ঢাকা ০৯:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বদলায় না ওদের জীবন, শিক্ষা যেন শুধুই বিলাসিতা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৮:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫
  • ৩৩১ বার

দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, শহর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে তারা সব সময় ব্যস্ত। কিন্তু নিজের বসবাসের পরিবেশটি অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন। তারা বাহিরের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন থেকে বঞ্চিত। তবুও কোন ব্যাপারেই তাদের প্রতিবাদী হতে দেখা যায় না।

দীর্ঘদিন থেকে মানবেতর জীবনযাপন করলেও বগুড়ার হরিজন সম্প্রদায় সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের সাথে ঘনিষ্টতা না থাকায় তাদের আয়ের পথও সীমাবদ্ধ। তাই স্বল্প আয়ের এই সম্প্রদায় অল্পতেই তুষ্ট থাকতে হয়। অসূচিতার কারণে সমাজের কোন অনুষ্ঠানে এদের প্রবেশাধিকার নেই। উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নততর জীবন তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা।

তবে অনেক সচেতন হরিজন অন্যত্র সরে গিয়ে বসবাস করার মানসিকতা পোষণ করলেও সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্য তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে ঝাড়ু হাতে যাদের সকাল শুরু হয়, সেই হরিজনদের বসত বাড়ির আশপাশ নোংরা এবং আবর্জনায় থাকে সব সময় পরিপূর্ণ।

Bogra_Horizonবাড়ির ছোট শিশুরা ধুলা এবং কাদামাটির সাথে মিশে থাকে সব সময়। এতে প্রতিটি শিশুই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকলেও এটি তাদের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপন হয়ে দাড়িয়েছে। পোশাকে অপরিচ্ছন্ন এবং খাবারে অপরিষ্কার এদের নিত্য সঙ্গী। দূর্গন্ধময় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সারাক্ষণই হরিজন শিশুদের অপুষ্টি ও চর্মরোগে আক্রান্ত থাকতে দেখা যায়। জীবন ধারণের এই অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে বড় হচ্ছে হরিজন শিশুরা।

অল্প আয়ে এই সম্প্রদায়েরা টাকার অভাবে ভাল ডাক্তারও দেখাতে পারে না। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরাচরিত টোটকা চিকিৎসা দিয়েই চলে এদের চিকিৎসা সেবা। হরিজনদের বসত বাড়ির সংলগ্নই থাকে বিভিন্ন রোগ জীবানু বহনকারী শুকুরের দল। এসব শুকুর বাড়ির আঙ্গিনা, বারান্দা এমনকি ঘরের মধ্যেই একই সাথে বসবাস করে আসছে।

বিষয়টি এদের জন্য অভ্যাসের হলেও সকলেরও অজান্তে শুকুরের দল বিভিন্ন রোগ বালাই বহন এবং অপরিচ্ছিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিষয়টি হরিজনদের জানা থাকলেও করার কিছু নেই বলে তারা জানান।

অন্যদিকে, দীর্ঘ ৫০ বছর আগের নির্মাণ করা এদের বসতবাড়ির দালানের বেশির ভাগই ছাদের অংশ ধসে পড়ে গেছে। শহরের কটন মিল হরিজন কলোনীতে প্রতিটি দালানই ঝুঁকিপূর্ণ। চকসুত্রাপুর হরিজন কলোনীতে পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নিজেরাই অর্থ খরচ করে সাময়িক টিনের ঘর নির্মাণ করেছেন।

সংস্কারের অভাবে বৃষ্টির সময় এগুলো দিয়ে পানি পড়ে। কলোনী এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। অতি বর্ষণে ড্রেনের পানি ঘরে এসে প্রবেশ করে। পৌর কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই সীমাবদ্ধ সুযোগ সুবিধার মধ্যে অপরিচ্ছন্ন ও ঝুঁকি নিয়েই দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে নীরবেই কেটে যাচ্ছে এদের কষ্টের জীবন।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা

বগুড়ায় হরিজন শিশুদের অনেকটা জোর করেই পড়ানো ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। বগুড়ার কটনমিল হরিজন কলোনিতে স্থানীয় এনজিও লাইট হাউস পরিচালিত স্যাটেলাইট স্কুলে পড়তো হরিজন শিশুরা। ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস চলতো নিয়মিত। কিন্তু রাস্তা সম্প্রসারনের আওতায় স্কুলটি ভাঙ্গা পড়ে। তারপর থেকেই আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না হরিজন শিশুদের।

শহরের কাটনার পাড়ায় হরিজন কলোনীর সম্মুখ ভাগে স্কুলটি পরিচালিত হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। দুপুর ২ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করতো প্রায় ৮০ জন হরিজন শিশু। বিনা পয়সায় প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা উপকরন ও পোশাকসহ বহুবিদ শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতো লাইট হাউজের এই স্যাটেলাইট স্কুলে। স্কুল ভাঙ্গা বাবদ পৌরসভা থেকে ক্ষতিপুরন এর ১ লাখ ২ হাজার টাকাও পায়নি এই হরিজনরা।

শহরের চকসুত্রাপুর, ষ্টেশন সংলগ্ন, হাসপাতাল, পাওয়ার হাউজ ও পুলিশ লাইনে হরিজন কলোনী গড়ে উঠলেও এদের মধ্যে শিক্ষার হার একদম নিম্নমূখী। স্থানীয় কয়েকজন হরিজনের সহযোগিতায় শুধু মাত্র কটনমিলের সামনে কাটনার পাড়া এলাকায় প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত স্কুল গড়ে উঠলেও দীর্ঘ ২০০ বছরের তাদের এই বস্তিতে নূন্যতম কোন সুযোগ সুবিধা না থাকায় নিভূ নিভূ অবস্থায় চলে আসছিল স্যাটেলাইট স্কুলটি।

হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা নিম্ন জাতের হওয়ায় স্থানীয় অন্যান্য স্কুলে এসব শিশুরা স্বাচ্ছন্দ ভাবে লেখাপড়া করতে পারে না। আর তাই এদের মধ্যে শিক্ষার হার সবচেয়ে নিন্মতম। ছোট থেকেই সব শিশুকে বাবা মার পেশা গ্রহণ করতে হবে, এমন মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠতে হয়। এমতাবস্থায় লাইট হাউস পরিচালিত স্যাটেলাইট স্কুলটি ছিল তাদের জীবনের সম্ভাবনাময় একটি আলোর দিশারী।

৫০০ জনের জন্য ২টি টিউবওয়েল বাথরুম ৪ টি

বগুড়ায় হরিজনদের জন্য ৬টি কলোনীতে পৌরসভা থেকে ঘর তৈরি করে দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ১০/১২ ফুট মাপের এক একটি ঘরে পরিবারের সবাই গাদাগাদি করে বসবাস করে আসছে। যে সব হরিজন তাদের কলোনীতে নিজেরাই কোন রকমে ঘর তৈরি করে নিয়েছেন তাদের অবস্থা আরও করুন। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি এবং নিরাপত্তার অভাবে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে জীবন যাপন করছে এরা।

Bogra_Horizonসামান্যতম যে বেতন এরা পায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শহরের কাটনার পাড়ায় কটনমিল সংলগ্ন হরিজন কলোনীতে বসবাস করে ১০০ টি পরিবার। মোট লোকসংখ্যা ৫০০ জন। দীর্ঘদিন ধরে এই ৫০০ জন লোকের পানীয় জলের জন্য পৌরসভা থেকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২টি টিউবওয়েল। বাথরুম রয়েছে ৪টি। দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে সকালে প্রাতঃকার্য সমাধানের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় এখানে।

এমন অবস্থা অন্যান্য হরিজন কলোনীতেও। কাটনারপাড়া হরিজন কলোনীর বাসিন্দা শ্রী শিব প্রসাদ মন্টু হরিজন জানান, বারবার পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেও আমাদের সমস্যার সমাধান হয়নি। নিজেদের অর্থ না থাকায় স্বল্প সুবিধার মধ্যে আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। ৫০০ জন লোকের জন্য যেখানে ২০টি টিউবওয়েল দরকার সেখানে রয়েছে মাত্র দুটি।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সুখ দুঃখ দেখার জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করেছি। কিন্তু আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করার নূন্যতম সুযোগ সুবিধা আমরা পাই না। ১৯৬৫ সালে বগুড়া চকসুত্রাপুরে বৃহত্তম আদর্শ হরিজন কলোনী স্থাপিত হওয়ার পর থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সংস্কারের কাজ হয়নি এখানে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে জন সংখ্যা। পৌরসভা থেকে সে তুলনায় দেয়া হচ্ছে না কোন প্রয়োজনীয় উপকরণ।

চকসুত্রাপুর হরিজন কলোনীর নেতা শ্রী নিরধ হরিজন (৫৫) জানান, প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় বাড়ছে না তাদের কলোনীর এরিয়া।

তিনি জানান, অনতিবিলম্বে হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য বগুড়ায় আলাদা একটি জায়গা নির্ধারণ করা হোক। আবাসন সংকট এর সাথে সাথে এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও দারুন ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। শহরের কাটনার পাড়া, চকসুত্রাপুর, ষ্টেশন সংলগ্ন ও হাসপাতাল এলাকায় গড়ে উঠা হরিজন কলোনির অবস্থা আরও করুন। নূন্যতম চলাচলের রাস্তা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে চলাচলের দারুণ অসুবিধা পোহাতে হয়।

আলো বাতাস প্রবেশের কোন ব্যবস্থা নেই এদের বসত ঘরে। শুধু দরজা দিয়েই যতটুকু আলো বাতাস ঢুকে সেটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় এদের। ঘরের সাথেই চুলা তৈরি করে রান্না বান্না করার কারনে আগুনের ধোয়া বসত ঘর ভরতি তাকে সারাক্ষণ। এভাবে কষ্টের সাথে বসবাস করেই কাটছে বগুড়ায় হরিজনদের দিনকাল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বদলায় না ওদের জীবন, শিক্ষা যেন শুধুই বিলাসিতা

আপডেট টাইম : ১২:৪৮:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫

দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, শহর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে তারা সব সময় ব্যস্ত। কিন্তু নিজের বসবাসের পরিবেশটি অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন। তারা বাহিরের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন থেকে বঞ্চিত। তবুও কোন ব্যাপারেই তাদের প্রতিবাদী হতে দেখা যায় না।

দীর্ঘদিন থেকে মানবেতর জীবনযাপন করলেও বগুড়ার হরিজন সম্প্রদায় সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের সাথে ঘনিষ্টতা না থাকায় তাদের আয়ের পথও সীমাবদ্ধ। তাই স্বল্প আয়ের এই সম্প্রদায় অল্পতেই তুষ্ট থাকতে হয়। অসূচিতার কারণে সমাজের কোন অনুষ্ঠানে এদের প্রবেশাধিকার নেই। উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নততর জীবন তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা।

তবে অনেক সচেতন হরিজন অন্যত্র সরে গিয়ে বসবাস করার মানসিকতা পোষণ করলেও সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্য তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে ঝাড়ু হাতে যাদের সকাল শুরু হয়, সেই হরিজনদের বসত বাড়ির আশপাশ নোংরা এবং আবর্জনায় থাকে সব সময় পরিপূর্ণ।

Bogra_Horizonবাড়ির ছোট শিশুরা ধুলা এবং কাদামাটির সাথে মিশে থাকে সব সময়। এতে প্রতিটি শিশুই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকলেও এটি তাদের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপন হয়ে দাড়িয়েছে। পোশাকে অপরিচ্ছন্ন এবং খাবারে অপরিষ্কার এদের নিত্য সঙ্গী। দূর্গন্ধময় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সারাক্ষণই হরিজন শিশুদের অপুষ্টি ও চর্মরোগে আক্রান্ত থাকতে দেখা যায়। জীবন ধারণের এই অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে বড় হচ্ছে হরিজন শিশুরা।

অল্প আয়ে এই সম্প্রদায়েরা টাকার অভাবে ভাল ডাক্তারও দেখাতে পারে না। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরাচরিত টোটকা চিকিৎসা দিয়েই চলে এদের চিকিৎসা সেবা। হরিজনদের বসত বাড়ির সংলগ্নই থাকে বিভিন্ন রোগ জীবানু বহনকারী শুকুরের দল। এসব শুকুর বাড়ির আঙ্গিনা, বারান্দা এমনকি ঘরের মধ্যেই একই সাথে বসবাস করে আসছে।

বিষয়টি এদের জন্য অভ্যাসের হলেও সকলেরও অজান্তে শুকুরের দল বিভিন্ন রোগ বালাই বহন এবং অপরিচ্ছিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিষয়টি হরিজনদের জানা থাকলেও করার কিছু নেই বলে তারা জানান।

অন্যদিকে, দীর্ঘ ৫০ বছর আগের নির্মাণ করা এদের বসতবাড়ির দালানের বেশির ভাগই ছাদের অংশ ধসে পড়ে গেছে। শহরের কটন মিল হরিজন কলোনীতে প্রতিটি দালানই ঝুঁকিপূর্ণ। চকসুত্রাপুর হরিজন কলোনীতে পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নিজেরাই অর্থ খরচ করে সাময়িক টিনের ঘর নির্মাণ করেছেন।

সংস্কারের অভাবে বৃষ্টির সময় এগুলো দিয়ে পানি পড়ে। কলোনী এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। অতি বর্ষণে ড্রেনের পানি ঘরে এসে প্রবেশ করে। পৌর কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই সীমাবদ্ধ সুযোগ সুবিধার মধ্যে অপরিচ্ছন্ন ও ঝুঁকি নিয়েই দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে নীরবেই কেটে যাচ্ছে এদের কষ্টের জীবন।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা

বগুড়ায় হরিজন শিশুদের অনেকটা জোর করেই পড়ানো ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। বগুড়ার কটনমিল হরিজন কলোনিতে স্থানীয় এনজিও লাইট হাউস পরিচালিত স্যাটেলাইট স্কুলে পড়তো হরিজন শিশুরা। ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস চলতো নিয়মিত। কিন্তু রাস্তা সম্প্রসারনের আওতায় স্কুলটি ভাঙ্গা পড়ে। তারপর থেকেই আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না হরিজন শিশুদের।

শহরের কাটনার পাড়ায় হরিজন কলোনীর সম্মুখ ভাগে স্কুলটি পরিচালিত হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। দুপুর ২ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করতো প্রায় ৮০ জন হরিজন শিশু। বিনা পয়সায় প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা উপকরন ও পোশাকসহ বহুবিদ শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতো লাইট হাউজের এই স্যাটেলাইট স্কুলে। স্কুল ভাঙ্গা বাবদ পৌরসভা থেকে ক্ষতিপুরন এর ১ লাখ ২ হাজার টাকাও পায়নি এই হরিজনরা।

শহরের চকসুত্রাপুর, ষ্টেশন সংলগ্ন, হাসপাতাল, পাওয়ার হাউজ ও পুলিশ লাইনে হরিজন কলোনী গড়ে উঠলেও এদের মধ্যে শিক্ষার হার একদম নিম্নমূখী। স্থানীয় কয়েকজন হরিজনের সহযোগিতায় শুধু মাত্র কটনমিলের সামনে কাটনার পাড়া এলাকায় প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত স্কুল গড়ে উঠলেও দীর্ঘ ২০০ বছরের তাদের এই বস্তিতে নূন্যতম কোন সুযোগ সুবিধা না থাকায় নিভূ নিভূ অবস্থায় চলে আসছিল স্যাটেলাইট স্কুলটি।

হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা নিম্ন জাতের হওয়ায় স্থানীয় অন্যান্য স্কুলে এসব শিশুরা স্বাচ্ছন্দ ভাবে লেখাপড়া করতে পারে না। আর তাই এদের মধ্যে শিক্ষার হার সবচেয়ে নিন্মতম। ছোট থেকেই সব শিশুকে বাবা মার পেশা গ্রহণ করতে হবে, এমন মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠতে হয়। এমতাবস্থায় লাইট হাউস পরিচালিত স্যাটেলাইট স্কুলটি ছিল তাদের জীবনের সম্ভাবনাময় একটি আলোর দিশারী।

৫০০ জনের জন্য ২টি টিউবওয়েল বাথরুম ৪ টি

বগুড়ায় হরিজনদের জন্য ৬টি কলোনীতে পৌরসভা থেকে ঘর তৈরি করে দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ১০/১২ ফুট মাপের এক একটি ঘরে পরিবারের সবাই গাদাগাদি করে বসবাস করে আসছে। যে সব হরিজন তাদের কলোনীতে নিজেরাই কোন রকমে ঘর তৈরি করে নিয়েছেন তাদের অবস্থা আরও করুন। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি এবং নিরাপত্তার অভাবে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে জীবন যাপন করছে এরা।

Bogra_Horizonসামান্যতম যে বেতন এরা পায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শহরের কাটনার পাড়ায় কটনমিল সংলগ্ন হরিজন কলোনীতে বসবাস করে ১০০ টি পরিবার। মোট লোকসংখ্যা ৫০০ জন। দীর্ঘদিন ধরে এই ৫০০ জন লোকের পানীয় জলের জন্য পৌরসভা থেকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২টি টিউবওয়েল। বাথরুম রয়েছে ৪টি। দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে সকালে প্রাতঃকার্য সমাধানের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় এখানে।

এমন অবস্থা অন্যান্য হরিজন কলোনীতেও। কাটনারপাড়া হরিজন কলোনীর বাসিন্দা শ্রী শিব প্রসাদ মন্টু হরিজন জানান, বারবার পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেও আমাদের সমস্যার সমাধান হয়নি। নিজেদের অর্থ না থাকায় স্বল্প সুবিধার মধ্যে আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। ৫০০ জন লোকের জন্য যেখানে ২০টি টিউবওয়েল দরকার সেখানে রয়েছে মাত্র দুটি।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সুখ দুঃখ দেখার জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করেছি। কিন্তু আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করার নূন্যতম সুযোগ সুবিধা আমরা পাই না। ১৯৬৫ সালে বগুড়া চকসুত্রাপুরে বৃহত্তম আদর্শ হরিজন কলোনী স্থাপিত হওয়ার পর থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সংস্কারের কাজ হয়নি এখানে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে জন সংখ্যা। পৌরসভা থেকে সে তুলনায় দেয়া হচ্ছে না কোন প্রয়োজনীয় উপকরণ।

চকসুত্রাপুর হরিজন কলোনীর নেতা শ্রী নিরধ হরিজন (৫৫) জানান, প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় বাড়ছে না তাদের কলোনীর এরিয়া।

তিনি জানান, অনতিবিলম্বে হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য বগুড়ায় আলাদা একটি জায়গা নির্ধারণ করা হোক। আবাসন সংকট এর সাথে সাথে এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও দারুন ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। শহরের কাটনার পাড়া, চকসুত্রাপুর, ষ্টেশন সংলগ্ন ও হাসপাতাল এলাকায় গড়ে উঠা হরিজন কলোনির অবস্থা আরও করুন। নূন্যতম চলাচলের রাস্তা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে চলাচলের দারুণ অসুবিধা পোহাতে হয়।

আলো বাতাস প্রবেশের কোন ব্যবস্থা নেই এদের বসত ঘরে। শুধু দরজা দিয়েই যতটুকু আলো বাতাস ঢুকে সেটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় এদের। ঘরের সাথেই চুলা তৈরি করে রান্না বান্না করার কারনে আগুনের ধোয়া বসত ঘর ভরতি তাকে সারাক্ষণ। এভাবে কষ্টের সাথে বসবাস করেই কাটছে বগুড়ায় হরিজনদের দিনকাল।