ঢাকা ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জামায়াত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:১৫:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ নভেম্বর ২০১৫
  • ৩৮০ বার

তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলায় অংশ নিচ্ছে উগ্রপন্থিরা। একটি গ্রুপ ব্লগার-লেখকদের টার্গেট করেছে। আরেকটি দল হত্যা করছে ভিন্ন মতাদর্শের পীর-দরবেশকে। অপর একটি গ্রুপ বোমা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। মাঠ পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন দল হামলায় অংশ নিলেও তাদের পরিকল্পনাকারী চক্র এক ও অভিন্ন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় সব গ্রুপের নেপথ্যে জামায়াত-শিবির, সামনে উগ্রপন্থিরা। ফয়সল হত্যার নেপথ্যেও তারা।
আদর্শিক বিরোধ ছাড়াও যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনগুলো হত্যার ‘দায়’ স্বীকার করলেও তাদের নেপথ্যে তারাই। ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে পরিকল্পনা ও অপারেশনে অংশ নেওয়ায় নেপথ্য মদদদাতা ও অর্থ সরবরাহকারীদের ব্যাপারে অনেকাংশে অন্ধকারে পুলিশ-র‌্যাব।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ১৬টি কৌশল ব্যবহার করে উগ্রপন্থিরা বারবার ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ শনিবার প্রায় একই সময়ে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন ও শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরীসহ লেখক-ব্লগারের ওপর বর্বর হামলা করা হয়। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশকের ওপর হামলার সঙ্গে উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (্এবিটি) সদস্যরা জড়িত বলে দাবি করা হচ্ছে।

দীপনকে হত্যা এবং টুটুলসহ আরও তিনজনের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল রোববার রাত ১টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। দুই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করা যায়নি। তবে তথ্য সংগ্রহে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এবিটির পলাতক নেতা রানাসহ কয়েকজনকে আটকের চেষ্টা চলছে। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে সাতটি সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করছে ডিবি। এ ছাড়া দীপনের ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল সেটের কললিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের আশপাশের কোনো ভবনে সিসিটিভি ছিল না।

গতকাল রোববার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, শনিবারের দুই ঘটনায় উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত থাকতে পারে। একই ছাতার নিচে থেকে হামলার টার্গেট করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একাধিকবার বলেছেন, ‘যা শিবির তাই আনসারুল্লাহ, তাই জেএমবি, তাই জামায়াত।’

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ‘দায়’ আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখা দাবিকৃত ‘আনসার আল ইসলাম’ স্বীকার করলেও এর সত্যাসত্যের ব্যাপারে গোয়েন্দারা অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এর আগে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর ‘দায়’ স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিল আনসার বাংলা-৭। তবে এফবিআই পুলিশকে জানিয়েছে, ওই হামলার দায়ের ব্যাপারে তারা এখনও তেমন কিছু হাতে পায়নি।

নেপথ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি: দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, শনিবার দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ঘটনা ছাড়াও হোসেনী দালানে বোমা হামলা, গাবতলীতে পুলিশ চেকপোস্টে এএসআই খুন, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানের ওপর হামলায় পৃথক গ্রুপ জড়িত থাকলেও তাদের মধ্যে আদর্শিক মিল রয়েছে। এসবের নেপথ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে জেএমবি, এবিটি, শিবির ও ভাড়াটে কিলারদের ব্যবহার করা হলেও একই জায়গা থেকে পুরো বিষয়টি পরিকল্পনা হয়ে থাকে। একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এসব উগ্রপন্থিদের মদদ দিচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।

১৬টি কৌশল ব্যবহার: সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহভাজন একজন উগ্রপন্থির আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করে। সেখানে দেখা যায়, কাউকে টার্গেট করে হত্যার আগে তারা ১৬টি গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে। অপারেশনের শিরোনামে থাকে প্রতিটি হামলার ধরন হবে ‘আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক।’ তা হলো- প্রথমে চতুরতার সঙ্গে টার্গেট করার ব্যক্তির অবস্থান রেকি করা, ওই ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া, টার্গেট করা ব্যক্তি কোনো নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকলে তা ভেদ করে কীভাবে নির্বিঘ্নে হামলা করা যায়, তা ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা, হামলার ব্যাপারে মনে মনে একাধিবার রিহার্সেল দেওয়া, হামলার পর কোথায় মিলিত হবে, তা আগেই নির্ধারণ, হামলার পর পথে অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় না করা, জরুরি অবস্থায় তীর চিহ্নের মতো হাঁটা, পথে সাধারণ কোনো মানুষের মধ্যে পড়লে পাল্টা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দেওয়া, রাস্তায় গল্প করতে করতে হাঁটা; লম্বা লাইন না করা, অন্ধকারে হাঁটার সময় সামনের জনকে অনুসরণ, কোনো প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়লে সংকেতের মাধ্যমে অন্যদের জানানো, সোর্সের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর না করা, রেকির সময় স্থান ও মানচিত্র মনে মনে আঁকতে হবে। অপারেশন সফল হওয়ার পর সাবোটাজ করতে থাকে পৃথক টিম।

চার দলে বিভক্ত হয়ে হামলা :গোয়েন্দা সূত্র বলছে, অধিকাংশ ঘটনায় উগ্রপন্থিরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে হামলায় অংশ নেয়। তা হলো, রেইড পার্টি, অগ্রবর্তী দল, রিজার্ভ পার্টি ও পেছনের পার্টি। সাধারণত প্রতিটি দলে ৩-৪ জন সদস্য থাকে। অপারেশনে অংশ নেওয়া সদস্যদের মধ্যে কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। আবার কারও হাতে ছুরি, চাপাতি থাকে। প্রয়োজন না হলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। দীপন হত্যা এবং টুটুলসহ তিনজনের ওপর হামলার ঘটনাটি এক জায়গা থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। দুটি ঘটনাও প্রায় একই সময়ে ঘটানো হয়েছে।

প্রশিক্ষণে একই গ্রুপ, সন্দেহে এবিটি :গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে দীপনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দুটি ঘটনায় একই ধরনের ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের ডান হাত দিয়ে কোপানো হয়েছে। এদিকে চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় পৃথক দুটি গ্রুপ অংশ নিলেও তারা একই জায়গায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে। আক্রমণের দায়িত্বে থাকা গ্রুপটিকে হয়তো একই জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষককে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। অন্য ব্লগার হত্যার সঙ্গে শনিবার দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ধরনে হুবহু মিল রয়েছে।

ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে এবিটি সদস্যরা চাপাতি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে আত্মরক্ষার জন্য তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। লালমাটিয়ায় তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যায় নতুন কোনো গ্রুপ নেমেছে। তারা পুরোপুরি পেশাদার নয়। পেশাদার হলে ঘটনাস্থলে তাজা গুলি পড়ে থাকার কথা নয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় কিছু ক্লু পাওয়া গেছে। আহতরাও দেখেছেন হামলাকারীদের। তবে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতির কর্ণধার দীপন হত্যাকাণ্ডে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। ওই মার্কেটের সিসিটিভি ক্যামেরাই তদন্তের মূল ভরসা।

ডিবি পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ সমকালকে বলেন, আজিজ মার্কেটে প্রবেশ ও বের হওয়ার ১৬টি গেট রয়েছে। এর মধ্যে দশটিতে সিসি ক্যামেরা পাওয়া গেছে। এর দুটি নষ্ট ছিল। যে ৮টি ক্যামেরা সচল ছিল তার ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ ও গুপ্তচর নিয়োগ করে খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

সূত্র: সমকাল ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জামায়াত

আপডেট টাইম : ১০:১৫:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ নভেম্বর ২০১৫

তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলায় অংশ নিচ্ছে উগ্রপন্থিরা। একটি গ্রুপ ব্লগার-লেখকদের টার্গেট করেছে। আরেকটি দল হত্যা করছে ভিন্ন মতাদর্শের পীর-দরবেশকে। অপর একটি গ্রুপ বোমা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। মাঠ পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন দল হামলায় অংশ নিলেও তাদের পরিকল্পনাকারী চক্র এক ও অভিন্ন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় সব গ্রুপের নেপথ্যে জামায়াত-শিবির, সামনে উগ্রপন্থিরা। ফয়সল হত্যার নেপথ্যেও তারা।
আদর্শিক বিরোধ ছাড়াও যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনগুলো হত্যার ‘দায়’ স্বীকার করলেও তাদের নেপথ্যে তারাই। ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে পরিকল্পনা ও অপারেশনে অংশ নেওয়ায় নেপথ্য মদদদাতা ও অর্থ সরবরাহকারীদের ব্যাপারে অনেকাংশে অন্ধকারে পুলিশ-র‌্যাব।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ১৬টি কৌশল ব্যবহার করে উগ্রপন্থিরা বারবার ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ শনিবার প্রায় একই সময়ে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন ও শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরীসহ লেখক-ব্লগারের ওপর বর্বর হামলা করা হয়। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশকের ওপর হামলার সঙ্গে উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (্এবিটি) সদস্যরা জড়িত বলে দাবি করা হচ্ছে।

দীপনকে হত্যা এবং টুটুলসহ আরও তিনজনের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল রোববার রাত ১টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। দুই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করা যায়নি। তবে তথ্য সংগ্রহে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এবিটির পলাতক নেতা রানাসহ কয়েকজনকে আটকের চেষ্টা চলছে। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে সাতটি সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করছে ডিবি। এ ছাড়া দীপনের ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল সেটের কললিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের আশপাশের কোনো ভবনে সিসিটিভি ছিল না।

গতকাল রোববার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, শনিবারের দুই ঘটনায় উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত থাকতে পারে। একই ছাতার নিচে থেকে হামলার টার্গেট করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একাধিকবার বলেছেন, ‘যা শিবির তাই আনসারুল্লাহ, তাই জেএমবি, তাই জামায়াত।’

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ‘দায়’ আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখা দাবিকৃত ‘আনসার আল ইসলাম’ স্বীকার করলেও এর সত্যাসত্যের ব্যাপারে গোয়েন্দারা অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এর আগে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর ‘দায়’ স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিল আনসার বাংলা-৭। তবে এফবিআই পুলিশকে জানিয়েছে, ওই হামলার দায়ের ব্যাপারে তারা এখনও তেমন কিছু হাতে পায়নি।

নেপথ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি: দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, শনিবার দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ঘটনা ছাড়াও হোসেনী দালানে বোমা হামলা, গাবতলীতে পুলিশ চেকপোস্টে এএসআই খুন, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানের ওপর হামলায় পৃথক গ্রুপ জড়িত থাকলেও তাদের মধ্যে আদর্শিক মিল রয়েছে। এসবের নেপথ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে জেএমবি, এবিটি, শিবির ও ভাড়াটে কিলারদের ব্যবহার করা হলেও একই জায়গা থেকে পুরো বিষয়টি পরিকল্পনা হয়ে থাকে। একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এসব উগ্রপন্থিদের মদদ দিচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।

১৬টি কৌশল ব্যবহার: সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহভাজন একজন উগ্রপন্থির আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করে। সেখানে দেখা যায়, কাউকে টার্গেট করে হত্যার আগে তারা ১৬টি গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে। অপারেশনের শিরোনামে থাকে প্রতিটি হামলার ধরন হবে ‘আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক।’ তা হলো- প্রথমে চতুরতার সঙ্গে টার্গেট করার ব্যক্তির অবস্থান রেকি করা, ওই ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া, টার্গেট করা ব্যক্তি কোনো নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকলে তা ভেদ করে কীভাবে নির্বিঘ্নে হামলা করা যায়, তা ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা, হামলার ব্যাপারে মনে মনে একাধিবার রিহার্সেল দেওয়া, হামলার পর কোথায় মিলিত হবে, তা আগেই নির্ধারণ, হামলার পর পথে অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় না করা, জরুরি অবস্থায় তীর চিহ্নের মতো হাঁটা, পথে সাধারণ কোনো মানুষের মধ্যে পড়লে পাল্টা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দেওয়া, রাস্তায় গল্প করতে করতে হাঁটা; লম্বা লাইন না করা, অন্ধকারে হাঁটার সময় সামনের জনকে অনুসরণ, কোনো প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়লে সংকেতের মাধ্যমে অন্যদের জানানো, সোর্সের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর না করা, রেকির সময় স্থান ও মানচিত্র মনে মনে আঁকতে হবে। অপারেশন সফল হওয়ার পর সাবোটাজ করতে থাকে পৃথক টিম।

চার দলে বিভক্ত হয়ে হামলা :গোয়েন্দা সূত্র বলছে, অধিকাংশ ঘটনায় উগ্রপন্থিরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে হামলায় অংশ নেয়। তা হলো, রেইড পার্টি, অগ্রবর্তী দল, রিজার্ভ পার্টি ও পেছনের পার্টি। সাধারণত প্রতিটি দলে ৩-৪ জন সদস্য থাকে। অপারেশনে অংশ নেওয়া সদস্যদের মধ্যে কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। আবার কারও হাতে ছুরি, চাপাতি থাকে। প্রয়োজন না হলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। দীপন হত্যা এবং টুটুলসহ তিনজনের ওপর হামলার ঘটনাটি এক জায়গা থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। দুটি ঘটনাও প্রায় একই সময়ে ঘটানো হয়েছে।

প্রশিক্ষণে একই গ্রুপ, সন্দেহে এবিটি :গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে দীপনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দুটি ঘটনায় একই ধরনের ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের ডান হাত দিয়ে কোপানো হয়েছে। এদিকে চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় পৃথক দুটি গ্রুপ অংশ নিলেও তারা একই জায়গায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে। আক্রমণের দায়িত্বে থাকা গ্রুপটিকে হয়তো একই জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষককে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। অন্য ব্লগার হত্যার সঙ্গে শনিবার দুই প্রকাশকের ওপর হামলার ধরনে হুবহু মিল রয়েছে।

ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে এবিটি সদস্যরা চাপাতি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে আত্মরক্ষার জন্য তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। লালমাটিয়ায় তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যায় নতুন কোনো গ্রুপ নেমেছে। তারা পুরোপুরি পেশাদার নয়। পেশাদার হলে ঘটনাস্থলে তাজা গুলি পড়ে থাকার কথা নয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় কিছু ক্লু পাওয়া গেছে। আহতরাও দেখেছেন হামলাকারীদের। তবে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতির কর্ণধার দীপন হত্যাকাণ্ডে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। ওই মার্কেটের সিসিটিভি ক্যামেরাই তদন্তের মূল ভরসা।

ডিবি পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ সমকালকে বলেন, আজিজ মার্কেটে প্রবেশ ও বের হওয়ার ১৬টি গেট রয়েছে। এর মধ্যে দশটিতে সিসি ক্যামেরা পাওয়া গেছে। এর দুটি নষ্ট ছিল। যে ৮টি ক্যামেরা সচল ছিল তার ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ ও গুপ্তচর নিয়োগ করে খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

সূত্র: সমকাল ।