের দিকে আগ্রহী করে তুলতে, কারণ তাতে আরও বেশি লাভ হবে তাদের।