ঢাকা ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৫০ বছরে উদ্ধার হয়নি রেলের ৩০ একর জমি: দখলদারের গ্রাসে ২৬শ’ কোটি টাকার সম্পদ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ মার্চ ২০২০
  • ১৮২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রেলওয়ের আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রায় ৩০ একর জমি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার হচ্ছে না। সারা দেশে রেলের জমি দখলমুক্ত করতে প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে দেড় হাজারবার অভিযান চলে। কিন্তু গত ৫০ বছরে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় চার একর এবং চট্টগ্রামের মতিঝর্ণায় ২৬ একর জমি উদ্ধারে কোনো অভিযান হয়নি। মতিঝর্ণা ও ফুলবাড়িয়ায় অভিযান চালানোর অনুমতি চেয়ে ঊর্ধ্বতনদের কাছে শতাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু নির্দেশনা মেলেনি। রেলওয়ের হিসাবেই এ পরিমাণ জমির মূল্য কমবেশি দুই হাজার ৬২০ কোটি টাকা। জমিগুলো দখল করে তিনতলা থেকে দশতলা পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব ভবন তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সময়ে রেলওয়ের ৪ জন মন্ত্রী মতিঝর্ণা ও ফুলবাড়িয়ার জায়গা উদ্ধারে প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি দফতর সূত্রে জানা গেছে, রেলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ওপর মহলের কোনো নির্দেশনা নেই। চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা ও রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা চেয়ে রেলওয়ের ভূ-সম্পতি দফতর থেকে প্রায় শতাধিকবার রেলওয়ে বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু চিঠির অনুকূলেই উচ্ছেদের ‘নির্দেশনা’ পাওয়া যায়নি। মূলত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনীহা, মামলা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণেই জমি উদ্ধার হচ্ছে না।

রেলওয়ে সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, শুধু এ দুটি জমি নয়, আরও বিশেষ কিছু জমি উদ্ধার করতে না পাড়ায় আমাদের পুরো অভিযানই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তবে যে কোনো মূল্যে আমরা বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করবই। যদিও এটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। এর সঙ্গে স্থানীয় লোকজন, প্রশসান এবং রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, মতিঝর্ণা উচ্ছেদে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে। ফুলবাড়িয়ায় রেলের জমি উদ্ধারের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে ৪টি মামলায় রেলওয়ের পক্ষে রায় এসেছে। আরও ৭টি মামলা রয়েছে। ওই ৭টি মামলা একইদিন একই আদালতে নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি তা দ্রুত হবে।

জানতে চাইলে রেলওয়ে মহাপরিচালক শামছুজ্জামান বলেন, এটা সত্য যে দুটি জায়গা উদ্ধারে বহুবার চিঠি চালাচালি হয়েছে- এখনও হচ্ছে। ফুলবাড়িয়ায় রেলের জায়গা দখল হয়ে গেছে। এটা এমনভাবে দখল করা হয়েছে যে, ওখানে যে এক সময় ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন ছিল তার কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা এখানে একটি রেলওয়ে আইনকন ভবন নির্মাণ করতে চাই। এ জায়গার মূল্য অনেক। যুগের পর যুগ দখলে থাকলেও উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধান ভূসম্পদ কর্মকর্তা বরাবর চট্টগ্রাম রেলওয়ের আইন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সিভিল আপিল নং-৮৩/২০০৩ এর রায়ে চট্টগ্রাম মতিঝর্ণা এলাকায় রেলের ২৬ একর জমি উচ্ছেদের বিষয়ে স্পষ্ট আদেশ এবং রায় প্রদান করেছেন।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, “সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের নির্দেশনার পর উচ্ছেদের পরিবর্তে ‘suit for execution’ দায়ের করার কোনো আইনগত যুক্তি নেই। এ বিষয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি রেলপথমন্ত্রীর সঙ্গে রেলওয়ে জিএম (পূর্ব) ও আইন কর্মকর্তা (পূর্ব) সব কাগজপত্র সহকারে আলোচনা করেন। রেলপথমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় তাৎক্ষণিক পাঠ করে ‘suit for execution’ দায়েরের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি দেখবেন বলে জানান।”

