ঔষধি গুণে ভরা বিদেশি সবজি জাতীয় ফল ক্যাপসিকাম

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, ঔষধি গুণে ভরা বিদেশি সবজি জাতীয় ফল ক্যাপসিকাম। প্রায় ৯ শ’ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত এ সবজি এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। ফলে বাংলাদেশেও এ সবজি চাষ এই প্রথম না হলেও ঝিনাইদহের মহেশপুর এলাকাতে এ সবজির চাষ একেবারেই নতুন।

Image result for কৃষক আলমগীর ক্যাপসিকামের ক্ষেত ছবিএ উপজেলার কুসুমপুর গ্রামের কৃষক আলমগীর কবির তার নিজের এক একর জমিতে চাষ করে ভাল ফলন ও লাভ পাওয়ায় সবার নজর কেড়েছেন। ওই কৃষকের দেয়া তথ্যমতে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় চার লক্ষাধিক টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করেছেন।

ক্ষেতে এখনও যা ধরন্ত অবস্থায় রয়েছে তা থেকে আরো কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা আসবে। অথচ তার সর্বমোট খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ফলে লাভ আসবে বেশ।

সফল কৃষক আলমগীর কবিরের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী কুসুমপুর গ্রামে। তার ক্ষেতের ক্যাপসিকাম দেখে এবং লাভের অংক হিসাব করে এখন অনেক কৃষক এ মূল্যবান সবজি চাষের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছেন।

সরেজমিনে জেলার মহেশপুর উপজেলার কুসুমপুর মাঠে গেলে দেখা যায়, মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে বিদেশি সবজি জাতীয় ফল ক্যাপসিকামের। ক্ষতিকর পোকার হাত থেকে ক্ষেত রক্ষা করতে ক্ষেতের মাঝে মাঝে আঠাযুক্ত ট্রাপ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। যে ট্রাপের ফাঁদে ধরা খাচ্ছে সব ক্ষতিকর পোকা।

নজরে আসে সতেজ এ গাছগুলোতে বিভিন্ন বয়সী ক্যাপসিকাম ধরে ঝুলে আছে। আবার কিছু কিছু গাছে নতুন করে ফুল আসছে। ক্ষেত থেকে ক্যাপসিকাম সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য প্যাকেজিং পদ্ধতির মাধ্যমে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

 

কৃষক আলমগীর কবির জানান, তিনি মূলত একজন সবজি চাষি ও সবজির পাইকারী ব্যবসায়ী। দীর্ঘ ১৫ বছরের চাষ ও ব্যবসার অভিজ্ঞতায় অনেক সবজিতে বেশ লাভ করেছেন। আবার কখনো লোকসানও গুণতে হয়েছে।

দীর্ঘদিন সবজির সঙ্গে থাকায় তার অনেক দিনের সখ ছিল মানবদেহের জন্য উপকারী মূল্যবান ক্যাপসিকাম চাষ করবেন। ফলে একবার দেশি কিছু ক্যাপসিকামের বীজ সংগ্রহের মাধ্যমে চারা তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এ জন্য তাকে বেশ লোকসানও গুণতে হয়েছে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। পরের বছরেই কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বীজ এনে বীজতলায় চারা উৎপাদন করেন।

 

তিনি বীজতলা থেকে প্রায় দেড় হাজার চারা এক একর জমিতে রোপণ করেন। বৈরি আবহাওয়ায় কিছু চারা মারা যায়। তারপর বাকি চারাগুলো সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে সবল করে তোলেন। এর মাস দু’য়েক পর থেকেই ফল পেতে শুরু করেন। এ এলাকাতে মানুষ ভালো মত চেনেন না এটা কি এবং কিভাবে খেতে হয়।

এছাড়া ধারণা নেই এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। তাই এ এলাকায় একেবারেই বিক্রি হয়না।  তাই ঢাকায় পাঠিয়ে প্রতিকেজি ১২০/১৩০ টাকা দরে বিক্রির মাধ্যমে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৪ লাখ টাকা এসেছে। আরো বেশ কিছুদিন এ ফল বিক্রির মাধ্যমে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা আসবে বলে তার আশা।

Image result for কৃষক আলমগীর ক্যাপসিকামের ক্ষেত ছবিকৃষক আলমগীর কবির আরো জানান, এ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্বে তার কোনো ধারণা ছিল না। সুলতান মাহমুদ নামের তার এক মামার দেয়া উৎসাহ ও সহযোগীতায় তিনি বেশি উৎসাহিত হন।

তিনি জানান, সুলতান মাহমুদ এ চাষ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ায় ক্ষেত মূলত তার উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। তার দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী তিনি শুধু জিনিসের যোগান দিয়ে থাকেন। আর মূল কাজটা করেন তার মামা।

তিনি জানান, মূলত তিনি একজন সবজি চাষি ও সবজির পাইকারী ব্যবসায়ী। তাদের নিজেদের ঢাকার কাওরান বাজারে সবজির পাইকারী আড়ত রয়েছে। সেখানে তার এক ভাই এটা পরিচালনা করেন। একদিকে তার ভাই অন্যদিকে তার মামার সহযোগীতায় তিনি সবজি চাষে এতোটা আগ্রহী।

আলমগীর কবিরের মামা সুলতান মাহমুদ জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে বীজতলাতে বীজ ছিটানোর পর নভেম্বর থেকেই জমি তৈরি করে মালচিং পেপার দিয়ে চারা রোপণ করেন। এক একর জমিতে ১৫শ’ক্যাপসিকামের চারা রোপণ করেছিলেন। তবে সেখান থেকে প্রায় অর্ধেক চারা মারা গিয়েছিল।

Image result for ক্যাপসিকামের ছবিমাস খানেক আগে থেকেই ক্যাপসিকাম বিক্রি শুরু করেছেন। এখনও প্রতিটি গাছে ১২ থেকে ১৫টি ফল ধরে আছে। ৫-৬টি ফলে এক কেজি হচ্ছে। এই ফল ঢাকায় অর্ডার পাঠিয়ে প্রতিকেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দামে। বর্তমানে প্রতিদিন ৫-৭ শ’কেজি ফল পাঠানো হচ্ছে ঢাকার পাইকারী বাজারে। অর্ধেকের বেশি গাছে ফল এসে গেছে যা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করছেন। বাকি গাছগুলোর কোন কোনটায় ফল ধরা শুরু হয়েছে। আবার কোনটাতে ফুল আসছে। ফলে ক্ষেত থেকে আরো কমপক্ষে তিন মাস ফল পাবেন বলে আশা করছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্ডিয়ান মেডিকেল জার্নাল ওয়েবসূত্র বলছে, ক্যাপসিকাম একটি মসলা ও ফল জাতীয় সবজি হলেও ঔষধি গুণে ভরা। এ সবজিতে যথেষ্ট পরিমানে ভিটামিন সি, ই ছাড়া এ রয়েছে। ক্যাপসিকামে ক্যানসার প্রতিরোধ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ, কিডনী জটিলতায় কাজ করে, টিউমার প্রতিরোধে উপকারী, হরমোনকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে, হার্টের জন্য উপকারী, এ্যাজমা উপশমে কাজ করে, স্কিন ডিজিজে কাজ করে, রক্তে কোলেস্টেরল কমায়, ক্ষুধা বৃদ্ধি করে, দীর্ঘ মেয়াদী পেপটিক আলসার সারাতে সাহায্য করে, এতে প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আইরন রয়েছে। কার্বহাইড্রেট ও শর্করা রয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণে। শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম ঝরলে ক্যাপসিকাম সোডিয়ামের যোগান দেয়।

ক্যাপসিক্যাম ক্ষেত দেখতে আসা কৃষক মেহেদী হাসান জানান, ক্যাপসিকাম একটি বিদেশি সবজি জাতীয় ফসল। এছাড়াও এ এলাকাতে একেবারেই নতুন। শুনেছেন বেশ লাভজনক ফসল। তাই নিজেও চাষ করবেন বলে এসেছেন খোঁজ নিতে।

তিনি বলেন, আগে এ এলাকায় কোনো এ ফসলের চাষ হয়নি। এখন কৃষক আলমগীর কবির তার ক্ষেতে চাষ করেছেন। ক্ষেতে ধরেছেও বেশ। ফলে দেখে খুবই ভালো লাগছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ঝিনাইদহের উপ পরিচালক কৃপাংসু শেখর বিশ্বাস ও মহেশপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কবির পল্লব জানান, বিদেশি এই ফসলের জন্য তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রয়োজন হয়। এখানে অনেক সময় তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য ঘটে। তারপরও ক্ষেতের গাছগুলো সতেজ হয়ে বেড়ে উঠেছে। সঠিক পরিচর্যার জন্য ফলনও হয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণ। তারা জানান, এ অঞ্চলে আগামীতে এ ফসলের চাষ আরো বাড়বে।

কৃষক আলমগীর কবিরের ক্যাপসিকামের ক্ষেত

কৃষক আলমগীর কবিরের ক্যাপসিকামের ক্ষেত

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ির ঢাকার উপ-পরিচালক (পুষ্টি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প) মাইদুর রহমান জানান, দেশের বেশ কিছু স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পুষ্টিগুণে ভরা ক্যাপসিকামের চাষ হয়েছে। তবে এদেশের মানুষ এর গুণাগুন ও চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে এখনও অনভিজ্ঞ। তবে এ বছর তাদের এলাকায় বিদেশি এ সবজির ফলন হয়েছে। ফলন ও লাভ উভয় বেশি হওয়ায় অনেক কৃষক আগামীতে পুষ্টিগুণে ভরা এ সবজির চাষ করবেন বলে তারা কৃষকদের সূত্রে জানতে পেরেছেন।

Image result for ক্যাপসিকাম  ছবি বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক (মনিটরিং) মিজানুর রহমান জানান, বিদেশি সবজি  জাতীয় ফল ক্যাপসিকামের চাষ হয়েছে শুনে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এ এলাকাটা সমতল ভূমির বিরাট এক ফসলি মাঠ। এখানে সব ধরনের ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে সবজি চাষের জন্য এ এলাকাটা বিশেষভাবে উপযোগী। কৃষক আলমগীর কবিরের ক্যাপসিকামের ক্ষেত দেখে খুব ভালো লেগেছে।

Image result for ক্যাপসিকাম  ছবিবাংলাদেশ হর্টিকালচারিষ্ট ড. মনোয়ার হোসেন জানান, ক্যাপসিকাম একটি বিদেশি সবজি জাতীয় ফল। আমাদের দেশে উৎপাদিত সবজিতেও অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। ক্যাপসিকামে পুষ্টিগুণ রয়েছে বলেই বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অনেক আগে থেকেই চাষ হয়ে আসছে। এদেশে সবেমাত্র চাষ শুরু হয়েছে ক্যাপসিকামের। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এর বাজার সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। সর্বোপরি বিষমুক্তভাবে নিরাপদ পদ্ধতিতে চাষ করতে পারলে এর পুষ্টিগুণ ধরে রাখা সম্ভব হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর