হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৯৭ সাল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত সরকারের মানব উন্নয়ন সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক আলোচনা সভা: রবীন্দ্রনাথ ও সমকাল। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুজন বিদগ্ধ রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক এবং অধ্যাপক ড. রফিক উল্লাহ খান। প্রথম সাক্ষাতেই আপন হয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ড. রফিক উল্লাহ খান। যাই হোক, আপাতত সে-কথা থাক।
২০০৭ সালে পয়লা বৈশাখের আগে ঢাকা গিয়ে লক্ষ্য করেছিলাম, একক উদ্যোগে কীভাবে তাঁর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা এক অসাধারণ সুন্দর সারাদিনব্যাপী নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য। পরবর্তী সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন সময় দেখেছি, বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকটে; বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল আক্রমণ অথবা অগ্নিকাণ্ড পরবর্তীকালে তিনি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। গিয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আবার পাশাপাশি দেখেছি, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোন বাউলের জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা।
বিভিন্ন সময় আরো লক্ষ্য করেছি, তাঁর মধ্যে এক শিশুসুলভ এবং ছাত্রবান্ধব মন রয়েছে। অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খানের ঘড়ের দরজা তাই সব সময় ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে প্রবেশ করবার জন্য কখনও কাউকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। লক্ষ্য করেছি, ঢাকার বাইরে থেকে আসা ছেলেমেয়েদের যে কোন বিপদ-আপদে তাঁর ব্যস্ততা; এমনকি তাঁদের আবদার রক্ষ করা! বহুবার দেখেছি, তিনি নিজের পকেটের পয়সায় হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে তাঁদের পেট ভরে খাইয়েছেন। আবার প্রয়োজনে বিনা নোটিশে তাঁদের বাসায় নিয়ে রেখেছেন।
বিভিন্ন সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে অতুলনীয় এবং অত্যন্ত আপন। এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতির কারণে। একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়- সম্ভবত ২০০২ কিংবা ২০০৩ সাল। একবার বাংলাদেশ ভ্রমণে গিয়ে ইচ্ছে হলো, স্যারের ক্লাস করার। একদিন সুযোগ মিলল। সেদিন স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। কিছুটা সময় গড়ানোর পরে মনে হচ্ছিল যেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেই ছাত্রদের সামনে তাঁর মহাকাব্য নিয়ে আলোচনা করছেন। আবার যখন তিনি রাবণের চরিত্র বোঝাছিলেন, তখন তাঁর অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল লঙ্কা থেকে স্বয়ং রাবণ এসে তাঁর চরিত্র তুলে ধরছেন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক যশপাল একটি কথা বারবার উল্লেখ করতেন: ‘কোন কিছু পড়ানোর আগে যদি নিজেকে সেই চরিত্রের সাথে কিংবা বিষয়টির সাথে মিলিয়ে নেয়া যায় সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পড়াশোনাটা আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।’
সেদিন স্যারের সেই আপাত বাক্যটি অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খানের ক্লাসের পাঠদান প্রক্রিয়া দেখে আমার মনে হয়েছিল তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর এক ছাত্রের মুখে শুনেছিলাম, যখন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চলছে, একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের গুলিতে দুজন ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। পরদিন তিনি ক্লাসে ঢুকে বলেছিলেন ‘এখন মানুষের চেতনা কেমন নিশ্চল। গতকাল দুজন ছাত্র মারা যাওয়ার পরও তোমরা সকলে এখন ক্লাস করছ! কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তোমাদের মনে!’
হয়তো এই বোধদয়ের কারণেই তিনি একজন শিক্ষকের পাশাপাশি একজন মননশীলন লেখক হিসেবেও সমগ্র বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন।
তিনি দক্ষ প্রশাসকও বটে। সে অভিজ্ঞতা বহুবার তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বচোক্ষে দেখেছি। তিনি যখন শিক্ষক সমিতির নীল দলের কনভেনার ছিলেন, তখন দেখেছি কীভাবে তিনি সামনে থেকে শিক্ষকদের নেতৃত্ব দিতেন। আবার তিনি যখন গাজীপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন তখন দেখেছি তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। কীভাবে এই প্রকল্প সুন্দর এবং পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা যায় সবসময় ভাবতেন। তিনি জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকদের নিয়ে জমি জরিপ করিয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত নিতেন সেখানে কী ধরনের গাছ লাগানো যায়। পুরো প্রকল্প এলাকাটির বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ তিনি করেছিলেন বিভিন্ন গাছপালার নামে। আবার দেখেছি তাঁর আন্দোলন ক্ষমতা যখন ২০০৪ সালে, তাঁর নিজের শিক্ষক ও সহকর্মী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মৌলবাদীর আক্রমণের পর। তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও সামিল হয়েছিলেন। অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তিনি একজন স্বাধীনচেতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এবং একজন মুক্তচিন্তক। পরবর্তী সময় যখন মৌলবাদীদের দ্বারা বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্লগার হত্যা হয় তখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধেও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন আয়োজিত হয়। যার মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যপ্রেমীদের এক ছায়াতলে নিয়ে আসা।
রফিক উল্লাহ খান ব্যতিক্রমী মননশীল লেখক অবশ্যই। তিনি রচনা করেন ‘হাসান হাফিজুর রহমান : জীবন ও সাহিত্য’। ‘মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’ (১৯৮৫) ও ‘কবিতা ও সমাজ’ (১৯৮৫) শীর্ষক দু’টি গ্রন্থ তাঁর লেখা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো একত্রিত করলে আমার ধারণা কয়েক খণ্ড রচনাবলি প্রকাশ হয়ে যাবে। শৈশব কাল থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা এবং নিবন্ধ লেখা শুরু করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা তিনি ইচ্ছা করলে কবিতা, উপন্যাসেও পারদর্শীতা দেখাতে পারতেন। আমার ধারণা বাংলাদেশের প্রায় সকল উপন্যাস তাঁর পাঠ করা। কারণ তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলাদেশের উপন্যাস: বিষয় ও শিল্পরূপ। যা বর্তমান সময় শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বাংলাদেশের উপন্যাস সম্পর্কে জানা ও বোঝার জন্য একমাত্র দলিল। তিনি তাঁর একাধিক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা কতটা তাৎপর্যবাহী। বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনি এবং ড. আহমদ রফিক মিলে গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির মধ্যে রবীন্দ্র অধ্যয়ন ও রবীন্দ্র চেতনা জাগ্রত করা।
এসব কারণেই ২০১৮ সালে নেত্রকোণায় প্রতিষ্ঠিত শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। করেই বলতে পারেন: ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু সনদ প্রদান আমার দায়িত্ব নয়। আমি চাই এই সমাজ এবং দেশের জন্য পরিপূর্ণ মানুষ গড়ে তুলতে।’ ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে গিয়ে উপলব্ধি করেছি এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারি চিন্তা।
সবশেষে বলতে চাই, তিনি ছাত্রবান্ধব, স্পষ্ট ভাষী ও দিলখোলা মানুষ। প্রাণবন্ত এই ব্যক্তি বাংলা সাহিত্যের আসরে এবং বিশ্বসাহিত্য দুনিয়ার এক অগ্রপথিক। তিনি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন তাঁর লেখা এবং তাঁর জীবন বোধের মাধ্যমে। তিনি ঠিক করে দিতে পারেন তাঁদের জীবনের লক্ষ্য। তিনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাই পাশে দাঁড়াতে পারেন অসহায় মানুষের। বর্তমান সময় এই স্বার্থপর মানুষের দুনিয়ায় তিনি নিঃস্বার্থ ও দয়াবান মানুষ। তাই আজ তিনি সমগ্র বাংলাদেশের যুবসমাজের কাছে পরিণত হয়েছেন প্রিয়মুখ হিসেবে। আজ ২১ জানুয়ারি তাঁর ৬৩তম জন্মদিনে আমি আশারাখি, তিনি আরো দীর্ঘদিন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রেরণা দান করবেন। একইসঙ্গে আরো সাহিত্য চর্চা করে নতুন প্রজন্মকে নতুন দিশা দেখাবেন। আমার প্রিয় রফিকদার প্রতি রইল ৬৩টি গোলাপের শ্রদ্ধার্ঘ্য।