এক বছরেরও বেশি সময় আগে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে পুনর্জন্ম হয়েছিল মাহাথির মোহাম্মদের। নবতিপর মাহাথির ফের বনে যান দেশটির ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী। চলতি মাসে ৯৪ বছর বয়সে পা রেখেছেন মালয়েশিয়ার এই প্রবীণ রাষ্ট্রনায়ক। তবে রাজনীতিতে তাঁর প্রত্যাবর্তনে আদৌ কি ভিন্ন পথে হাঁটতে পারছে মালয়েশিয়া? পরিস্থিতি বলছে, যে লাউ সেই কদু!
গত বছরের আগে মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন তিনি। এ কাজের জন্য এখনো মালয়েশিয়া তথা এশিয়ায় তাঁকে সমীহের চোখে দেখা হয়। তবে মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কারণে ব্যাপক সমালোচিতও ছিলেন। এই সমালোচনার যৌক্তিক ভিত্তি ছিল। ২০১৮ সালে অভাবনীয়ভাবে ক্ষমতায় আসার আগে বেশ কিছু চমক জাগানো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাহাথির। দীর্ঘদিনের দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) ছেড়ে পাকাতান হারাপানে যোগ দেন তিনি। জানিয়েছিলেন, সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বদলে ফেলার সংকল্প।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, পরিবর্তনের বদলে নিজের ক্ষমতা ও গদি ধরে রাখতেই বেশি আগ্রহী তিনি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ভরাডুবি হয়েছিল লাগামছাড়া দুর্নীতির কারণে। সেই সঙ্গে সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগও ছিল। নানা ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের ছায়াতেই চালানো হতো এসব। এই আইনগুলোর বেশির ভাগই আবার মাহাথির মোহাম্মদের আমলেই প্রণীত। সেসব আইন বাতিলের এবং উদার নাগরিক অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাহাথির। কিন্তু গত এক বছরে সেসব আইন বাতিলের তেমন কোনো উদ্যোগই নেননি তিনি। উল্টো এই সময়ে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির গতি শ্লথ হয়েছে।
রাষ্ট্রদ্রোহ ও সমকামিতার অভিযোগ এনে যাকে-তাকে গারদে পোরাও বন্ধ হয়নি। নির্বাচিত হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা সীমিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সে পথ মাড়াচ্ছেন না মাহাথির। বন্ধ হয়নি সংবাদমাধ্যমে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বর্ণবাদী রাজনীতির ধারাও।
সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করছেন মাহাথির মোহাম্মদ নিজেই। বন্ধু থেকে শত্রু এবং শত্রু থেকে ফের বন্ধু হওয়া আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী করার ‘চুক্তি’র বিনিময়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। আনোয়ারকে রাজকীয় ক্ষমা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে চাইছেন না এখন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছেন তিনি। বলছেন, এখনো প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে যাওয়ার সময় আসেনি। আরও কিছুদিন সরকারে নেতৃত্ব দেওয়ার বাসনাও জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই ‘কিছুদিন’ আর কত দিন, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না ৯৪ বছরের এই প্রধানমন্ত্রী।
আর এসব থেকেই বিশ্লেষকদের শঙ্কা, ফের আগের রূপে ফিরে যাচ্ছেন মাহাথির। ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে সব উত্তরসূরির এক নম্বর সমালোচক ছিলেন তিনি। মাহাথিরের পর মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক হিসেবে ধরা হয় আনোয়ার ইব্রাহিমকে। আনোয়ারকে হাতে ধরে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানালেও, একসময় নিজেই তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। এনেছিলেন সমকামিতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। আবার সেই আনোয়ারকেই পরিস্থিতির প্রয়োজনে তিনি বন্ধু বানিয়েছেন। এখন তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করছেন।
ইউনিভার্সিটি অব মালয়ের শিক্ষক আওয়াং আজমান আওয়াং পাওয়ি বলছেন, মাহাথির মোহাম্মদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি যতটা ক্ষমতালিপ্সু ছিলেন, এখনো তাই আছেন। ক্ষমতায় যখন ছিলেন না, তখন রাজনীতির প্রয়োজনেই বিনয়ী হওয়ার ভেক ধরেছিলেন।
মালয়েশিয়ার রাজনীতি গত এক মাস ধরেই উত্তপ্ত। এর মূলে রয়েছে একটি সেক্সটেপ। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিতর্কিত ভিডিওচিত্রটি দেশটির বিভিন্ন সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সমকামিতায় জড়িয়ে পড়েছেন মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মসূচিবিষয়ক মন্ত্রী আজমিন আলী। আনোয়ার ইব্রাহিমের পিপলস জাস্টিস পার্টির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হলেন আজমিন। প্রধানমন্ত্রী পদে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হয় তাঁকে। দলেও দুজনের দুটি ভাগ আছে। যদিও এই ভিডিওচিত্রের সত্যাসত্য নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি। পুলিশ এ নিয়ে তদন্ত করছে। তবে এরই মধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে শুরু হয়ে গেছে বহুমাত্রিক ‘নোংরা’ খেলা। তাতে অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরও। সুযোগ বুঝে আনোয়ার ইব্রাহিমকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন।
মালয়েশিয়ায় সমকামিতা গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাজনীতিতে এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল আনোয়ার ইব্রাহিমকে দিয়ে। এই অভিযোগেই তাঁকে কারাগারে আটকে রেখেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ ও নাজিব রাজাক। শেষে আনোয়ার সমকামিতার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলেও, রাজনীতিতে এর ব্যবহার বন্ধ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার মালয়েশিয়ার খবরে বলা হয়েছে, মন্ত্রী আজমিন আলী এরই মধ্যে সমকামিতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ—রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন তিনি। আর যে আনোয়ার ইব্রাহিম সমকামিতার অভিযোগে সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন, তিনিই আবার আজমিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। মাহাথির নিয়েছেন আজমিনের পক্ষ। সব মিলিয়ে বলা যায়, যে যাঁর স্বার্থ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মাঝখানে পড়ে নষ্ট হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভালো হওয়ার সুযোগ।
মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধানের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ বলছে, যৌনতার ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ইন্ধন রয়েছে। ওই নেতা নাকি আবার মাহাথির মোহাম্মদের উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে আছেন! ওই নেতার নাম-পরিচয় প্রকাশ না করলেও পুলিশ প্রধান আবদুল হামিদ বাদোর জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই এই ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মাহাথিরের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ছেলে মুখরিজ মাহাথির। তিনি এখন উত্তরাঞ্চলীয় কেদাহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুখরিজ বলেছেন, কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বড় ভূমিকায় থাকতে চান তিনি। তবে তা কোন পদে থেকে—তা স্পষ্ট করেননি মাহাথিরের ছেলে। তিনি আরও বলেছেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর বাবার ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি থাকলেও, তা লিখিত নয়। এবং সেখানে নাকি মাহাথির মোহাম্মদের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সময়সীমা নিয়েও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মাহাথির মোহাম্মদের সরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্দেশ্য মূলকভাবে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যালোচকদের আশঙ্কা, ২০২৩ সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে হয়তো আর ক্ষমতার স্বাদই পাবেন না আনোয়ার ইব্রাহিম। লক্ষণ অন্তত তেমনই।
মাহাথির মোহাম্মদ অবশ্য প্রকাশ্যে বলছেন, আনোয়ার ইব্রাহিমকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করবেন। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে এক ব্যবসায়িক সম্মেলনে মাহাথির বলেছেন, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সময়সীমা সুনির্দিষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমি একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যদিও তাঁর (আনোয়ার) সঙ্গে আমার সম্পর্ক সব সময় অতটা ভালো ছিল না। কিন্তু যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা রক্ষা করব।’
মাহাথিরের কথাতেই পরিষ্কার, আর যাই হোক নিকট ভবিষ্যতে ক্ষমতা ছাড়ার ইচ্ছে তাঁর নেই। অথচ মালয়েশিয়ার জনগণ একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশের আশাতেই গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। সেই আশা ক্রমেই ফিকে হচ্ছে। নতুন মালয়েশিয়া গড়ে তোলার বিষয়টি তো দূর অস্ত। এবার দেখার পালা, দেশটির রাজনীতির মাঠে খেলা কোন দিকে মোড় নেয়।