ঢাকা ০৪:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২২:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০১৯
  • ২৫৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর সরকারি-বেরসকারি হাসপাতালগুলোর কেবিন, ওয়ার্ড, বারান্দাসহ সব জায়গায়ই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না, মিলছে না সিট। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪০৩ জন। অর্থাৎ ঘণ্টায় ১৭ জন। এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা।

উচ্চতাপমাত্রার জ্বর, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও অস্পষ্টতায় আছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। যশোরে শনাক্ত হয়েছে ১২ রোগী। ওখানকার জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, যশোরের এ রোগীরা ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছে।

এদিকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ডেঙ্গু। রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার রোগী। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে পাঁচজন। এ ছাড়া গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সাহাদৎ হোসেন হাজরা (৫৩) মারা গেছেন। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো।

চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ও বমি বমির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবার ডেঙ্গু রোগীদের। কারণ ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন ডেঙ্গু হলে সামান্য জ্বরেই রোগীর হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে অন্যান্য বছরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। একই সঙ্গে রোগী দ্রুত শকে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা বেড়েছে। এ কারণে এবার বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীরই মৃত্যু হয়েছে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’। এ কারণে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, শুধু রোগীরা নন, চিকিৎসকরা ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন।

জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি থাকায় নতুন কোনো রোগী ভর্তি করতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালের নির্দিষ্ট সিট কিংবা কেবিন সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। স্বজনরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। উপায় না পেয়ে সরকারি হাসপাতালের বারান্দা কিংবা খালি যেকোনো জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গরমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকছে। এসব জায়গায় এডিস মশা ডিম পাড়ছে। যে কারণে হঠাৎ এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। আর এ কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপও ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সরকারি হিসাব মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ১৭৯ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৫ জন। এ ছাড়া চলতি মাসের মাত্র ২১ দিনেই এ মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।

তবে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাই বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদফতরে নেই। সরকারি হিসাবে শুধু হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের হিসাব রয়েছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তাগাদা সত্ত্বেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাঠানো হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ১৭ রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে মিটফোর্ডে ৩৮, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ৪৫, বারডেমে ৮, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ১৫, মুগদা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, বিজিবি হাসপাতালে ৫ ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৯ জন ভর্তি হয়েছে।

বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ১২৩ জনের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেলে ২১, ইবনে সিনায় ১১, স্কয়ারে ৭, সেন্ট্রালে ১৭, গ্রিন লাইফে ৮, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল কাকরাইলে ১১, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৮, খিদমা হাসপাতালে ৪, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯, সালাউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ ও পপুলার হাসপাতালে ১৪ জন ভর্তি রয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমানে শুধু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৬ হাজার ৬৬৫ জন রোগী।

এদিকে এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা। উচ্চতাপমাত্রা, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও আছে বিভ্রান্তি।

এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮-এর নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্লেটলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে রক্তের ঘনত্ব নির্ণয় করে দিতে হবে চিকিৎসা। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তের অণুচক্রিকা নয়, গুরুত্ব দিতে হয় ঘনত্বের দিকে।

তারা আরো বলছেন, একটা সময় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্লাটিলেট হিসাবই সবার আগে বিবেচনা করা হতো। আর প্লাটিলেট লাখের নিচে নামলেই দেওয়া হতো রক্ত। তবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮ সালে এসেছে নতুন নির্দেশনা। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট দিয়ে রোগীর অবস্থা জানলেও ১০ হাজারের নিচে নামলে কিংবা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের আগে দিতে হয় না রক্ত।

এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম মনির হোসেন বলেন, যে পর্যায়ে রোগী শকে চলে যায়, ওটার নাম ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম। ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম মানে হলো রক্তনালির পুরগুলো খুলে যাওয়া, প্লাজমা লিকেজ হয়ে যায়। প্লেটলেট এখন আমরা দিচ্ছি না, প্লেটলেট এখন জরুরি না। কিন্তু প্লেটলেট দেখে আমরা রোগীর অবস্থান শনাক্ত করি। রোগী খারাপের দিকে যাচ্ছে, নাকি ভালোর দিকে।

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আগে থেকেই হার্ট, কিডনি সমস্যা আছে, শিশু, প্রসূতি মা কিংবা যাদের ওজন একটু বেশি তাদের চিকিৎসায় বাড়তি সতর্কতা রয়েছে।

অন্যদিকে এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো। জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এদিকে ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের কার্যক্রমের বিষয়ে জানাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেছেন হাইকোর্ট। গত রোববার বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

যশোরে ১২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত

যশোর প্রতিনিধি জানান, যশোরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চলতি বর্ষা মৌসুমে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নড়াইলের একজনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, আটজন ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মিলেছে। আর তারা ঢাকায় অবস্থানকালে আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

গত ১৯ জুলাই যশোর ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে মারা যান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রানী (৫৩)। তিনি নড়াইল সদর উপজেলার কুড়িগ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে।

যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে দুজন ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের বাড়ি যশোরসহ বিভিন্ন জেলায়। তারা ঢাকায় থাকত। সেখানে আক্রান্ত হয়েছে। যশোরে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঘোপ সেন্ট্রাল রোড ফারজানা আক্তার (২৩), যশোর সরকারি এমএম কলেজ রোড এলাকার তিতলী সিকদার (১৮), পুরাতন কসবার পুলিশ লাইনস এলাকার রিফাত রহমান (১৮), উপশহরের এলাকার ইশান (১৪), কারবালা এলাকার নাফিজা আক্তার (২১), চৌগাছা উপজেলা সদরের আম্রকানপাড়ার তাসপিয়া চৌধুরী তুবা (৭), শার্শা উপজেলার টেকরালী এলাকার আনোয়ার হোসেন (২৫), কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের খালিদুজ্জামান (২৭), বাঘারপাড়া উপজেলার ক্ষেত্রপালা এলাকার ইমামুল হোসেন (২৫), ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার লক্ষ্মীকু- এলাকার জাহিদুল ইসলাম খান (৩৫) ও সদরের আরিফুল ইসলাম (৩৫) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

ডেপুটি সিভিল সার্জন হারুন অর রশিদ আরো বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসা নিতে হবে। সব সময় মশারির মধ্যে থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। আলোচনা সভায় সতর্কতা অবলম্বন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়

আপডেট টাইম : ১২:২২:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর সরকারি-বেরসকারি হাসপাতালগুলোর কেবিন, ওয়ার্ড, বারান্দাসহ সব জায়গায়ই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না, মিলছে না সিট। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪০৩ জন। অর্থাৎ ঘণ্টায় ১৭ জন। এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা।

উচ্চতাপমাত্রার জ্বর, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও অস্পষ্টতায় আছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। যশোরে শনাক্ত হয়েছে ১২ রোগী। ওখানকার জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, যশোরের এ রোগীরা ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছে।

এদিকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ডেঙ্গু। রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার রোগী। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে পাঁচজন। এ ছাড়া গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সাহাদৎ হোসেন হাজরা (৫৩) মারা গেছেন। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো।

চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ও বমি বমির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবার ডেঙ্গু রোগীদের। কারণ ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন ডেঙ্গু হলে সামান্য জ্বরেই রোগীর হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে অন্যান্য বছরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। একই সঙ্গে রোগী দ্রুত শকে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা বেড়েছে। এ কারণে এবার বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীরই মৃত্যু হয়েছে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’। এ কারণে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, শুধু রোগীরা নন, চিকিৎসকরা ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন।

জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি থাকায় নতুন কোনো রোগী ভর্তি করতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালের নির্দিষ্ট সিট কিংবা কেবিন সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। স্বজনরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। উপায় না পেয়ে সরকারি হাসপাতালের বারান্দা কিংবা খালি যেকোনো জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গরমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকছে। এসব জায়গায় এডিস মশা ডিম পাড়ছে। যে কারণে হঠাৎ এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। আর এ কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপও ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সরকারি হিসাব মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ১৭৯ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৫ জন। এ ছাড়া চলতি মাসের মাত্র ২১ দিনেই এ মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।

তবে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাই বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদফতরে নেই। সরকারি হিসাবে শুধু হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের হিসাব রয়েছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তাগাদা সত্ত্বেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাঠানো হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ১৭ রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে মিটফোর্ডে ৩৮, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ৪৫, বারডেমে ৮, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ১৫, মুগদা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, বিজিবি হাসপাতালে ৫ ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৯ জন ভর্তি হয়েছে।

বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ১২৩ জনের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেলে ২১, ইবনে সিনায় ১১, স্কয়ারে ৭, সেন্ট্রালে ১৭, গ্রিন লাইফে ৮, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল কাকরাইলে ১১, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৮, খিদমা হাসপাতালে ৪, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯, সালাউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ ও পপুলার হাসপাতালে ১৪ জন ভর্তি রয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমানে শুধু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৬ হাজার ৬৬৫ জন রোগী।

এদিকে এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা। উচ্চতাপমাত্রা, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও আছে বিভ্রান্তি।

এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮-এর নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্লেটলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে রক্তের ঘনত্ব নির্ণয় করে দিতে হবে চিকিৎসা। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তের অণুচক্রিকা নয়, গুরুত্ব দিতে হয় ঘনত্বের দিকে।

তারা আরো বলছেন, একটা সময় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্লাটিলেট হিসাবই সবার আগে বিবেচনা করা হতো। আর প্লাটিলেট লাখের নিচে নামলেই দেওয়া হতো রক্ত। তবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮ সালে এসেছে নতুন নির্দেশনা। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট দিয়ে রোগীর অবস্থা জানলেও ১০ হাজারের নিচে নামলে কিংবা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের আগে দিতে হয় না রক্ত।

এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম মনির হোসেন বলেন, যে পর্যায়ে রোগী শকে চলে যায়, ওটার নাম ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম। ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম মানে হলো রক্তনালির পুরগুলো খুলে যাওয়া, প্লাজমা লিকেজ হয়ে যায়। প্লেটলেট এখন আমরা দিচ্ছি না, প্লেটলেট এখন জরুরি না। কিন্তু প্লেটলেট দেখে আমরা রোগীর অবস্থান শনাক্ত করি। রোগী খারাপের দিকে যাচ্ছে, নাকি ভালোর দিকে।

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আগে থেকেই হার্ট, কিডনি সমস্যা আছে, শিশু, প্রসূতি মা কিংবা যাদের ওজন একটু বেশি তাদের চিকিৎসায় বাড়তি সতর্কতা রয়েছে।

অন্যদিকে এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো। জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এদিকে ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের কার্যক্রমের বিষয়ে জানাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেছেন হাইকোর্ট। গত রোববার বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

যশোরে ১২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত

যশোর প্রতিনিধি জানান, যশোরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চলতি বর্ষা মৌসুমে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নড়াইলের একজনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, আটজন ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মিলেছে। আর তারা ঢাকায় অবস্থানকালে আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

গত ১৯ জুলাই যশোর ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে মারা যান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রানী (৫৩)। তিনি নড়াইল সদর উপজেলার কুড়িগ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে।

যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে দুজন ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের বাড়ি যশোরসহ বিভিন্ন জেলায়। তারা ঢাকায় থাকত। সেখানে আক্রান্ত হয়েছে। যশোরে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঘোপ সেন্ট্রাল রোড ফারজানা আক্তার (২৩), যশোর সরকারি এমএম কলেজ রোড এলাকার তিতলী সিকদার (১৮), পুরাতন কসবার পুলিশ লাইনস এলাকার রিফাত রহমান (১৮), উপশহরের এলাকার ইশান (১৪), কারবালা এলাকার নাফিজা আক্তার (২১), চৌগাছা উপজেলা সদরের আম্রকানপাড়ার তাসপিয়া চৌধুরী তুবা (৭), শার্শা উপজেলার টেকরালী এলাকার আনোয়ার হোসেন (২৫), কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের খালিদুজ্জামান (২৭), বাঘারপাড়া উপজেলার ক্ষেত্রপালা এলাকার ইমামুল হোসেন (২৫), ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার লক্ষ্মীকু- এলাকার জাহিদুল ইসলাম খান (৩৫) ও সদরের আরিফুল ইসলাম (৩৫) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

ডেপুটি সিভিল সার্জন হারুন অর রশিদ আরো বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসা নিতে হবে। সব সময় মশারির মধ্যে থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। আলোচনা সভায় সতর্কতা অবলম্বন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।