কিছু বেদনা, কিছু সাফল্য

চিরন্তন নিয়মে পুরনো বছর বিদায় নিয়ে আসে নতুন বছর। সময়ের প্রবাহে একইভাবে আজ মধ্যরাতে বিদায় নেবে ২০১৫। তবে পুরনো বছর বিদায় নিলেও তার কিছু রেশ থেকে যায়। আর এ রেশ হয় প্রেরণামূলক কিংবা বেদনাময়।

বিদায়ী বছরের দিকে ফিরে তাকালে আমা দেখতে পাই- ২০১৫ সালের শুরুটা ছিল চরম নেতিবাচক রাজনীতির। টানা তিন মাস চলেছে অবরোধ কর্মসূচি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আহ্বানে । আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে শতাধিক মানুষের, আহত হয়েছে আরো কয়েক শ মানুষ। পেট্রলবোমা মেরে শত শত যানবাহন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিদায়ী বছরটি দুঃসহ স্মৃতি হয়ে থাকবে আরো কিছু জঘন্য ঘটনার কারণে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা কুপিয়ে হত্যা করে মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে। সে সময় হামলায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহত হন । অভিজিৎ দিয়ে শুরু। এরপর একে একে আরো চার ব্লগারকে নৃশংসভাবে খুন করেছে তারা।

মার্চে ঢাকায় ওয়াশিকুর রহমান, মে মাসে সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ, আগস্টে ঢাকার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে। আর অক্টোবরে উগ্রপন্থীরা কুপিয়ে হত্যা করে লেখক ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। ঢাকার ইতিহাসে প্রথম শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে তাদের ওপর হামলা হয়। এতে একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজনকে আহত হন।
বাংলাদেশে বিদায়ী বছরে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা আকষ্মিক হামলা করে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা এবং বিদেশি মসজিদ-মন্দিরে হামলা। ঢাকা ও রংপুরে দুবিদেশিকে হত্যা করা হয়।
নভেম্বরে বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালিয়ে মুয়াজ্জিনকে হত্যা ও ইমামসহ তিনজনকে আহত করে জঙ্গিরা। আর বছরের শেষ ডিসেম্বর মাসে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউর মন্দিরে ভক্ত ও পুণ্যার্থীদের ওপর বোমা হামলা করা হয়। বগুড়ার কাহারোলে কৃষ্ণভক্তদের একটি মন্দিরে বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। ওই ঘটনা য় নিহত হয় বোমা বহনকারী।

এ বছর তবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সত্ত্বেও বিদায়ী বছরে বেশ কিছু স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনরপি-জামায়াতের তিন শীর্ষপর্যায়ের নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্তির পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। এছাড়া দ্রুততম গতিতে সিলেট ও খুলনায় শিশুহত্যার বিচার হয়েছে। এতে জনমনে স্বস্তি আসে।
২০১৫ সালে বিদ্যুৎ উত্পাদন ও সঞ্চালনার সক্ষমতার ইতিবাচক প্রবাহ আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে দ্রুততর করেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই সূচকের শীর্ষ অবস্থানে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১ দশমিক ১৩ শতাংশ, নারীর প্রজনন প্রবণতা ২, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩৪, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ এবং হ্রাসমান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত জনমিতির অনুরূপ, উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরতদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক এবং জন্মকালীন গড় আয়ু প্রায় ৭২।

কৃষি ও মত্স্য খাতের ধারাবাহিকতাও চমত্কার। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্যের উত্পাদন ছিল এক কোটি টন; ২০১৫ সালে তা পৌনে চার কোটি টনে পৌঁছেছে। গত ২৫ বছরে আলুর মোট ফলন ৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে ৮৩ লাখ টনে উঠে এসেছে (পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম আলু উত্পাদনকারী দেশ)। মিঠা পানির মাছ উত্পাদনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে পঞ্চম; বার্ষিক চাহিদা ৪১ লাখ টন, উত্পাদন প্রায় ৩৮ লাখ টন, তন্মধ্যে ইলিশ ৩৮ হাজার টন।

২০১৫ সালে ৬৮ বছরের পুরনো ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। জনমনে দারুণ আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

অষ্টম বেতন কাঠামো কার্যকর করা সরকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। নতুন পে-স্কেলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে দেখা দিয়েছে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা।
সবশেষ সারাদেশে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, উত্তেজনায় ২৩৪ পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টিসহ ২০টি দল অংশগ্রহণ করেছে।

বিদায়ী বছরটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ছিল অত্যন্ত সফল। ২০১৫ সালে সবগুলো ওয়ানডে সিরিজেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সে সঙ্গে ওয়ানডে ক্রিকেট র্যাং কিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের ওপরে স্থান করে নিয়েছে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বিদায়ী বছরে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীর ওপর ছয় কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মূল পর্বের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।

২০১৫ বাংলাদেশে অর্থনীতির অগ্রগতি, সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান লক্ষণীয়। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। সিএনএন মানিগ্রাম বলেছে, ২০১৫ সালে পাঁচটি দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৯ সালে এ দেশ চীন ও ভারতবর্ষের সঙ্গে দ্রুততম প্রবৃদ্ধির তিনটি দেশের মধ্যে থাকবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পিইইউ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, আগামী ২৫ বছরে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মাপে পৃথিবীর ২৩তম অর্থনীতি হবে (বর্তমানে ৩৪তম) বাংলাদেশ এবং অর্থনীতির আকারে মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর