ফুটপাথে উড়ছে টাকা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রভাব পড়েনি

রাজধানীর ফুটপাথে টাকা উড়ছে। চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকার ভাগিদার স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা, মাস্তান, স্থানীয় প্রভাবশালী, পুলিশ ও লাইনম্যানরা। দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের হাওয়া ফুটপাথে এখনও লাগেনি। আগের মতোই উড়ছে টাকা।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথ থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা চাঁদা তুলছে লাইনম্যান নামধারী চিহ্নিত চাঁদাবাজরা। এই টাকার ভাগ পাচ্ছেন অনেকেই। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের প্রভাবে এই চাঁদাবাজি কখনও বন্ধ হয় না। বরং ঈদ এলে বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ফুটপাথ উচ্ছেদ অভিযানও সফলতার মুখ দেখে না রাজনীতিকদের কারণেই। বরং একবার উচ্ছেদ হলে আবার সেই জায়গা দখলে নিতে দ্বিধা করে না দখলদাররা।
রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তানে ফুটপাথ আছে ৩০টি। এসব ফুটপাথে হকার বসে প্রায় ৫ হাজার। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০২ জন হকার সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত। গুলিস্তানে বেশিরভাগ হকারই রাস্তা দখল করে দোকান বসায়। এসব হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় কমপক্ষে লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ লাখ। একইভাবে পল্টন এলাকায় হকার বসে প্রায় ১০ হাজার। এসব হকারের কাছে থেকে দোকানপ্রতি ২শ’ টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় কমপক্ষে ২ লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ ৬০ লাখ। মতিঝিল এলাকা থেকেও দিনে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
ফার্মগেট এলাকার ইন্দিরা রোড, কাঠালবাগান রোড, নাখালপাড়া এলাকার হকারদের কাছে থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। নিউমার্কেট, গাউসিয়া, বলাকা সিনেমা হলের সামনেসহ এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় হকার বসে কমপক্ষে ৮ হাজার। এসব হকারদের কাছে থেকে দিনে চাঁদা তোলা হয় কমপক্ষে আড়াই লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ লাখ টাকা। পুরান ঢাকার সদরঘাটের ফুটপাথ থেকে দিনে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। মাস শেষে যার পরিমাণ ৯০ লাখ টাকা। যাত্রাবাড়ী ও জুরাইন এলাকার ফুটপাথ থেকেও একইভাবে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। মহাখালী এলাকা থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সবমিলে রাজধানীত প্রতিদিন চাঁদা উঠছে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। মাসে যার পরিমাণ কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা।

হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুলিস্তানের ৩০টি ফুটপাথে চাঁদা তোলার জন্য ৩০ জন লাইনম্যান আছে। প্রতিটি লাইনম্যানের আবার একজন করে সহকারী আছে। লাইনম্যান ও তাদের সহকারী মিলে ৬০ জনের আবার একজন নেতা, একজন ক্যাশিয়ার ও একজন সহকারী আছে। এই ৬০ জনের নেতার নাম বাবুল। ক্যাশিয়ার দুলাল এবং তাদের সহকারীর নাম আমীন। ৬০ জনের এই সিন্ডিকেটের রক্ষাকবজ ২০ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক হান্নান। এরা দুজনেই যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ। অবশ্য হান্নানকে সবাই সাবেক বিএনপি নেতা হিসাবেই জানে। যুবলীগের একজন নেতা জানান, বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলার ঘটনায় হান্নানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। সেই হান্নান সম্রাটের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ওয়ার্ড যুবলীগের পদ বাগিয়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। গুলিস্তানের ফুটপাথ ওই টাকার অন্যতম প্রধান উৎস।
হকাররা জানান, গুলিস্তানের ফুটপাথের প্রতিটি দোকান থেকে দেড়শ’ থেকে দুশ’ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। স্থানভেদে কোনো কোনো এলাকার চাঁদার হার তিনশ’ টাকা। যারা সরাসরি এই চাঁদা তোলে তারা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাইনম্যান নামধারী এসব চাঁদাবাজের পেছনে ওয়ার্ড যুবলীগের ওই দুই নেতা ছাড়াও রয়েছেন ২০ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি রাহাত। এ কারণে চাঁদা উত্তোলনকারী লাইনম্যানরা কাউকে তোয়াক্কা করে না। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে লাইনম্যানরা হকারদের লাঠিপেটা করতেও ছাড়ে না।
