হাওর বার্তা ডেস্কঃ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.) এর দরবারে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার উত্তম সাহচর্য পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার কে রাখে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর তোমার মা। তিনি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা। (মুসলিম : খ. ২, পৃ. ৩১২ : ২৫৪৮)
ঘটনাটি হতে পারত আমার সারা জীবনের কান্না, সারা জীবনের কলঙ্ক। ইহকালের লাঞ্ছনা ও পরকালের ধ্বংসের কারণ। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ আমাকে যথাসময়ে শুধরে দিয়েছেন। মায়ের অবাধ্যতা ছেড়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তৌফিক দিয়েছেন। মাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদের ওপর তার শীতল ছায়া দীর্ঘায়িত করেছেন। সুতরাং সব প্রশংসা তাঁরই জন্য।
গত ঈদুল ফিতরে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেছিলাম। খুব ফুরফুরে মেজাজে হাসি-খুশিতে আমাদের সময় কাটছিল। কিন্তু ঈদের পরদিন ঘটল একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। হায়! সেটি যদি না ঘটত, তাহলে কতই না ভালো হতো! তুচ্ছ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারে ঝগড়া হয়। সে কারণে আমি মাদ্রাসার পড়ালেখা ছেড়ে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিই। এমনকি এক পর্যায়ে খাওয়া-দাওয়া না করেই রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যাই এবং মমতাময়ী মায়ের শত বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে চাকরির জন্য ঢাকার দিকে রওনা করি।
কিন্তু আমার অবাধ্যতার কারণে মা যে মনের ভেতর ভীষণ ব্যথা পেয়েছেন আর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, তা আমি খেয়াল করিনি। আমি যখন লঞ্চঘাটে এলাম তার একটু পরই আমার অগোচরে বড় ভাই লঞ্চঘাটে এলেন এবং আমাকে ধরে ফেললেন। এরই মধ্যে ভাইয়ের ফোনে কল বেজে উঠল। তিনি ফোন রিসিভ করলেন। তারপর ভাই আমাকে যা জানালেন, তা শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি বললেন, তুই যখন থেকে মায়ের সঙ্গে পাগলামি শুরু করেছিস, তখন থেকেই মা খুব পেরেশান।
তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পেরেশানি ও ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এই মাত্র মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। এখন বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যেতে হবে। তুই পাগলামি ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যা। কাঁদো কাঁদো মন নিয়ে আমি তখনই বাড়ির পথ ধরলাম। তারপর বাড়িতে এসে দেখি মায়ের চারপাশে সবাই বসে আছে। তার চোখ দুটো বন্ধ। কোনো দিকে তাকান না। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। সবাই মায়ের জন্য দোয়া-দরুদ পড়ছে। সেবা-শুশ্রষা করছে। ছোটরা কান্নাকাটি করছে। মায়ের অবস্থার অবনতি দেখে সবাই অস্থির। একটু পরই ভাইয়া ডাক্তার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তারপর ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করলেন।
জুমার নামাজের আজান হলে আব্বু বললেন, চলো মসজিদে যাই। তোমাদের আম্মুর সুস্থতার জন্য দোয়া করি। তকদিরে যা আছে; তা-ই তো হবে। দীর্ঘক্ষণ পর মায়ের হুঁশ ফিরে এলে সর্বপ্রথম তিনি যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো ‘ওবায়দুল্লাহ, ওরে ওবায়দুল্লাহ, তুই কি আর লেখাপড়া করবি না?’ আমি তখন কেঁদে কেঁদে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আর বললাম, মা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর কোনো দিন আপনার অবাধ্য হব না। লেখাপড়া ছাড়ব না। আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার আওয়াজ শুনে মা সচকিত হলেন। আমার দিকে তাকালেন। দেখি মায়ের চেহারা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
তিনি আমাকে কাছে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলালেন। বললেন, আর এমন করিসনে বাবা। চাকরি করে আমাকে খাওয়াতে কে বলেছে তোকে? তোর কাছে আমি টাকা-পয়সা চাই না। চাওয়া মাত্র একটাই। লেখাপড়া করে আলেম হবি। মানুষের মতো মানুষ হবি। মায়ের কথা শুনে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কোনো দিন মায়ের অবাধ্য হব না। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন মায়ের সেবা করব। কারণ আমাদের প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সা.) মায়ের সেবার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.) এর দরবারে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার উত্তম সাহচর্য পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার কে রাখে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর তোমার মা। তিনি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা। (মুসলিম: খ. ২, পৃ. ৩১২ : ২৫৪৮)।
কামনা করি আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে ও পৃথিবীর সব সন্তানকে মায়ের আনুগত্য করার তৌফিক দান করেন। আমিন!