হাওর বার্তা ডেস্কঃ নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের বিষয়টি এখনও রহস্যাবৃত। মিন্নি বারবারই বলছেন, নয়নের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। নয়নের বাড়িতে থাকা বা সেখানে তার যাওয়া-আসার তথ্য সঠিক নয়। কিন্তু নয়নের মা দাবি করছেন, মিন্নি তার ছেলের বউ হিসেবেই বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করত। রীতিমতো তার বাড়িতে মিন্নি ছোটখাটো সংসারও গড়ে তুলেছিল। মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের সম্পর্কের নানা স্মৃতিও প্রতিবেদককে দেখান নয়নের মা।
বরগুনা সরকারি কলেজ ঘেঁষে নয়ন বন্ডের বাড়ি। টিনের চালা দেয়া তিনটি ঘর। সোমবার সেখানে গেলে দেখা যায়, বাড়ির কাঠের দরজা বন্ধ। দরজা ঠেলতেই সেটি খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, নয়নের মা সাহিদা বেগম একা এক ঘরে বসে আছেন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বলেন, এই মিন্নির জন্য আমার ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। তিনি বলেন, আসেন এই ঘরে আসেন। এখানে নয়ন থাকত। পুলিশ এখান থেকে মিন্নির ব্যবহৃত অনেক কিছুই নিয়ে গেছে। তার পরও কিছু কিছু জিনিস এখনও পড়ে আছে। দেখা গেল, নয়নের ঘরে ঢোকার দরজার ওপর বড় করে লেখা ‘বাসর ঘর’।
নয়নকে ধরার জন্য পুলিশ বাড়িতে এসে কিছুই রাখেনি। সব ভেঙে দিয়েছে। ভাঙা ড্রেসিং টেবিল দেখিয়ে তিনি বলেন, এটার কাচ পুলিশ ভেঙে দিয়েছে। এই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মিন্নি অনেক সাজগোজ করেছে। ভাঙা ড্রয়ার খুলে তিনি বের করেন একটি ফেস পাউডারের খালি কৌটা। নয়নের মা বলেন, কৌটাটা পড়ে আছে।
পাউডারসহ ওপরের অংশ নিয়ে গেছে পুলিশ। ঘরের এক কোণে একটা প্লাস্টিকের ফুলসহ ফুলদানি রাখা। র্যাপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো। সেটা দেখিয়ে তিনি বলেন, নয়নের জন্মদিনে এটা মিন্নি দিয়েছিল। ওই জন্মদিনের ভিডিও নাকি মোবাইলে ছাড়া হয়েছে। ইউটিউব না কিসে যেন এখনও আছে। সবাই দেখেছে।
এ-ঘর, ও-ঘর ঘুরিয়ে একটা ভাঙা কম্পিউটার টেবিলের সামনে নিয়ে তিনি দেখান কয়েকটি মোবাইল ফোনের ভাঙা টুকরো। যেগুলোর খাপটাই শুধু আছে। মাদারবোর্ড ও সিমকার্ড নিয়ে গেছে পুলিশ। নয়নের মা বলেন, পুলিশ যে মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে গেছে তাতে নয়নের সঙ্গে মিন্নির অনেক ছবি ছিল।
এরপর নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোনের গ্যালারি খুলে কয়েকটি ছবি দেখিয়ে বলেন, মিন্নি প্রায় প্রতিদিনই এ বাড়িতে চলে আসত। কলেজের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা একটা সরু গলি দেখিয়ে তিনি বলেন, ওই গলি দিয়ে সে হেঁটে চলে আসত। গলিতে দাঁড়ানো মিন্নির হাস্যোজ্জ্বল ছবিও দেখান তিনি।
আরেকটা ছবিতে নয়নের সঙ্গে মিন্নির ভিডিও চ্যাটের স্ক্রিন শট দেখিয়ে নয়নের মা বলেন, তারা তো সব সময় ভিডিওতে কথা বলত। এই দেখেন ছবি। এতে দেখা যায়, নয়নের চ্যাটিং মেসেঞ্জার প্রোফাইলে মিন্নির ছবি দিয়ে লেখা ‘বউ’। আর মিন্নির চ্যাটিং প্রোফাইলে লেখা এএস মিন্নি অর্থাৎ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
এসব দেখিয়ে নয়নের মা বলেন, পুলিশ প্রায় সবকিছুই নিয়ে গেছে। আমার কাছে এগুলোই অবশিষ্ট আছে। তিনি বলেন, এগুলো আমার কাছে থাকার কথাও নয়। একদিন নয়নের মোবাইলের স্ক্রিন টাচ (পরদা) নষ্ট হয়ে গেলে কিছুদিন আমার ফোনটা ব্যবহার করে। পরে আমাকে যখন মোবাইল ফিরিয়ে দেয় তখন এই ছবিগুলো ছিল।
বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, নয়নের ঘরে সাদা দেয়ালে লাল রং দিয়ে এক জায়গায় লেখা ০০৭ (নয়নের সন্ত্রাসী গ্রুপের সাংকেতিক নাম)। সাহিদা বেগম বলেন, নয়ন কেন তার নামের সঙ্গে বন্ড বা ০০৭ সেভেন লিখত তা আমি জানি না। সে বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু তাকে তো মেরেই ফেলল। নয়নের মা আরও বলেন, নয়নকে মেরে ফেলল।
কিন্তু যারা তাকে বন্ড বানাল তাদের কি কিছুই হবে না। যারা তাকে নয়ন থেকে নয়ন বন্ড বানিয়েছে তাদেরও ধরা হোক। যাতে আর কোনো নয়ন বিপথগামী সন্ত্রাসী বা বন্ড না হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ‘০০৭ লাইসেন্স’ একটি বিখ্যাত হলিউড সিনেমা সিরিজ। সিনেমার মৌলিক গল্প অনুযায়ী ০০৭ হচ্ছে মানুষ হত্যার লাইসেন্স। এতে যিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন তার নাম জেমস বন্ড।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, এই ছবি দেখে নয়ন বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। এরপর নিজেকে ‘০০৭ লাইসেন্স’ সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের নামের সঙ্গে নিজেই যুক্ত করে দেন ‘বন্ড’ শব্দটি এবং একই সঙ্গে গড়ে তোলেন ০০৭ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নয়নের বাড়ি থেকে অন্তত ২০ ধরনের আলামত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশকিছু ছবি, মিন্নির ব্যবহৃত লিপস্টিক, চিরুনি, চিরুনিতে আটকে থাকা মিন্নির চুল, কামিজ, চুলের ক্লিপ, ফেসপাউডার, চোখের ভ্রূতে ব্যবহৃত আই ব্রো, সিমকার্ড এবং কয়েকটি মোবাইল ফোনসেট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরগুনা পুলিশের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিককে বলেন, নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠতা ও বিয়ে প্রমাণ করতেই এসব আলামত জব্দ করা হয়েছে। নয়নের বাড়ির চিরুনিতে আটকে থাকা মিন্নির চুল ও তার ব্যবহৃত কয়েকটি জিনিস ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, মিন্নি যেহেতু বারবারই নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন তাই কিছু অকাট্য প্রমাণের প্রয়োজন। রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করা গেলে রিফাত হত্যার জট অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
অকাট্য প্রমাণ হাতে এলে তখন প্রমাণ করা সহজ হবে ঘটনার পর নিজেকে আড়াল করতেই কিভাবে মিন্নি একের পর এক মিথ্যা কথা বলে গেছেন। এমন মন্তব্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার।
নয়নের বাড়ি থেকে আলামত সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবির সোমবার যুগান্তরের বরগুনা দক্ষিণ প্রতিনিধি এম মজিবুল হক কিসলুকে বলেন, আমরা বেশকিছু আলামত নয়নের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছি।
এগুলোর মধ্যে একটি কামিজ, মিন্নির লেমিনেটিং করা একটি ছবি, চুল পেঁচানো চিরুনি ও এম প্লাস এন খোদাই করা সামুদ্রিক ঝিনুক রয়েছে। এই ঝিনুকটি মিন্নি ও নয়ন কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন। মামলার আলামত হিসেবে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে নয়নের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে চান না মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর। সোমবার শহরের স্টার টেইলার্স নামের একটি দোকানে বসে মোজাম্মেল কিশোর যুগান্তরকে বলেন, নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের বিষয়টি সাজানো নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ রিফাতের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে গোপনে দেয়া হয়নি।
বিয়েতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় হাজার লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিয়েতে এসেছিলেন। মিন্নির বাবা বলেন, এতগুলো মানুষ দাওয়াত খেতে এলো কই কেউই তো বলেনি নয়নের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, এখন আবার কেন বিয়ে দিচ্ছ।
রিফাতের বাবাও তো বলেননি আমার মেয়ের আগেই বিয়ে হয়েছে। তাছাড়া আমি তো রিফাতের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাইনি। রিফাতের পরিবারই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কারণ রিফাত ও মিন্নি একে অপরকে পছন্দ করত। আমি প্রথমদিকে এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।
মিন্নির বাবা আরও বলেন, আসলে মিন্নিকে জেলে ঢোকানোর জন্য সুনাম দেবনাথ (স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে) সর্বপ্রথম মিন্নির বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন। নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয়েছে বলে তিনি ফেসবুকে লেখেন। মিন্নিকে তিনি বিতর্কিত করতে চান। এর কারণ হল, মামলার এক নম্বর সাক্ষী মিন্নি। সে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।
সে যদি বাইরে থাকে তবে রিফাত হত্যার আসামিদের সবার বিরুদ্ধে সে সাক্ষী দেবে। তাহলে বিচারে তাদের শাস্তি নিশ্চিত। তাই যাতে মিন্নি সাক্ষী না দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিন্নিকে গ্রেফতার করে সরিয়ে দিলেই মামলা শেষ।
কারণ বিচার হয় সাক্ষীর ভিত্তিতে। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, যারা রিফাতকে খুন করেছে তারা তো সবাই সুনাম দেবনাথের লোকজন। নয়ন বন্ড শম্ভুর লোক, এটা তো শহরের সবাই জানে।
এদিকে নয়ন ও মিন্নির বিয়ের রেজিস্ট্রি কাবিনের একটি কপি হাতে পেয়েছে যুগান্তর। এতে দেখা যায়, বরগুনা পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী আনিসুর রহমান ভূঁইয়া বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করেন (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৪৫/২০১৮)।
কাজীর দফতরে রক্ষিত বালাম বইয়ের ৯৬ নম্বর পৃষ্ঠায় পাত্র-পাত্রী ও সাক্ষীদের নামের ঘরে ছেলে পক্ষের ২ জন্য এবং মেয়ে পক্ষের ২ জন করে মোট চারজন সাক্ষীর নাম আছে। নয়নের পক্ষের দু’জন সাক্ষীর একজন হলেন রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী।
আর মেয়ের পক্ষের সাক্ষীরা হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস, পিতা জাহাঙ্গীর আলম। ঠিকানা আয়লা গুচ্ছগ্রাম। আরেকজন হলেন সাইফুল ইসলাম মুন্না, পিতা সহিদুল ইসলাম। ঠিকানা পশ্চিম কলেজ রোড।
কাজী আনিসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নয়ন বন্ড কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ তার কাজী অফিসে আসেন। তারা বিয়ের কথা বললে দু’পক্ষের অভিভাবক কোথায় জানতে চান। এ সময় নয়ন বলেন, তার বাবা বেঁচে নেই। মা ফোনে কথা বলবেন।
এরপর তার মাকে ফোন করে নয়ন বন্ড কাজীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অপরদিকে মিন্নি বলেন, তার বাবা-মা আসতে পারছেন না। তার পক্ষে দু’জন সাক্ষী এনেছেন। এরপর কাজী বিয়ে পড়ান।
এই বিয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নয়নের মা সাহিদা বেগম সাংবাদিককে বলেন, ‘মিন্নি ও নয়ন কাজী অফিসে যাওয়ার পর কাজী মিন্নির চাচাকে ফোন করে বলেন, আপনার ভাতিজি এখানে বিয়ে করতে এসেছে। এরপর নানা জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে ওইদিন আর কাজী অফিসে বিয়ে হয়নি।
পরের দিন ১৫ অক্টোবর (২০১৮) এই বাড়িতেই (নয়ন বন্ডের বাড়ি) কাজী বিয়ে পড়ান। রিফাত শরীফের সঙ্গে যখন মিন্নির বিয়ে হয়, তখন নয়ন বন্ড জেলে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নয়ন জেল থেকে বের হওয়ার পর মিন্নি আবার বাসায় আসতে শুরু করলে আমি নয়নকে বলি, এই তুই আরেকজনের বউকে নিয়ে ঘরে আস, তোর লজ্জা নাই? এর জবাবে নয়ন বলে, মা তুমি চুপ করো।’
পরবর্তীকালে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির আনুষ্ঠানিক বিয়ে পড়ান বরগুনা সদরের কাজী এইচএম রহিম। কিন্তু এ বিষয়ে জানতে চাইলে নয়ন বন্ডের মা যুগান্তরকে বলেন, ওই বিয়ের বিষয়টি তারা জানতেন না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ছেলে যখন কাজী অফিসে গিয়ে মিন্নিকে বিয়ে করে তখন কাজী আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।
এদিকে বিয়ের সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। সূত্র বলছে, প্রভাবশালীদের চাপে সাক্ষীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। এই বিয়ের কাবিন প্রসঙ্গে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর বলেন, এটা একটা সাজানো কাবিননামা। রিফাত খুনের পর তৈরি করা হয়েছে। এর কোনো ভিত্তি নেই।
প্রভাবশালীরা চাইলে কিনা করতে পারে। শম্ভু বাবুর বিরুদ্ধে কথা বলে পরিবারসহ আমি নিজেও জীবন নিয়ে সংশয়ের মধ্যে আছি। যে কোনোদিন আমিও নিহত হতে পারি। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে পর্যন্ত যেতে পারছে না।
সূত্র: যুগান্তর