এদিকে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই রেলওয়ে মহাপরিচালক বরাবর তৎকালীন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মতিঝর্ণা এলাকায় রেলওয়ে ২৬ একর জমির ওপর অবৈধ স্থাপনায় ছেয়ে গেছে। ওই জমিতে ৮টি পাঁচতলা, ১০টি, চারতলা, ১৬টি তিনতলা, ৩২টি দ্বিতল, ৫৫টি একতলা, ৩৫০টি সেমিপাকা, ১০৫০টি কাঁচাঘর, ৪টি পাকা মসজিদ, ৩টি পাকা মাদ্রাসা, ১টি সেমিপাকা মন্দির, ২টি সেমিপাকা বিদ্যালয়, ৫১০ দোকানঘরসহ আনুমানিক ৬ হাজার অবৈধ দখলদার বিদ্যমান রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা খবুই প্রয়োজন।’

উচ্ছেদ করতে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করার কথাও বলা হয় ওই চিঠিতে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমন শতাধিক চিঠি স্বাধীনতার পর থেকে দেয়া হলেও কোনো চিঠিই আমলে নেয়নি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে একটি মাত্র রেলওয়ে স্টেশন ছিল- যার নাম ছিল ‘ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন’। স্বাধীনতার পরপরই স্টেশনটি ভূমিদস্যুরা দখলে নিতে শুরু করে। বর্তমানে স্টেশনটির কোনো চিহ্ন নেই। চলতি মাসের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেলওয়ে প্রধান ভূ-সম্পতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘শহর ঢাকা মৌজার সিএস ১৩৬, ১৩৮, ১৩৯ ভূমির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ভূমিদস্যুরা একটি মামলায় পরাজিত হলে অন্য আরেকটি মামলা দায়ের করে এবং অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে। ৩.৯৭ একর জায়গায় ৫০৭টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে ৩২টি বহুতল ভবন আছে। ১০ তলা ভবন ৭টি, ৬টি তলা ভবন ৭টি, ৫ তলা ভবন ৬টি, ৪ তলা ভবন ৫টি, ৩ তলা ভবন ৬টি, ২ তলা ভবন ৩টি, ২টি ৪ তলা মসজিদসহ মোট ৫০৭টি পাকা স্থাপনা রয়েছে।’

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে প্রধান ভূ-সম্পতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত বেদখলে থাকা অনেক জমি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ের জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা যদি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা পাই তাহলে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করব। এ জমি উদ্ধারের বহুবার পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। এ জমিতে ৫০৭টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু অল্প জায়গায় উঁচু ভবন রয়েছে। হিজড়াদেরও ২টি বেশ বড় আবাসন রয়েছে এখানে। ভূমিদস্যুরা সব ধরনের লোক ভাড়ায় রেখেছে এখানে। বর্তমানে ৯টি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো নিষ্পতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে। এসব ভবন ভাঙতে কিংবা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে অনেক জনবল এবং অর্থের প্রয়োজন। উচ্ছেদ পরিচালনায় রেলওয়ের কিছুই নেই। সবই ভাড়া করে আনতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের লালখানবাজার মৌজায় রেলের জমিতে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক ‘ক্লাব-কমিউনিটি সেন্টার।’ কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তির কারণে এটি উচ্ছেদ হচ্ছে না। এটি উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাবর চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু উচ্ছেদের নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এদিকে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভিন্ন স্টেশন ঘিরে ২৬৭.৩৩ একর জমি দখলে রেখেছে ভূমিদস্যুরা। এই জমি উদ্ধার করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করা গেলে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, উচ্ছেদ করলেও লাভ হচ্ছে না- উচ্ছেদ অভিযান শেষ না হতেই পুনরায় জায়গা দখলে চলে যায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

৫০ বছরে উদ্ধার হয়নি রেলের ৩০ একর জমি: দখলদারের গ্রাসে ২৬শ’ কোটি টাকার সম্পদ

আপডেট টাইম : ১১:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ মার্চ ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রেলওয়ের আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রায় ৩০ একর জমি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার হচ্ছে না। সারা দেশে রেলের জমি দখলমুক্ত করতে প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে দেড় হাজারবার অভিযান চলে। কিন্তু গত ৫০ বছরে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় চার একর এবং চট্টগ্রামের মতিঝর্ণায় ২৬ একর জমি উদ্ধারে কোনো অভিযান হয়নি। মতিঝর্ণা ও ফুলবাড়িয়ায় অভিযান চালানোর অনুমতি চেয়ে ঊর্ধ্বতনদের কাছে শতাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু নির্দেশনা মেলেনি। রেলওয়ের হিসাবেই এ পরিমাণ জমির মূল্য কমবেশি দুই হাজার ৬২০ কোটি টাকা। জমিগুলো দখল করে তিনতলা থেকে দশতলা পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব ভবন তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সময়ে রেলওয়ের ৪ জন মন্ত্রী মতিঝর্ণা ও ফুলবাড়িয়ার জায়গা উদ্ধারে প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি দফতর সূত্রে জানা গেছে, রেলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ওপর মহলের কোনো নির্দেশনা নেই। চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা ও রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা চেয়ে রেলওয়ের ভূ-সম্পতি দফতর থেকে প্রায় শতাধিকবার রেলওয়ে বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু চিঠির অনুকূলেই উচ্ছেদের ‘নির্দেশনা’ পাওয়া যায়নি। মূলত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনীহা, মামলা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণেই জমি উদ্ধার হচ্ছে না।

রেলওয়ে সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, শুধু এ দুটি জমি নয়, আরও বিশেষ কিছু জমি উদ্ধার করতে না পাড়ায় আমাদের পুরো অভিযানই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তবে যে কোনো মূল্যে আমরা বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করবই। যদিও এটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। এর সঙ্গে স্থানীয় লোকজন, প্রশসান এবং রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, মতিঝর্ণা উচ্ছেদে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে। ফুলবাড়িয়ায় রেলের জমি উদ্ধারের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে ৪টি মামলায় রেলওয়ের পক্ষে রায় এসেছে। আরও ৭টি মামলা রয়েছে। ওই ৭টি মামলা একইদিন একই আদালতে নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি তা দ্রুত হবে।

জানতে চাইলে রেলওয়ে মহাপরিচালক শামছুজ্জামান বলেন, এটা সত্য যে দুটি জায়গা উদ্ধারে বহুবার চিঠি চালাচালি হয়েছে- এখনও হচ্ছে। ফুলবাড়িয়ায় রেলের জায়গা দখল হয়ে গেছে। এটা এমনভাবে দখল করা হয়েছে যে, ওখানে যে এক সময় ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন ছিল তার কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা এখানে একটি রেলওয়ে আইনকন ভবন নির্মাণ করতে চাই। এ জায়গার মূল্য অনেক। যুগের পর যুগ দখলে থাকলেও উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধান ভূসম্পদ কর্মকর্তা বরাবর চট্টগ্রাম রেলওয়ের আইন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সিভিল আপিল নং-৮৩/২০০৩ এর রায়ে চট্টগ্রাম মতিঝর্ণা এলাকায় রেলের ২৬ একর জমি উচ্ছেদের বিষয়ে স্পষ্ট আদেশ এবং রায় প্রদান করেছেন।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, “সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের নির্দেশনার পর উচ্ছেদের পরিবর্তে ‘suit for execution’ দায়ের করার কোনো আইনগত যুক্তি নেই। এ বিষয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি রেলপথমন্ত্রীর সঙ্গে রেলওয়ে জিএম (পূর্ব) ও আইন কর্মকর্তা (পূর্ব) সব কাগজপত্র সহকারে আলোচনা করেন। রেলপথমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় তাৎক্ষণিক পাঠ করে ‘suit for execution’ দায়েরের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি দেখবেন বলে জানান।”

এদিকে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই রেলওয়ে মহাপরিচালক বরাবর তৎকালীন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মতিঝর্ণা এলাকায় রেলওয়ে ২৬ একর জমির ওপর অবৈধ স্থাপনায় ছেয়ে গেছে। ওই জমিতে ৮টি পাঁচতলা, ১০টি, চারতলা, ১৬টি তিনতলা, ৩২টি দ্বিতল, ৫৫টি একতলা, ৩৫০টি সেমিপাকা, ১০৫০টি কাঁচাঘর, ৪টি পাকা মসজিদ, ৩টি পাকা মাদ্রাসা, ১টি সেমিপাকা মন্দির, ২টি সেমিপাকা বিদ্যালয়, ৫১০ দোকানঘরসহ আনুমানিক ৬ হাজার অবৈধ দখলদার বিদ্যমান রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা খবুই প্রয়োজন।’

উচ্ছেদ করতে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করার কথাও বলা হয় ওই চিঠিতে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমন শতাধিক চিঠি স্বাধীনতার পর থেকে দেয়া হলেও কোনো চিঠিই আমলে নেয়নি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে একটি মাত্র রেলওয়ে স্টেশন ছিল- যার নাম ছিল ‘ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন’। স্বাধীনতার পরপরই স্টেশনটি ভূমিদস্যুরা দখলে নিতে শুরু করে। বর্তমানে স্টেশনটির কোনো চিহ্ন নেই। চলতি মাসের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেলওয়ে প্রধান ভূ-সম্পতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘শহর ঢাকা মৌজার সিএস ১৩৬, ১৩৮, ১৩৯ ভূমির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ভূমিদস্যুরা একটি মামলায় পরাজিত হলে অন্য আরেকটি মামলা দায়ের করে এবং অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে। ৩.৯৭ একর জায়গায় ৫০৭টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে ৩২টি বহুতল ভবন আছে। ১০ তলা ভবন ৭টি, ৬টি তলা ভবন ৭টি, ৫ তলা ভবন ৬টি, ৪ তলা ভবন ৫টি, ৩ তলা ভবন ৬টি, ২ তলা ভবন ৩টি, ২টি ৪ তলা মসজিদসহ মোট ৫০৭টি পাকা স্থাপনা রয়েছে।’

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে প্রধান ভূ-সম্পতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত বেদখলে থাকা অনেক জমি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ের জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা যদি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা পাই তাহলে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করব। এ জমি উদ্ধারের বহুবার পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। এ জমিতে ৫০৭টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু অল্প জায়গায় উঁচু ভবন রয়েছে। হিজড়াদেরও ২টি বেশ বড় আবাসন রয়েছে এখানে। ভূমিদস্যুরা সব ধরনের লোক ভাড়ায় রেখেছে এখানে। বর্তমানে ৯টি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো নিষ্পতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে। এসব ভবন ভাঙতে কিংবা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে অনেক জনবল এবং অর্থের প্রয়োজন। উচ্ছেদ পরিচালনায় রেলওয়ের কিছুই নেই। সবই ভাড়া করে আনতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের লালখানবাজার মৌজায় রেলের জমিতে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক ‘ক্লাব-কমিউনিটি সেন্টার।’ কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তির কারণে এটি উচ্ছেদ হচ্ছে না। এটি উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাবর চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু উচ্ছেদের নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এদিকে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভিন্ন স্টেশন ঘিরে ২৬৭.৩৩ একর জমি দখলে রেখেছে ভূমিদস্যুরা। এই জমি উদ্ধার করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করা গেলে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, উচ্ছেদ করলেও লাভ হচ্ছে না- উচ্ছেদ অভিযান শেষ না হতেই পুনরায় জায়গা দখলে চলে যায়।