ঢাকা ০২:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে পরিবর্তনের হাওয়া

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • ২৪০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ধান নির্ভর বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষাবাদে লাগছে পরিবর্তনের হাওয়া। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলটিতে ধান চাষ অলাভজনক হওয়ায় আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষক। লোকসানে কৃষকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় বাঁচার তাগিদে চাষাবাদে তাদের আনতে হচ্ছে এমন পরিবর্তন।
শাক-সবজির পাশপাশি বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে কৃষক। আলু, ফুলকপি, বাধাকপি টমেটোসহ নানা রকম শাক-সবজি আবাদে ঘটেছে বিপ্লব। এমন সব জমি আছে আগে যেখানে ধান ছাড়া কিছু হতো না সেখানে এখন ফলদ বাগান। আম ছাড়াও পেয়ারা, বরই, থাই পেয়ারা, কাশ্মিরি আপেলকুল, মালটা, চায়না কমলা ড্রাগনের আবাদ হচ্ছে। বিদেশী ফুলের আবাদও শুরু হয়েছে। আম গাছের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, বরইয়ের মিশ্র বাগান গড়ে উঠছে। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে মাঠের চিত্র। যখন যে মওসুম সেই মওসুমের ফলের দৃষ্টি নন্দন বাগান এখন সহজেই চোখে পড়ছে।

বহুল আলোচিত পেঁয়াজ আবাদ করে গত বছর লোকসানের মুখে পড়লেও সেই পেঁয়াজেই এবার হাসি ফুটিয়েছে কৃষকের। গত বছর শুরুতে যখন বারো চৌদ্দ টাকা কেজিতে পেয়াজ বিক্রি করতে হয়েছে। এবার সেখানে মুড়ি বা ঢেমনা পেয়াজ বিক্রি করেছে পঞ্চাশ-ষাট টাকা কেজি। আবার ফুলকার দামও ভাল পেয়েছে। এখন সর্বত্র পেয়াজের ক্ষেত চোখে পড়ছে। কৃষি বিভাগ বলছে দাম বাড়ার কারণে পেয়াজের আবাদ বেড়েছে। আবাদ হচ্ছে ত্রিশ হজার হেক্টর জমিতে।
বরেন্দ্র এলাকা ঘোরার সময় বেশ কিছু স্থানে অন্যান্য ফসলের পাশপাশি কালোজিরার ক্ষেত নজর এড়ায় না। আবাদকারীরা জানালেন কৃষি পই্য হিসাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কালোজিরার আবাদ। তানোর উপজেলায় পাচন্দর গ্রামের চাষী নুরুল ইসলাম বলেন, কালোজিরা অন্য অনেক ফসলের তুলনায় খরচ ও ঝামেলা কম। আবার উৎপাদিত ফসল নিয়ে বিক্রি করতে কোন ঝামেলা নেই। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি খরচ পাঁচ হাজার টাকার মত। ফলন হয় তিন থেকে সাড়ে তিন মণ। আর বাজারে একমন কালোজিরার আট নয় হাজার টাকা। ফলে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন কালোজিরা আবাদে। এবার রাজশাহীতে তেত্রিশ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে।
রাজশাহীর পবার মাল্টা চাষী উজ্জল হোসেন বলেন, আগে ধান আবাদ করে লোকসান গুনেছি। এখন পেয়ারা মাল্টার বাগান করে লাভবান। পেয়ারা চাষী মনির হোসেন বলেন লোকসানের কারনে ধানের আবাদ বাদ দিয়ে এখন পেয়ারা আবাদে করে সফলতার কথা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসানর বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক দশকে একটু একটু করে বদলে গেছে বরেন্দ্রে আবাদের চালচিত্র। যেখানে দু’হাজার এগারো সালে আমের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে আট হাজার হেক্টর। যা এখন বেড়ে দাড়িয়েছে সাড়ে সতের হাজার হেক্টরে। একই সময়ে পেয়ারার বাগান ছিল ৬৮২ হেক্টর বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর। ২০১৬ সালে মাল্টার বাগানের পরিমান ছিল ২৫ হেক্টর তা বেড়ে বর্তমানে ১২৫ হেক্টর। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে একশো ষাট মে.টন। এভাবে সব ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষবাস মানেই ভ‚গর্ভস্থ পানি সেচ। বরেন্দ্র প্রকল্প হাজার হাজার গভীর নলকুপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে। এক ফসলী জমিকে রুপান্তর করেছে তিন ফসলী জমিতে। আর তা করতে গিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর চাপ বেড়েছে। আশঙ্কাজনক ভাবে নেমে গেছে পানির স্তর। কোথাও আর্সেনিক ভর করেছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যেসব ফসল আবাদের বেশী সেচ লাগে তা পরিহার করে ভিন্ন ফসল আবাদের প্রচারনায় নেমেছে তারা।

রাজশাহী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল হক বলেন, ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে কয়েক বছর ধরে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে তারা উদ্বুদ্ধ করেছেন। পানি সাশ্রয়ী ফসলের চাষ বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর তাতে এসেছে সফলতা। বেড়েছে সবজির চাষ। গত বছর ২২ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে সব্জির উৎপাদন হয় ১৮ দশমিক ১২ মে.টন।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আমন ও বোরো ধান করে তারা লোকসান দিয়ে নি:স্ব হয়েছেন। ধান চাষে বেশী খরচ লাগে আবার দামও পাওয়া যায় না। কিন্তু বাগান বা সবজি চাষে তেমনটি নেই। মওসুমে আগাম সবজি লাগিয়ে ভাল দাম পাওয়া যায়। আবার মওসুমে আবাদ করে দাম পাওয়া যায়। তারা আরো ভাল দাম পেতেন যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকত আর ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে পরিবর্তনের হাওয়া