অনুসন্ধানে গুলিস্তানের লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের নাম জানা গেছে। এরা নিজ নিজ দখলে থাকা ফুটপাথ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তোলে। এরা হলো, আমীর হোসেন, ভোলা, কানা সিরাজ, লম্বা হারুন, হারুনের শ্যালক দেলোয়ার, খোরশেদ, হাসান, হিন্দু বাবুল, রব, সুলতান, লিপু, মনির, তরিক আলী, আখতার, জাহাঙ্গীর, কালা নবী, সর্দার ছালাম, শহীদ, দাড়িওয়ালা সালাম, আলী মিয়া, কাদের, খলিল, জাহাঙ্গীর, নসু, তমিজ উদ্দিন, বাবুল ভূঁইয়া, সাজু, কবির হোসেন, ঘাউরা বাবুল ও বিমল।
হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে এরা তৎপর হয়ে ওঠে। সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এমনকি উচ্ছেদ অভিযান পন্ড করার জন্য তারা ‘মাস্তান’ বাহিনীও ঠিক করে রাখে। এজন্য এরা লাখ লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না। আলাপকালে একজন লাইনম্যান জানান, ফুটপাথে কেউ ইচ্ছা করলেই চাঁদাবাজি করতে পারে না। এজন্য নেতার অনুমতি লাগে। পেছনে নেতা লাগে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হকার বলেন, পুলিশ লাইনম্যানদের কথায় চলে।
এদিকে, ফুটপাথ দখল করে পথচারীদের যাতায়াতে যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সেজন্য হলিডে মার্কেট চালু করা হয়। রাজধানীর পল্টন থানাধীন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনেসহ ৫টি স্থানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই হলিডে মার্কেট বসার কথা। হকাররা জানান, সিটি কর্পোরেশনের অনুমতির পরেও সেই হলিডে মার্কেটে বসতে দেয় না পুলিশ। বরং বাকি ৫ কার্যদিবসে হকাররা ফুটপাথ ও রাস্তা দখল করে ব্যবসা করছে। জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলে নারী নির্যাতনসহ বহু মামলার আসামী সাইফুল মোল্লা, তার ছেলে শিবলু, টিপু, বাচ্চু, রতন, শাজাহান ও সেকান্দার। এরা হকারদের কাছে থেকে দোকানপ্রতি ৩শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের পেছনে রয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনসুর, বিদেশে পলাতক বরখাস্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ ও মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি শহীদ রেজা বাচ্চু।
মতিঝিল এলাকার ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলে মকবুল, আজাদ, গাঁজা ব্যবসায়ী হারুন, তাজু ও তার ছেলে বাবলু, ফারুক, মান্নান, বরকত ও নুর ইসলাম। মতিঝিল আলীকোর সামনে থেকে চাঁদা তোলে ছাদেক এবং সোনালী ব্যাংকের পশ্চিম থেকে চাঁদা তোলে রহিম। একইভাবে বায়তুল মোকাররম মসজিদের স্বর্ণ মার্কেটের ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলে চাঁটগাইয়া হারুন, খোকন মজুমদার, আবুল হাশেম, মনির, দাইয়া, রহিম, ওসমান সাজু, বিল্লাল, আল আমিন, তার ভাই শাহীন, জয়নাল, গাইড়া বাবুল, লম্বা শাজাহান, মোহন, মানিক ও হিন্দু শাহীন। হকাররা জানান, এই এলাকার জন্য পুলিশের সোর্স হিসাবে কাজ করে ১৮ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি দুলাল। যাত্রাবাড়ীতে চাঁদা তোলে সোনা মিয়া, মান্নান, তোরাব আলী। এদের নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনু। নিউমার্কেটে চাঁদা তোলে ইব্রাহিম, ছাত্তার মোল্লা, নুর ইসলাম, ইসমাইল। এদের নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা ইব্রাহীম ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসীম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার ফুটপাথের চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রহমান মিয়াজি, সুত্রাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ, নুর ইসলাম নুরু এবং জামাল নূর। মহাখালীতে চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছেন হাশেম ও মোমিন মুন্সী। ফার্মগেট এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম।
ফুটপাথে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স লীগ ও বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাসেম বলেন, আমি বরাবরাই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের রাস্তা, জিপিও লিঙ্ক রোডসহ ৫টি স্থানে হলিডে মার্কেট বসানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল এসব মার্কেট থেকে কোনো চাঁদাবাজি করা যাবে না। কিন্তু পুলিশ অন্যায়ভাবে হকারদেরকে হলিডে মার্কেট বসাতে দিচ্ছে না। বরং পুলিশের ছাত্রছায়ায় চিহ্নিত চাঁদাবাজরা হকারদের কাছে থেকে চাঁদা তুলছে। আমরা চাই এটা বন্ধ হোক। তিনি লাইনম্যান নামধারী চিহ্নিত চাঁদাবাজদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, এদেরকে বাইরে রেখে কোনোভাবেই চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাবে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর