কুষ্টিয়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের প্রত্যন্ত জনপদ আটিগ্রাম। এ গ্রামের মাঝামাঝি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলফাজ উদ্দিন আহমদের রয়েছে এক বিশাল বাঁশবাগান। আর এ বাঁশবাগান এখন হাজারো দেশি-বিদেশি পাখির অভয়াশ্রম।
আটিগ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা সরু রাস্তা। এর একপাশে আলফাজ মাস্টারের বাড়ি। অপর পাশে ৮ থেকে ৯ বিঘা আয়তনের দৃষ্টিনন্দন বাঁশবাগান। এ বাগানের ভিতরে ১৫টি শিমুল ও ১০টি শিশু গাছসহ বেশ কয়েকটি আমগাছ রয়েছে। এসব গাছেই বাসা বেঁধেছে অতিথি পাখিরা। বর্তমানে এ বাঁশবাগানে পাঁচ হাজারেরও বেশি অতিথি পাখির বসবাস। এছাড়া অসংখ্য দেশি পাখি তো আছেই।
আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাগানে অনেক আগে থেকেই বাদুর, বক, কাক, শালিকসহ নানা জাতের পাখি বাস করত। তবে ২০০৩ সালের শীত মৌসুমে কিছু অতিথি পাখি আমার এ বাগানে আসে। ওই বছর শীত শেষে পাখিগুলো বাগান ছেড়ে চলে যায়। পরের বছর শীতের সময় ওই পাখিগুলো আবার আসে। তবে সে বছর শীত শেষে ৫-৬শ পাখি থেকে যায় এখানে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সব সময়ই পাখি ভালোবাসতাম। তাই বাগানে আসা পাখিগুলোকে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। ওদের যাতে কেউ মারতে না পারে বা বিরক্ত না করে, সেদিকে আমার সজাগ দৃষ্টি ছিল। এতেই বোধহয় পাখিগুলো বাগানে বসবাসের জন্য আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। পরে প্রজনন মৌসুমে মা পাখিরা বাগানের বিভিন্ন গাছের ডালে বাসা বাঁধে। কিছুদিনের মধ্যেই সেসব বাসা ভরে যায় পাখির ছানায়। এভাবে ৭ থেকে ৮ বছরের ব্যবধানে আজ পাঁচ হাজার পাখি রয়েছে এ বাগানে।’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফজরের আজানের পরপরই বয়স্ক পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে এবং ফিরে আসে খাবারসহ। বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। এভাবে সারাদিন চলে আসা-যাওয়া। তবে সন্ধ্যার কিছু আগে একসঙ্গে ফিরে আসে সব পাখি। তারা যখন একসঙ্গে দল বেঁধে ফিরে আসে তখন তাদের ডানার শব্দ আর বাচ্চাদের কিচিরমিচির শব্দ গোটা বাঁশবাগানকে মুখরিত করে তোলে। তবে কেবল অতিথি পাখি নয়, বাগানে দেশি পাখি যেমন, বুলবুলি, পাপিয়া,পাতি কাঠ ঠোকরা, ক্ষুদে কাঠ ঠোকরা, শঙ্খচিল, ভুবনচিল, বেনে বউ, সিপাই বুলবুলি, ধলা খঞ্জনি, বড় পানকৌড়ি, ল্যাঞ্জা লাটোরা, খয়েরি কসাই পাখি, কাঠ শালিক, কোকিলসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, পাখিগুলো এখানে থাকার কারণে কিছু উপকার হয়েছে। আগে এখানে সাপ ও জোঁকের উপদ্রব ছিল, সেগুলো এখন আর দেখা যায় না। আবার কিছু ক্ষতিও হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে মা পাখিগুলো বিভিন্ন গাছের পাতা ছিঁড়ে এনে বাসা বানায়। এতে অনেক গাছই এখন ন্যাড়া হতে চলেছে। তবে আলফাজ মাস্টারের পরশে সব মানুষই এখন পাখিপ্রেমী মানুষ হয়ে উঠছেন। এ কারণে তারা পাখির এই উপদ্রব হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন। গ্রামের মানুষ পাখি সংরক্ষণের ব্যাপারে এখন আলফাজ উদ্দিনের সঙ্গে একমত পোষণ করে। বন্দুক হাতে কোনো শিকারি ওই গ্রামে ঢুকতে পারে না।
পাখিপ্রেমী আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষক হিসেবে গ্রামের মানুষ আমাকে বেশ সম্মান করে। আমার কথা মান্য করে। গ্রামের মানুষের সহযোগিতা না পেলে হয়তো পাখির এ অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে পারতাম না। সবাই যদি পাখির প্রতি সামান্য ভালোবাসা প্রদর্শন করত তাহলে হয়তো আমাদের গ্রামগুলো পাখিদের কুহু-কুজনে আবার ভরে উঠত।’
কুষ্টিয়া বার্ড ক্লাবের সভাপতি এস আই সোহেল বলেন,‘ এখানে যে অতিথি পাখিগুলো আছে তা সাড়া বাংলাদেশে হাতে গোনা দু-তিনটি অঞ্চলে দেখা যায়। তাই এ পখিগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা অতি জরুরি।’