আপডেট টাইম : ০৯:৪০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ধান নির্ভর বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষাবাদে লাগছে পরিবর্তনের হাওয়া। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলটিতে ধান চাষ অলাভজনক হওয়ায় আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষক। লোকসানে কৃষকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় বাঁচার তাগিদে চাষাবাদে তাদের আনতে হচ্ছে এমন পরিবর্তন।
শাক-সবজির পাশপাশি বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে কৃষক। আলু, ফুলকপি, বাধাকপি টমেটোসহ নানা রকম শাক-সবজি আবাদে ঘটেছে বিপ্লব। এমন সব জমি আছে আগে যেখানে ধান ছাড়া কিছু হতো না সেখানে এখন ফলদ বাগান। আম ছাড়াও পেয়ারা, বরই, থাই পেয়ারা, কাশ্মিরি আপেলকুল, মালটা, চায়না কমলা ড্রাগনের আবাদ হচ্ছে। বিদেশী ফুলের আবাদও শুরু হয়েছে। আম গাছের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, বরইয়ের মিশ্র বাগান গড়ে উঠছে। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে মাঠের চিত্র। যখন যে মওসুম সেই মওসুমের ফলের দৃষ্টি নন্দন বাগান এখন সহজেই চোখে পড়ছে।

বহুল আলোচিত পেঁয়াজ আবাদ করে গত বছর লোকসানের মুখে পড়লেও সেই পেঁয়াজেই এবার হাসি ফুটিয়েছে কৃষকের। গত বছর শুরুতে যখন বারো চৌদ্দ টাকা কেজিতে পেয়াজ বিক্রি করতে হয়েছে। এবার সেখানে মুড়ি বা ঢেমনা পেয়াজ বিক্রি করেছে পঞ্চাশ-ষাট টাকা কেজি। আবার ফুলকার দামও ভাল পেয়েছে। এখন সর্বত্র পেয়াজের ক্ষেত চোখে পড়ছে। কৃষি বিভাগ বলছে দাম বাড়ার কারণে পেয়াজের আবাদ বেড়েছে। আবাদ হচ্ছে ত্রিশ হজার হেক্টর জমিতে।
বরেন্দ্র এলাকা ঘোরার সময় বেশ কিছু স্থানে অন্যান্য ফসলের পাশপাশি কালোজিরার ক্ষেত নজর এড়ায় না। আবাদকারীরা জানালেন কৃষি পই্য হিসাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কালোজিরার আবাদ। তানোর উপজেলায় পাচন্দর গ্রামের চাষী নুরুল ইসলাম বলেন, কালোজিরা অন্য অনেক ফসলের তুলনায় খরচ ও ঝামেলা কম। আবার উৎপাদিত ফসল নিয়ে বিক্রি করতে কোন ঝামেলা নেই। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি খরচ পাঁচ হাজার টাকার মত। ফলন হয় তিন থেকে সাড়ে তিন মণ। আর বাজারে একমন কালোজিরার আট নয় হাজার টাকা। ফলে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন কালোজিরা আবাদে। এবার রাজশাহীতে তেত্রিশ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে।
রাজশাহীর পবার মাল্টা চাষী উজ্জল হোসেন বলেন, আগে ধান আবাদ করে লোকসান গুনেছি। এখন পেয়ারা মাল্টার বাগান করে লাভবান। পেয়ারা চাষী মনির হোসেন বলেন লোকসানের কারনে ধানের আবাদ বাদ দিয়ে এখন পেয়ারা আবাদে করে সফলতার কথা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসানর বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক দশকে একটু একটু করে বদলে গেছে বরেন্দ্রে আবাদের চালচিত্র। যেখানে দু’হাজার এগারো সালে আমের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে আট হাজার হেক্টর। যা এখন বেড়ে দাড়িয়েছে সাড়ে সতের হাজার হেক্টরে। একই সময়ে পেয়ারার বাগান ছিল ৬৮২ হেক্টর বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর। ২০১৬ সালে মাল্টার বাগানের পরিমান ছিল ২৫ হেক্টর তা বেড়ে বর্তমানে ১২৫ হেক্টর। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে একশো ষাট মে.টন। এভাবে সব ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষবাস মানেই ভ‚গর্ভস্থ পানি সেচ। বরেন্দ্র প্রকল্প হাজার হাজার গভীর নলকুপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে। এক ফসলী জমিকে রুপান্তর করেছে তিন ফসলী জমিতে। আর তা করতে গিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর চাপ বেড়েছে। আশঙ্কাজনক ভাবে নেমে গেছে পানির স্তর। কোথাও আর্সেনিক ভর করেছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যেসব ফসল আবাদের বেশী সেচ লাগে তা পরিহার করে ভিন্ন ফসল আবাদের প্রচারনায় নেমেছে তারা।

রাজশাহী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল হক বলেন, ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে কয়েক বছর ধরে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে তারা উদ্বুদ্ধ করেছেন। পানি সাশ্রয়ী ফসলের চাষ বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর তাতে এসেছে সফলতা। বেড়েছে সবজির চাষ। গত বছর ২২ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে সব্জির উৎপাদন হয় ১৮ দশমিক ১২ মে.টন।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আমন ও বোরো ধান করে তারা লোকসান দিয়ে নি:স্ব হয়েছেন। ধান চাষে বেশী খরচ লাগে আবার দামও পাওয়া যায় না। কিন্তু বাগান বা সবজি চাষে তেমনটি নেই। মওসুমে আগাম সবজি লাগিয়ে ভাল দাম পাওয়া যায়। আবার মওসুমে আবাদ করে দাম পাওয়া যায়। তারা আরো ভাল দাম পেতেন যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকত আর ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত।