এবার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের ৩০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশটির পেরলিস রাজ্যের পেদাং বেসার এলাকার দুটি স্থানে পাচারকারীদের পরিত্যক্ত ১৭টি ঘাঁটিতে এসব গণকবর শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গণকবর থেকেই ১০০ জনের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। গণকবরগুলোতে আরো শত শত অভিবাসীর দেহাবশেষ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজ সোমবার এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ।
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর খুঁজে পাওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় মালয়েশিয়ায় একই ধরনের গণকবরগুলোর সন্ধান মিলল। থাইল্যান্ডের গণকবরগুলোর তুলনায় এই গণকবরগুলোর আকার এবং দেহাবশেষের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। গত ১ মে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের সাদাও জেলার পেদাং বেসার এলাকার জঙ্গলে প্রথম অভিবাসীদের গণকবর শনাক্ত হয়েছিল। এবার একই এলাকার সীমান্তের ওপারে মালয়েশিয়ার পেদাং বেসার এলাকায় গণকবরগুলোর সন্ধান মিলল। প্রসঙ্গত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তের বিপরীতে দুটি শহরের নামই পেদাং বেসার।
মালয়েশিয়ায় গত শুক্রবার বিকেলে গণকবরগুলোর সন্ধান মিললেও গতকাল রবিবার গণমাধ্যমের কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি। ১০০ জনের দেহাবশেষ পাওয়ার কথা ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আমি অনুমান করছি এটি প্রাথমিক প্রাপ্তি মাত্র। আমার মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হবে।’
মালয়েশিয়ার ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টার’-এর অনলাইন সংস্করণের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত শুক্রবার বিকেলে একটি গণকবর থেকেই ১০০ জনের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। পেদাং বেসার শহরের কাছে ওয়াং কেলিয়ানসহ ওই এলাকার কয়েকটি ছোট ছোট গ্রামে এই গণকবর ও ঘাঁটিগুলো পাওয়া যায়। স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা স্টার অনলাইনকে বলেছেন, পেদাং বেসারের যেখানে গণকবর পাওয়া গেছে, সেটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার নেই।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মানবপাচারকারীরা বন্দিশিবির হিসেবে ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করত। গতকাল কুয়ালালামপুরে এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য জানান। এ সময় মন্ত্রী এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেননি। তবে এর আগে মালয় ভাষার দৈনিক ‘উতুসান মালয়েশিয়া’ গণকবরগুলো পাওয়ার সংবাদ প্রথম প্রকাশ করে। উতুসান মালয়েশিয়ার তথ্য মতে, থাইল্যান্ডে সীমান্তঘেঁষা পেরিল রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে দুটি এলাকায় গড়ে ওঠা ওই ১৭টি পরিত্যক্ত ঘাঁটির গণকবরে কয়েক শ দেহাবশেষ রয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, গণকবরগুলোর দেহাবশেষ বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের।
মালয়েশিয়া পুলিশ ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী ভ্যাট ৬৯ অভিযান চালিয়ে এই গণকবরগুলো শনাক্ত করে। বর্তমানে কবরগুলো পুলিশ ঘিরে রেখেছে। অভিযান শুরুর আগে আগে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। এ কাজে মালয়েশিয়া পুলিশ থাইল্যান্ডের সহায়তা নিচ্ছে।
ধারণা করা হয়, পাচারের শিকার হওয়া অভিবাসীদের নৌকায় করে প্রথমে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে পাচারকারীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের রাখে। পরে সময় সুযোগ মতো তাদের আবার নৌকায় করে অথবা স্থলপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। স্থলপথে পাচারের রুট হচ্ছে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের শংখলা প্রদেশের সাদাও জেলার পেদাং বেসার এলাকা থেকে মালয়েশিয়ার পেরলিস রাজ্যের পেদাং বেসার এলাকা পর্যন্ত। অভিবাসী প্রত্যাশীদের মালয়েশিয়ার ভেতরে নিয়েও আটকে রাখা হতো এবং সেখানে পাচারকারীদের ঘাঁটি রয়েছে-এর আগে বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ। হয়তো এ কারণেই মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই খবরে ‘মর্মাহত’ হয়েছেন।
মর্মাহত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : গণকবরগুলোর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি দাবি করেন, পাচারকারীরা এই ক্যাম্পগুলো সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবহার করত। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত পাঁচ বছর ধরে ঘাঁটিগুলো গড়ে উঠেছে। আমি মর্মাহত।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশের মহাপরিদর্শক ও উপমহাপরিদর্শক এখন সীমান্তের ওই এলাকায় আছেন। সেখানে দেহাবশেষ চিহ্নিত ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।’ তবে গণকবরগুলোতে এ পর্যন্ত কতজনের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলেননি। যদিও দ্য স্টার অনলাইন জানিয়েছে, সেখানে একটি গণকবর থেকেই গত শুক্রবার ১০০ জনের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাহিদ হামিদি বলেন, ‘কোনো কোনো কবরে তিন বা চারজন, আবার কোনোটিতে একজনের লাশ আছে। আমাদের গণনা এখনো শেষ হয়নি।’
সাগরে উদ্ধার অভিযান শুরু ইন্দোনেশিয়ার : আন্দামান সাগরে নৌকায় ভেসে বেড়ানো বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের উদ্ধার করতে অভিযান শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়াও। গতকাল ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ফুয়াদ বাসায়া জানান, গত শুক্রবার বিকেল থেকে তাঁরা সাগরে আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে সাগরে নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ, একটি টহল বিমান ও দুটি পন্টুন মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত এর আগে অভিবাসীরা যাতে ইন্দোনেশিয়ার কূলে ভিড়তে না পারে সে জন্য নিজেদের সমুদ্র উপকূলে চারটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি টহল বিমান মোতায়েন করেছিল। তখন বেশ কয়েকটি অভিবাসী নৌকাও উপকূল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘অভিবাসী তাড়ানো’ এই যুদ্ধজাহাজগুলোই এবার অভিবাসীদের খুঁজে তীরে ওঠানোর দায়িত্ব নিল।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ভাসমান অভিবাসীদের ‘সাময়িক আশ্রয়’ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া ও গতকাল ইন্দোনেশিয়া সাগরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরুর ঘোষণা দিল।
ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ফুয়াদ বাসায়া বলেন, ‘আমরা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে একটি আদেশ পেয়েছি।’ গত শনিবার বিকেল থেকে কোনো নৌকা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা অভিবাসীদের রক্ষা করব এবং তাদের তীরে নিয়ে আসব।’
বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে মিয়ানমার : সাগরে ভাসমান অভিবাসী (বোট পিপল) সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে মিয়ানমার। গতকাল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে বলা হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে এই সমস্যার সমাধান করা হবে। এতে আরো বলা হয়, সাময়িক আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা কেবলই মানবিক বিবেচনা থেকে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আগামী ২৯ মে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় মানবপাচারবিরোধী আঞ্চলিক সম্মেলনে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে। এ ছাড়া মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে সাগরে অভিবাসীদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
মিয়ানমারে নতুন আইনের খৰ রোহিঙ্গাদের ওপর : একটি সন্তান নেওয়ার পর পরবর্তী আড়াই বছরের মধ্যে আর কোনো সন্তান নিতে পারবে না কোনো নারী। এই বিধান রেখে মিয়ানমার সরকার নতুন একটি আইন পাস করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পত্রিকা ‘মিয়ানমা অ্যালিন’ গত শনিবার একটি প্রতিবেদনে জানায়, এ-সংক্রান্ত আইনটি গত ১৯ মে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন অনুমোদন করেছেন। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গা দমন ও বিতাড়নের আরেক অস্ত্র হিসেবে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, দি স্টার (মালয়েশিয়া), জাকার্তা পোস্ট।