ঢাকা ০৬:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী শিক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০৮:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০১৯
  • ২৯৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পবিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে পড়াশোনা করতে, জ্ঞানার্জনে ব্রতী হয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও জ্ঞান শিক্ষার যোগ্যতা এককভাবে পুরুষদের দেওয়া হয়নি। আর সে জন্য মহানবী (সা.) দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছেন ‘প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ। অবশ্য কর্তব্য। তাঁর অনুসারীরা মূর্খ হোক এমন কামনা করেননি আল্লাহর রাসুল। তাই তিনি সাবধান করে বলেছিলেন, ‘মূর্খতা অপেক্ষা বড় দরিদ্রতা আর নেই।’ ‘জ্ঞানীর নিদ্রা মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা উত্তম।’ সম্প্রতি আমাদের দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

অথচ ১৪০০ বছর আগে আরবের মাটিতে উম্মিনবী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষা গ্রহণকে ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিদুষী নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে শিক্ষানুরাগী মহিলারা একবার বললেন, ‘আপনি জ্ঞানশিক্ষা দেওয়ার জন্য সবসময় পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। তাই আমাদের জন্য একদিন নির্দিষ্ট করুন।’ মহানবী তদনুসারে তাদের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়েও নারীদের শিক্ষা দিতেন। ফলস্বরূপ অনেক মহিলা পতের উদয় হয়েছিল, যারা ইসলামের মহান শিক্ষা প্রচারে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন হজরত আয়েশা সাফিয়া, উম্মে সালমা, ফাতিয়া বিনতে কায়েস, সৈয়িদা নাফিসা, উম্মে আদদারদা, আয়শা বিনতে সাদ, জয়নাব বিনতে সালমা, রসুলের কন্যা ফাতেমা জোহরা, উম্মে আতিয়া, শিমা, সাকিনা, উম্মে হাবিবা, উম্মে সারিক, উম্মে ইউসুফ প্রমুখ। ইসলামি দর্শন ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন তখনকার মহিলারা। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মহিলাদের অসামান্য অবদান ছিল। খলিফাদের শাসনকালেও নারীরা শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য, কাব্যচর্চা ও সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইসলামি দর্শন নারী শিক্ষার উৎসাহদাতা ও পথপ্রদর্শক। ইসলামে নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত এমন বহুল প্রচারিত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মানবজাতির অর্ধাংশ নারী জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত দ্বিচক্র বিশিষ্ট এ মানব সমাজের এক চাকা দুর্বল হলে তার গতি শ্লথ হতে বাধ্য। নিজেদের অজ্ঞানতাহেতু এ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণের উজ্জ্বল ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে যান।

তাই এদেশে নারী শিক্ষা বলতে অর্থ না বুঝে তোতা পাখির মতো কোরআন পাঠই মুসলিম নারীর শিক্ষার মানদ-হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষভাবে অযোগ্য সমাজপতিদের দূরদর্শিতার অভাবে এদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন হয়নি। ফলস্বরূপ অগণিত মুসলিম মহিলা অজ্ঞানতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে এক করুণ জীবনযাপন করছেন এবং সমগ্র সমাজকে পশ্চাৎদিকে টেনে ধরে রেখেছেন। এরা সমাজের কাছে এমন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে, এদের সঙ্গে নেওয়া যাচ্ছে না, ফেলে দেওয়াও যাচ্ছে না। আধুনিক যুগে মানুষের মেধা ও কর্মক্ষমতাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতএব নারীদের অশিক্ষিত রাখা নিঃসন্দেহে মানব সম্পদের অপচয়।

নারী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই তার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। অথচ আল্লাহর দাসীদের জ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে যুগযুগ ধরে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখা হয়েছে, যা এক ধরনের জাতীয় অপরাধ বললে ভুল হবে না। উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নারীর ন্যায্য অধিকার, যা ইসলামী পরিভাষায় ‘হক্কুল এবাদ’ এর পর্যায়ে ধরে নেওয়া সমীচীন বলে মনে হয়। সুস্থ মাতৃত্ব, সন্তান পালন, সন্তানের শিক্ষা, পরিবার পরিচালনার জন্য নারীকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেও শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। মুসলিম সমাজেও মহিলা শিক্ষক, অধ্যাপক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বাস্তুকার, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, প্রযুক্তিবিদ ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা যায়?

