ঢাকা ০১:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেসব কারণে রোগ সারাতে পারছে না অ্যান্টিবায়োটিক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:২৩:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৯
  • ২৫৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। এসব অ্যান্টিবায়োটিক মূলত মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও জখম সারানোসহ নানা ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে অন্য ওষুধও। গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে শিশু ও হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাকির হোসাইন হাবিব দেশের ৯টি মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন।

গবেষণায় তিনি দেখেছেন, দেশে গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্তত ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে গেছে। অর্থাৎ, এগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে গেছে, যার মানে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী হয়ে ওঠা। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এমন অবস্থায় রোগীদের ওপর রিজার্ভ, অর্থাৎ প্রচলিত নয় এমন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ বেড়ে গেছে।

ডা. হাবিব জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, জীবাণুর মধ্যে ক্ষত সংক্রমণ জীবাণু প্রায় ৫৭ শতাংশ সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ এগুলো প্রচলিত ওষুধ দিয়ে সারানো সম্ভব হচ্ছিল না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই মানে না।

কয়েকটি কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ হলো-প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করা, প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক, ভাইরাসজনিত কোনো অসুখে, অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এমনি সেরে যেত, সেখানে বিশেষ করে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে তা আর কাজ করে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রোগ সারাতে না পারার পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ডা. হাবিব বলেন, বাংলাদেশে বহু মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন না হয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। তাদের মধ্যে ধারণাই নেই যে এর ফলে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোনো সংক্রমণ হলে সেটা আর কোনো ওষুধে সারবে না। ফলে যে অ্যান্টিবায়োটিককে মনে করা হতো যেকোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ, তা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজই করছে না।

অধ্যাপক তাহমিনা বলছেন, আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে। সেটা হলো, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর ওপরেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। ফলে আমরা যা খাই- সবজি, ফল বা মাছ মাংসের মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেকগুলো থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন- মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, খাসির মাংস, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় রোগ প্রতিরোধের জন্য, শাক-সবজি যদিও এতে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না, তবে কীটনাশক দেয়া হয়।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, এর ফলে শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।

ঢাকার আহসানিয়া মিশন জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাসুমা নাওয়ার বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে প্রথমত পরিবার থেকে যদি নিশ্চিত করা যায় যে বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না, তাহলে এ সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে। দ্বিতীয়ত ডোজ শেষ করতে হবে, মানে অসুখ একটু প্রশমন হলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, বিনা প্রয়োজনে বা অল্প অসুখে ঘাবড়ে গিয়ে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের স্বল্প শিক্ষিত মানুষেরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, কারণ তারা জানেও না বিষয়টির ভয়াবহতা। এক্ষেত্রে সরকারকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

যেসব কারণে রোগ সারাতে পারছে না অ্যান্টিবায়োটিক

আপডেট টাইম : ০৯:২৩:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। এসব অ্যান্টিবায়োটিক মূলত মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও জখম সারানোসহ নানা ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে অন্য ওষুধও। গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে শিশু ও হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাকির হোসাইন হাবিব দেশের ৯টি মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন।

গবেষণায় তিনি দেখেছেন, দেশে গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্তত ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে গেছে। অর্থাৎ, এগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে গেছে, যার মানে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী হয়ে ওঠা। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এমন অবস্থায় রোগীদের ওপর রিজার্ভ, অর্থাৎ প্রচলিত নয় এমন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ বেড়ে গেছে।

ডা. হাবিব জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, জীবাণুর মধ্যে ক্ষত সংক্রমণ জীবাণু প্রায় ৫৭ শতাংশ সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ এগুলো প্রচলিত ওষুধ দিয়ে সারানো সম্ভব হচ্ছিল না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই মানে না।

কয়েকটি কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ হলো-প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করা, প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক, ভাইরাসজনিত কোনো অসুখে, অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এমনি সেরে যেত, সেখানে বিশেষ করে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে তা আর কাজ করে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রোগ সারাতে না পারার পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ডা. হাবিব বলেন, বাংলাদেশে বহু মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন না হয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। তাদের মধ্যে ধারণাই নেই যে এর ফলে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোনো সংক্রমণ হলে সেটা আর কোনো ওষুধে সারবে না। ফলে যে অ্যান্টিবায়োটিককে মনে করা হতো যেকোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ, তা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজই করছে না।

অধ্যাপক তাহমিনা বলছেন, আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে। সেটা হলো, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর ওপরেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। ফলে আমরা যা খাই- সবজি, ফল বা মাছ মাংসের মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেকগুলো থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন- মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, খাসির মাংস, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় রোগ প্রতিরোধের জন্য, শাক-সবজি যদিও এতে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না, তবে কীটনাশক দেয়া হয়।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, এর ফলে শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।

ঢাকার আহসানিয়া মিশন জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাসুমা নাওয়ার বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে প্রথমত পরিবার থেকে যদি নিশ্চিত করা যায় যে বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না, তাহলে এ সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে। দ্বিতীয়ত ডোজ শেষ করতে হবে, মানে অসুখ একটু প্রশমন হলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, বিনা প্রয়োজনে বা অল্প অসুখে ঘাবড়ে গিয়ে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের স্বল্প শিক্ষিত মানুষেরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, কারণ তারা জানেও না বিষয়টির ভয়াবহতা। এক্ষেত্রে সরকারকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।