হাওর বার্তা ডেস্কঃ হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। কোরআন-হাদিসের আলোকে যে কয়টি মাস বিশেষ তাৎপর্যের এর অন্যতম এই মহররম। বিশেষ করে মহররমের ১০ তারিখ যা ‘আশুরা’ হিসেবে পরিচিত, এদিন আল্লাহর রহমত ও বরকতের ধারা চালু হয়। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজাই ছিল মুসলমানদের ওপর ফরজ। পরবর্তী সময়ে এই দিনের রোজাকে নফল করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, এদিন রোজা রাখলে আল্লাহর অনুগ্রহে পেছনের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। অনেকেরই ধারণা রাসুলের দৌহিত্র হোসাইন (রা.) শহীদ হওয়ার কারণেই এদিনের মর্যাদা। অথচ এটা সঠিক নয়। রাসুল (সা.) অনেক আগেই এদিনের তাৎপর্যের কথা বলেছেন, কোরআনেও এর কথা উল্লেখ হয়েছে। আর হোসাইন (রা.)-এর শহীদ হওয়ার ঘটনা রাসুলের ইন্তেকালের প্রায় ৬০ বছর পরে। তবে কারবালার ঘটনা এদিনের তাৎপর্যকে আরও বাড়িয়েছে।
আশুরার দিনটিকে অন্যদিনের ওপর কেন প্রাধান্য দিয়েছেন এর আসল কারণ আল্লাহই ভালো জানেন। এটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজনও নেই। লোকমুখে প্রসিদ্ধ, এদিনে বিভিন্ন নবীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটেছে। কেয়ামতও এদিনে হবে। কিন্তু এসবের পক্ষে শক্তিশালী কোনো প্রমাণ নেই। শুধু ফেরআউনের কবল থেকে মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি এদিনে হয়েছে বলে শক্তিশালী বর্ণনা পাওয়া যায়। মূলত, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে যেকোনো দিনকে অন্য দিনের ওপর মর্যাদা ও প্রাধান্য দিতে পারেন। আমাদের উচিত সেদিনের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য বুঝে এর ওপর আমল করা। যেহেতু আল্লাহ এ দিনটিকে তার রহমত ও বরকতের জন্য নাজিল করেছেন এ জন্য এদিনের পবিত্রতা হলো, দিনটি এমনভাবে কাটাবে যেভাবে কাটানোর কথা রাসুলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সুন্নত হিসেবে এদিনে শুধু রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, এদিন রোজা রাখলে সারা বছরের গোনাহের প্রতিদান হয়ে যায়। তবে রাসুলের নির্দেশ হলো ইহুদিদের সামঞ্জস্য থেকে বাঁচার জন্য ১০ মহররমের সঙ্গে আগে-পরে মিলিয়ে আরও একদিনের রোজা রাখা। তবে কেউ শুধু আশুরার রোজা রাখলে গোনাহগার হবে না।
আশুরার দিন রোজা ছাড়া অন্য কোনো আমলের কথা জোরালোভাবে প্রমাণিত না। যেমন অনেকেই মনে করেন আশুরার দিন শিন্নি পাকিয়ে বিতরণ করতে হবে। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। তবে একটি দুর্বল হাদিসের সূত্রে উল্লেখ আছে, যিনি এদিন পরিবার-পরিজন ও অধীনস্তদের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবেন আল্লাহ তার উপার্জনে বরকত দেবেন। হাদিসটি সূত্রের দিক থেকে ততটা শক্তিশালী না হলেও এটি আমলে কোনো বাধা নেই। বরং এটা করলে আল্লাহর রহমত লাভের আশা করা যায়। বরং দিনটি আল্লাহর ইবাদত, তাকে স্মরণ এবং রোজা রেখে কাটাবে। পবিত্র আশুরার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে এসে একটি ট্রাজেডি যুক্ত হয়েছে, যা ঐতিহাসিক কারবালা ট্রাজেডি হিসেবে প্রসিদ্ধ। এদিন কারবালা প্রান্তরে রাসুলের দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে শহীদ হন এজিদ বাহিনীর হাতে। মূলত অসৎ চরিত্রের এজিদকে মেনে না নেওয়ার কারণেই সেদিন হোসাইন (রা.)কে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এজিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন হোসাইন (রা.) তার আদর্শে অবিচল থেকেছেন। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েও আপস করেননি। তিনি চেয়েছিলেন সত্য, ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্যই তিনি জগদ্বাসীর জন্য আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন।
এই কারবালার ঘটনায় আমাদের জন্য রয়েছে মহান শিক্ষা। জীবনচলার অনন্য পাথেয়। ফোরাতের কূলঘেঁষে বিস্তৃত কারবালা আজও নীরব ভাষায় মুসলিম উম্মাহকে আহ্বান করছে। সেই আহ্বান হলো অসৎ চরিত্রের রক্তচোখে আতঙ্কিত না হওয়ার। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার। শান্তি ও নিরাপত্তার অন্তরায় মানবতাবিরোধী অভিশপ্তদের সঙ্গে আমরণ সংগ্রাম করার। কবির ভাষায় আশুরার শিক্ষা হলো, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না।’ আল্লাহর যে মহাসত্যকে জগতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হোসাইন (রা.)সহ অসংখ্য মহামানব আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই ইসলামকে যাবতীয় কুসংস্কার, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করার সংকল্প করতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। ঘটনাবহুল আশুরা থেকে নিজের জীবনচলার কিছু পাথেয় জোগাড় করতে পারলেই এর তাৎপর্য ও শিক্ষার মূল্যায়ন করা হবে।