সুতরাং যতদূর সম্ভব ইসলামী জীবনবিধান প্রদত্ত সীমারেখা ও অনুশাসন মেনে নারীর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষালাভের জন্য কোরআন তফসির, হাদিস, ফেকাহ ইত্যাদি শাখায় তাদের জন্য পঠন-পাঠনের বিশেষ ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। এমনকি সুস্থ মাতৃত্বের জন্য মেয়েদের পৃথক শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর উপস্থিতি অতিশয় নগণ্য। মুসলিম নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার বিশেষ কোনো উদ্যোগ সরকারি পর্যায়ে নেই বললেও চলে। শুধু শৈশব তথা বাল্য অবস্থায় মসজিদ-মক্তবে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও অসংগঠিত।

কিন্তু পুরুষদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি, বেসরকারি উভয় পর্যায়ে রয়েছে। তাই ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত নারী সমাজ গঠনের জন্য সরকারি পর্যায়ে ইংরেজিসহ মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন আবশ্যক। কারণ দেখা যাচ্ছে অনেক মহিলা বিদেশে কর্মস্থলে গিয়ে বা সাংসারিক কাজকর্মে ইংরেজি না জানার  জন্য অসুবিধায় পড়ছেন। চাকরি করে টাকাও কম পাচ্ছেন। এমনকি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মহিলাদের জন্য ইসলামী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে বিশেষ পাঠক্রম চালু করা যেতে পারে।

নারী শিক্ষার প্রধান বাধা হলো উপযুক্ত পরিবেশের অভাব। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কোনো ধরনের শিক্ষাকে ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু পরিবেশের দোহাই দিয়ে জাতির অর্ধাংশকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখা আত্মঘাতী বলা যায়। পরিবেশ তো আপনা থেকে সৃষ্টি হয় না। পরিবেশ গড়তে হয়। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তা পরিবর্তন করবেন।’ (৮ : ৫৩)। অনেকে ভাবেন পর্দাপ্রথা ও নারী শিক্ষা নারী প্রগতির প্রধান অন্তরায়। কিন্তু ইসলামের পর্দা নারীর মান, সম্মান, সম্ভ্রম ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। নারীদের মূর্খ রেখে মুসলমান সম্প্রদায়কে দরিদ্র, কুসংস্কারাছন্ন অনগ্রসর তথা অনুন্নত শ্রেণিতে পরিণত করার অধিকার সমাজ কর্তাদের দেয়নি মানবধর্ম ইসলাম। তাই নারীসমাজে কোরআন নির্দেশিত পর্দার প্রচলন অত্যাবশ্যক।

দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক সমাজে মুসলিম নারীদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। তাই সমাজকর্তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মুসলিম নারীরাও আজ স্কুল, কলেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করছে। পুরুষরাও প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার অভাবহেতু সমাজে আরেক নতুন সংকট সৃষ্টি হতে চলেছে। কারণ আদর্শহীন এবং নৈতিকতা বর্জিত শিক্ষিত পুরুষের মতো শিক্ষিত নারীও সমাজের কাম্য নয়। এক শিক্ষা-বিশেষজ্ঞের স্পষ্ট বক্তব্য ‘কুশিক্ষিত হওয়ার চেয়ে অশিক্ষিত থাকাই ভালো।’ তাই সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি মূল্যবোধ শিক্ষায় মুসলিম নারীদের উদ্বুদ্ধ করা ও এর জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া আজ সময়ের আহ্বান বলা যায়।

ইহকাল ও পরকালের সুপথ রচনা করার জন্য সুশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবজাতির জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে ইসলাম। ১৪০০ বছর আগে প্রচার করা মহানবীর মহান বাণীগুলো আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) বৈপ্লবিক উপদেশ ‘রোগীর সেবার জন্য এক মাইল যাও, দুই ব্যক্তির বিবাদ মীমাংসা করার জন্য দুই মাইল যাও, তোমার এক বিশ্বাসী ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য তিন মাইল যাও এবং জ্ঞানের একটি কথা শেখার জন্য ছয় মাইল যাও।’

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

নারী শিক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

আপডেট টাইম : ১০:০৮:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পবিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে পড়াশোনা করতে, জ্ঞানার্জনে ব্রতী হয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও জ্ঞান শিক্ষার যোগ্যতা এককভাবে পুরুষদের দেওয়া হয়নি। আর সে জন্য মহানবী (সা.) দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছেন ‘প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ। অবশ্য কর্তব্য। তাঁর অনুসারীরা মূর্খ হোক এমন কামনা করেননি আল্লাহর রাসুল। তাই তিনি সাবধান করে বলেছিলেন, ‘মূর্খতা অপেক্ষা বড় দরিদ্রতা আর নেই।’ ‘জ্ঞানীর নিদ্রা মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা উত্তম।’ সম্প্রতি আমাদের দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

অথচ ১৪০০ বছর আগে আরবের মাটিতে উম্মিনবী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষা গ্রহণকে ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিদুষী নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে শিক্ষানুরাগী মহিলারা একবার বললেন, ‘আপনি জ্ঞানশিক্ষা দেওয়ার জন্য সবসময় পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। তাই আমাদের জন্য একদিন নির্দিষ্ট করুন।’ মহানবী তদনুসারে তাদের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়েও নারীদের শিক্ষা দিতেন। ফলস্বরূপ অনেক মহিলা পতের উদয় হয়েছিল, যারা ইসলামের মহান শিক্ষা প্রচারে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন হজরত আয়েশা সাফিয়া, উম্মে সালমা, ফাতিয়া বিনতে কায়েস, সৈয়িদা নাফিসা, উম্মে আদদারদা, আয়শা বিনতে সাদ, জয়নাব বিনতে সালমা, রসুলের কন্যা ফাতেমা জোহরা, উম্মে আতিয়া, শিমা, সাকিনা, উম্মে হাবিবা, উম্মে সারিক, উম্মে ইউসুফ প্রমুখ। ইসলামি দর্শন ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন তখনকার মহিলারা। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মহিলাদের অসামান্য অবদান ছিল। খলিফাদের শাসনকালেও নারীরা শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য, কাব্যচর্চা ও সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইসলামি দর্শন নারী শিক্ষার উৎসাহদাতা ও পথপ্রদর্শক। ইসলামে নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত এমন বহুল প্রচারিত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মানবজাতির অর্ধাংশ নারী জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত দ্বিচক্র বিশিষ্ট এ মানব সমাজের এক চাকা দুর্বল হলে তার গতি শ্লথ হতে বাধ্য। নিজেদের অজ্ঞানতাহেতু এ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণের উজ্জ্বল ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে যান।

তাই এদেশে নারী শিক্ষা বলতে অর্থ না বুঝে তোতা পাখির মতো কোরআন পাঠই মুসলিম নারীর শিক্ষার মানদ-হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষভাবে অযোগ্য সমাজপতিদের দূরদর্শিতার অভাবে এদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন হয়নি। ফলস্বরূপ অগণিত মুসলিম মহিলা অজ্ঞানতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে এক করুণ জীবনযাপন করছেন এবং সমগ্র সমাজকে পশ্চাৎদিকে টেনে ধরে রেখেছেন। এরা সমাজের কাছে এমন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে, এদের সঙ্গে নেওয়া যাচ্ছে না, ফেলে দেওয়াও যাচ্ছে না। আধুনিক যুগে মানুষের মেধা ও কর্মক্ষমতাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতএব নারীদের অশিক্ষিত রাখা নিঃসন্দেহে মানব সম্পদের অপচয়।

নারী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই তার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। অথচ আল্লাহর দাসীদের জ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে যুগযুগ ধরে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখা হয়েছে, যা এক ধরনের জাতীয় অপরাধ বললে ভুল হবে না। উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নারীর ন্যায্য অধিকার, যা ইসলামী পরিভাষায় ‘হক্কুল এবাদ’ এর পর্যায়ে ধরে নেওয়া সমীচীন বলে মনে হয়। সুস্থ মাতৃত্ব, সন্তান পালন, সন্তানের শিক্ষা, পরিবার পরিচালনার জন্য নারীকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেও শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। মুসলিম সমাজেও মহিলা শিক্ষক, অধ্যাপক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বাস্তুকার, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, প্রযুক্তিবিদ ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা যায়?

সুতরাং যতদূর সম্ভব ইসলামী জীবনবিধান প্রদত্ত সীমারেখা ও অনুশাসন মেনে নারীর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষালাভের জন্য কোরআন তফসির, হাদিস, ফেকাহ ইত্যাদি শাখায় তাদের জন্য পঠন-পাঠনের বিশেষ ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। এমনকি সুস্থ মাতৃত্বের জন্য মেয়েদের পৃথক শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর উপস্থিতি অতিশয় নগণ্য। মুসলিম নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার বিশেষ কোনো উদ্যোগ সরকারি পর্যায়ে নেই বললেও চলে। শুধু শৈশব তথা বাল্য অবস্থায় মসজিদ-মক্তবে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও অসংগঠিত।

কিন্তু পুরুষদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি, বেসরকারি উভয় পর্যায়ে রয়েছে। তাই ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত নারী সমাজ গঠনের জন্য সরকারি পর্যায়ে ইংরেজিসহ মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন আবশ্যক। কারণ দেখা যাচ্ছে অনেক মহিলা বিদেশে কর্মস্থলে গিয়ে বা সাংসারিক কাজকর্মে ইংরেজি না জানার  জন্য অসুবিধায় পড়ছেন। চাকরি করে টাকাও কম পাচ্ছেন। এমনকি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মহিলাদের জন্য ইসলামী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে বিশেষ পাঠক্রম চালু করা যেতে পারে।

নারী শিক্ষার প্রধান বাধা হলো উপযুক্ত পরিবেশের অভাব। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কোনো ধরনের শিক্ষাকে ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু পরিবেশের দোহাই দিয়ে জাতির অর্ধাংশকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখা আত্মঘাতী বলা যায়। পরিবেশ তো আপনা থেকে সৃষ্টি হয় না। পরিবেশ গড়তে হয়। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তা পরিবর্তন করবেন।’ (৮ : ৫৩)। অনেকে ভাবেন পর্দাপ্রথা ও নারী শিক্ষা নারী প্রগতির প্রধান অন্তরায়। কিন্তু ইসলামের পর্দা নারীর মান, সম্মান, সম্ভ্রম ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। নারীদের মূর্খ রেখে মুসলমান সম্প্রদায়কে দরিদ্র, কুসংস্কারাছন্ন অনগ্রসর তথা অনুন্নত শ্রেণিতে পরিণত করার অধিকার সমাজ কর্তাদের দেয়নি মানবধর্ম ইসলাম। তাই নারীসমাজে কোরআন নির্দেশিত পর্দার প্রচলন অত্যাবশ্যক।

দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক সমাজে মুসলিম নারীদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। তাই সমাজকর্তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মুসলিম নারীরাও আজ স্কুল, কলেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করছে। পুরুষরাও প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার অভাবহেতু সমাজে আরেক নতুন সংকট সৃষ্টি হতে চলেছে। কারণ আদর্শহীন এবং নৈতিকতা বর্জিত শিক্ষিত পুরুষের মতো শিক্ষিত নারীও সমাজের কাম্য নয়। এক শিক্ষা-বিশেষজ্ঞের স্পষ্ট বক্তব্য ‘কুশিক্ষিত হওয়ার চেয়ে অশিক্ষিত থাকাই ভালো।’ তাই সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি মূল্যবোধ শিক্ষায় মুসলিম নারীদের উদ্বুদ্ধ করা ও এর জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া আজ সময়ের আহ্বান বলা যায়।

ইহকাল ও পরকালের সুপথ রচনা করার জন্য সুশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবজাতির জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে ইসলাম। ১৪০০ বছর আগে প্রচার করা মহানবীর মহান বাণীগুলো আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) বৈপ্লবিক উপদেশ ‘রোগীর সেবার জন্য এক মাইল যাও, দুই ব্যক্তির বিবাদ মীমাংসা করার জন্য দুই মাইল যাও, তোমার এক বিশ্বাসী ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য তিন মাইল যাও এবং জ্ঞানের একটি কথা শেখার জন্য ছয় মাইল যাও।’

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট