ঢাকা ১০:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরব বসন্তের বলি মোহাম্মদ মুরসি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:২৬:৪০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ জুন ২০১৯
  • ২৬০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আরব বসন্তে কোনো ফুল ফোটেনি। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরশাসন থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি আন্দোলনে ছিলেন মোহাম্মদ মুরসিও। হয়েছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আরেক আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তিনিও, হয়েছেন বিচারের মুখোমুখি। অবশেষে আদালতেই তার মৃত্যু হলো। মুরসির উত্থান ও পতন নিয়ে লিখেছেন পরাগ মাঝি।

আরব বসন্ত ও মুরসির উত্থান- আরবের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে জাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল ইতিহাসের পাতায় তাকেই ‘আরব বসন্ত’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গণজাগরণের শুরুটা ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেদিন তিউনিসিয়ায় বুয়াজিজি নামে এক মুদি দোকানদার দুর্নীতি, অপশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেকারত্বের প্রতিবাদে প্রকাশ্যে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১৬ দিন পর তার মৃত্যু হয়। বুয়াজিজি ছিলেন একজন শিক্ষিত যুবক। পড়াশুনা শেষ করে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি।

উপায়ান্তর না দেখে শেষপর্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে একটি মুদি দোকান নিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু পুলিশকে ঘুষ দিতে না পেরে তার ওই সামান্য ব্যবসাও প-হয়ে যায়। ন্যায়বিচারের জন্যও তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু ফল আসেনি। তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় সে সময় বেন আলী সরকার। বুয়াজিজির আত্মাহুতি বিদ্রোহের আগুন জালিয়ে দেয় তিউনিসিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে। ২৬ ডিসেম্বর বুয়াজিজির মৃত্যুর পর সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। একসময় দেশটির স্বৈরশাসক বেন আলী ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ওই গণজোয়ার শুধুমাত্র তিউনিসিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সীমান্ত ছাড়িয়ে পরবর্তীকালে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ প্রায় সমগ্র আরব অঞ্চলে।

তিউনিসিয়ার পরই স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পাশর্বর্তী দেশ মিসরে। দেশটির সাধারণ মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে হোসনি মোবারকের একনায়কতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে মিসরে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলনের তীব্রতায় মাত্র ১৮ দিনের মধ্যেই ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আন্দোলনে প্রায় সাড়ে আটশো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মুবারকের পতনের পরই শুরু হয় মিসরে নতুন সরকার গঠনের কার্যক্রম। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। ২০১২ সালের ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব তাকে আলোচনায় নিয়ে এসেছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সারা বিশ্বে তিনি মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।

অধ্যাপক থেকে প্রেসিডেন্ট- ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের উত্তরাঞ্চলীয় শারক্বিয়া প্রদেশে মোহাম্মদ মুরসির জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক আর মা ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। সাংবাদিকদের কাছে তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় গাধার পিঠে চড়ে তিনি স্কুলে যেতেন। পরে বিশ্বদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি কায়রোতে চলে আসেন। ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রকৌশল বিষয়ে আতক এবং ১৯৭৮ সালে একই বিষয়ে আতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকৌশল বিষয়ে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮২ সালেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ইমামতিও করতেন। ১৯৮৫ সালে তিনি আমেরিকায় অধ্যাপনা ছেড়ে মিসরে ফিরে আসেন। তার জন্মস্থান শারক্বিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০০০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কারণ হোসনি মুবারকের শাসনামলে মিসরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড।

২০১১ সালে মিসরে মুবারকবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নামে নতুন একটি দল গঠন করে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব। এই দলের চেয়ারম্যান পদের জন্য মুরসি সম্ভাব্য নেতা ছিলেন। কারণ তিনি একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ২০০৬ সালের ১৮ মে তাকে আটক করে ৭ মাস জেলে রাখা হয়। আরব বসন্তে মুবারকবিরোধী আন্দোলনের দায়ে  ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে আটক করা হয় এবং এর পর থেকে তার ছেলেমেয়ে ও পরিবারের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের বিপদের খড়গ।

২০১২ সালের নির্বাচনে দলীয় উপনেতা ও রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে খাইরাত এল-শাতেরই ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই শাতেরসহ একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে উঠে আসে মোহাম্মদ মুরসির নাম।

২০১২ সালের ২৩ মে অনুষ্ঠিত মিসরের নির্বাচনে কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫.৫ শতাংশ ভোট পান মুরসি। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার জন্য কোনো প্রার্থীকে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার নিয়ম থাকায় প্রথম পর্বে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশটির দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন। এই পর্যায়ে মুরসির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আহমেদ শফিক। দ্বিতীয় পর্বে নির্বাচনের আগে মিসরের সর্বস্তরের মানুষকে শফিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান মুরসি। কারণ আহমেদ শফিক ছিলেন সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এবং হোসনি মুবারকের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মুরসি বলেন, ‘শফিক নির্বাচিত হলে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসন নতুন জীবন পাবে।’

দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। কারণ নির্বাচনের পর দুই প্রার্থীই সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হওয়ার দাবি করেন। অবশেষে নির্বাচন কমিশন ২০১২ সালের ২৪ জুন মুরসিকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫১.৭ শতাংশ। এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার পরই ইখওয়ান এবং ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি থেকে নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগ করেন মুরসি। এরপর ২০১২ সালের ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

এক বছর তিন দিনের ক্ষমতা- রাজধানী কায়রোতে মিসরের সাংবিধানিক আদালতে শপথ নেন মুরসি। তিনিই ছিলেন মিসরের প্রথম ইসলামপন্থি প্রেসিডেন্ট যিনি কখনো সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না। শপথ গ্রহণের পর কায়রো বিশ^বিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণে তিনি জানান, সেনাবাহিনীকে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের মতোই রক্ষা করবেন। এই বাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিকল্প হতে পারে না। মাত্র এক বছর ৩ দিন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন মুরসি। প্রথমেই তিনি চীন সফর করেন, পরে যান রাশিয়ায়। এভাবে ব্রাজিল, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত সফর করেন।

২০১২ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ অভিবাসনের চেষ্টা চালালে তিনি প্রতিবাদ জানান এবং তেলআবিব থেকে মিসরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। প্রধানমন্ত্রী কিনদিলকে গাজায় পাঠান সাহায্যের চিহ্নস্বরূপ। কিনদিল হামাসের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঐকমত্য ঘোষণা করেন এবং খুলে দেওয়া হয় রাফাহ সুড়ঙ্গ। এই ঘটনায় আরব বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হন মুরসি।

মিসরের সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্যও বিরাট অংকের বাজেট নির্ধারণ করেন মুরসি। নির্বাচনী প্রচারণায় মিসরকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতায় এসেই নতুন খাদ্য গুদাম বানানোও শুরু করেন এবং কৃষকদের চাষ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সহযোগিতা ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাদ্য আমদানি করা রাষ্ট্র হলো মিসর।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিলেন মুরসি। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হাইয়ার সেকেন্ডারি লেভেলে তিনি পাশ্চাত্য সিলেবাস বাতিল করার পদক্ষেপ নেন এবং মিসরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাধান্য দিয়ে বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে মিসরের বাজার তুর্কিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।

মুরসির এসব নানা উদ্যোগ আসলে কোনো ফল বয়ে আনেনি। কারণ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামানো তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাকেই ফুটিয়ে তুলছিল। তার নানা উদ্যোগ আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সেনা সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাকে উৎখাতের চক্রান্ত চলতে থাকে, যার পরিণতি পায় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই।

ক্ষমতায় সিসি, জেলখানায় মুরসি-২০১৩ সালের জুলাই মাসে শুরুতে মিসরের রাজনীতি নতুন মোড় নিল। মুরসিবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থি মোর্চার ব্যানারে আবারও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সংঘটিত হয় মিসরে। দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনী স্পষ্টতই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিয়েছিল। ফলে মাত্র চারদিনের আন্দোলনেই পতন ঘটে মুরসি সরকারের। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সংবিধান স্থগিতের ঘোষণা দেন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। শুধু ক্ষমতাচ্যুতিই নয়, মুরসি-সহ আরও বেশ কয়েকজন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মুরসির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। এসব কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতা, বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটনশিল্পকে জাগিয়ে তুলতে না পারা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা আনায় ব্যর্থতা। সমালোচকদের মতে, মাত্র এক বছরের মধ্যে এতগুলো বিষয় সম্পাদন করা খুব দুরূহ ব্যাপার বটে, তবে ওই সময়ের মধ্যে ভালো কিছু করার ইঙ্গিতও দিতে পারেননি মুরসি। দেশটির আল-হায়াত টিভির জরিপে দেশটির সাধারণ মানুষ তাদের আশাহতের কথা জানায়। জরিপে ৭৩ শতাংশ মানুষ মত দেয়, এক বছরে জনগণের জন্য কোনো ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি মুরসি। ৬৩ শতাংশ মনে করেন, মুরসির শাসনকালে তাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত কমে গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার পাশাপাশি কৌশলেও ভুল ছিল মুরসির। তিনি তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের কাছাকাছি ভাবাদর্শেই মিসরকে পরিচালনার চেষ্টা করছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের তিনি মূল্যায়ন করেননি। ফলে মুরসি ও তার দল রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। বিরোধীরা সরকারের ব্যর্থতাগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। জনগণের সামনে ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরে আন্দোলনের ডাক দেয় এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তারা সফলও হয়।

বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, ক্ষমতায় আসার পর সিসি’কে সেনাবাহিনী থেকে না সরিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করে অনেক বড় ভুল করেছিলেন মুরসি। এই ভুলের অনেক বড় খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। ধূর্ত সিসি সুযোগ পাওয়া মাত্রই মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তব্যে সিসি জানান, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় মিসরের প্রধান বিচারপতি আদিল আল-মনসুরকে।

মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরোধীরা উল্লাসে মেতে ওঠে এবং প্রতিবাদ জানাতে তার সমর্থকরাও রাস্তায় নেমে আসে। অনেক জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। মুরসি সমর্থকদের বিক্ষোভ দমনেও কঠোর মনোভাব দেখানোর পাশাপাশি মুরসি-সহ তার ঘনিষ্ঠ ১২ জন রাজনৈতিক সহযোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে গৃহবন্দি করে দেশটির সেনাবাহিনী।

জানা যায়, স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে যে জমায়েত হয়েছিল, মুরসিবিরোধী আন্দোলন তাকেও ছাড়িয়ে যায়। অনেকের মতে, মুবারকের সময় দেশটির মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে সৌহার্দ্য ছিল মুরসি ক্ষমতায় আসার পর তা নষ্ট হয়ে যায়।

সরকারবিরোধীরা অভিযোগ করে, তারা মুবারকের স্বৈরশাসন থেকে যেমন বাঁচতে চেয়েছিল, তেমনি চেয়েছিল স্বাধীনভাবে চলতে, ফিরতে, কথা বলতে, উঠতে-বসতে। কিন্তু মুরসি তাদের স্বাধীনতার স্বাদ দিতে ব্যর্থ হন। তার গোড়া এবং কট্টরপন্থি ভূমিকা নিরপেক্ষ মানুষদের হতাশ করেছিল।

তবে অনেকেই মনে করে মুরসির সরলতাই তার পতনের কারণ। তিনি রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় থাকা তার শত্রুদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গেলে অফিসাররা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। তিনজন অফিসার দুজনের মধ্যবর্তী ব্যক্তিকে মুরসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, ইনি ব্রিগেডিয়ার ইবরাহিম শারবিনী।

মুরসি মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাকে তো আমি আগে থেকেই চিনি; তিনিই তো আমাকে রাত ২টায় বাসা থেকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন। এবং তার সঙ্গে পাশের আপনারা দু’জনও সেদিন ছিলেন।’ একথা শুনে উপস্থিত সকলেই একযোগে হেসে ওঠেন। এই হাসির আড়ালেই চলছিল মুরসিকে সরিয়ে দেওয়ার খেলাটি। এই খেলাই একসময় তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে আর ২০১৪ সালের ৮ জুন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান সিসিকে নিয়ে আসে মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

আরব বসন্তের বলি মোহাম্মদ মুরসি

আপডেট টাইম : ০৫:২৬:৪০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ জুন ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আরব বসন্তে কোনো ফুল ফোটেনি। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরশাসন থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি আন্দোলনে ছিলেন মোহাম্মদ মুরসিও। হয়েছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আরেক আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তিনিও, হয়েছেন বিচারের মুখোমুখি। অবশেষে আদালতেই তার মৃত্যু হলো। মুরসির উত্থান ও পতন নিয়ে লিখেছেন পরাগ মাঝি।

আরব বসন্ত ও মুরসির উত্থান- আরবের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে জাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল ইতিহাসের পাতায় তাকেই ‘আরব বসন্ত’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গণজাগরণের শুরুটা ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেদিন তিউনিসিয়ায় বুয়াজিজি নামে এক মুদি দোকানদার দুর্নীতি, অপশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেকারত্বের প্রতিবাদে প্রকাশ্যে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১৬ দিন পর তার মৃত্যু হয়। বুয়াজিজি ছিলেন একজন শিক্ষিত যুবক। পড়াশুনা শেষ করে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি।

উপায়ান্তর না দেখে শেষপর্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে একটি মুদি দোকান নিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু পুলিশকে ঘুষ দিতে না পেরে তার ওই সামান্য ব্যবসাও প-হয়ে যায়। ন্যায়বিচারের জন্যও তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু ফল আসেনি। তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় সে সময় বেন আলী সরকার। বুয়াজিজির আত্মাহুতি বিদ্রোহের আগুন জালিয়ে দেয় তিউনিসিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে। ২৬ ডিসেম্বর বুয়াজিজির মৃত্যুর পর সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। একসময় দেশটির স্বৈরশাসক বেন আলী ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ওই গণজোয়ার শুধুমাত্র তিউনিসিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সীমান্ত ছাড়িয়ে পরবর্তীকালে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ প্রায় সমগ্র আরব অঞ্চলে।

তিউনিসিয়ার পরই স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পাশর্বর্তী দেশ মিসরে। দেশটির সাধারণ মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে হোসনি মোবারকের একনায়কতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে মিসরে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলনের তীব্রতায় মাত্র ১৮ দিনের মধ্যেই ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আন্দোলনে প্রায় সাড়ে আটশো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মুবারকের পতনের পরই শুরু হয় মিসরে নতুন সরকার গঠনের কার্যক্রম। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। ২০১২ সালের ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব তাকে আলোচনায় নিয়ে এসেছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সারা বিশ্বে তিনি মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।

অধ্যাপক থেকে প্রেসিডেন্ট- ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের উত্তরাঞ্চলীয় শারক্বিয়া প্রদেশে মোহাম্মদ মুরসির জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক আর মা ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। সাংবাদিকদের কাছে তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় গাধার পিঠে চড়ে তিনি স্কুলে যেতেন। পরে বিশ্বদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি কায়রোতে চলে আসেন। ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রকৌশল বিষয়ে আতক এবং ১৯৭৮ সালে একই বিষয়ে আতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকৌশল বিষয়ে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮২ সালেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ইমামতিও করতেন। ১৯৮৫ সালে তিনি আমেরিকায় অধ্যাপনা ছেড়ে মিসরে ফিরে আসেন। তার জন্মস্থান শারক্বিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০০০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কারণ হোসনি মুবারকের শাসনামলে মিসরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড।

২০১১ সালে মিসরে মুবারকবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নামে নতুন একটি দল গঠন করে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব। এই দলের চেয়ারম্যান পদের জন্য মুরসি সম্ভাব্য নেতা ছিলেন। কারণ তিনি একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ২০০৬ সালের ১৮ মে তাকে আটক করে ৭ মাস জেলে রাখা হয়। আরব বসন্তে মুবারকবিরোধী আন্দোলনের দায়ে  ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে আটক করা হয় এবং এর পর থেকে তার ছেলেমেয়ে ও পরিবারের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের বিপদের খড়গ।

২০১২ সালের নির্বাচনে দলীয় উপনেতা ও রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে খাইরাত এল-শাতেরই ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই শাতেরসহ একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে উঠে আসে মোহাম্মদ মুরসির নাম।

২০১২ সালের ২৩ মে অনুষ্ঠিত মিসরের নির্বাচনে কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫.৫ শতাংশ ভোট পান মুরসি। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার জন্য কোনো প্রার্থীকে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার নিয়ম থাকায় প্রথম পর্বে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশটির দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন। এই পর্যায়ে মুরসির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আহমেদ শফিক। দ্বিতীয় পর্বে নির্বাচনের আগে মিসরের সর্বস্তরের মানুষকে শফিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান মুরসি। কারণ আহমেদ শফিক ছিলেন সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এবং হোসনি মুবারকের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মুরসি বলেন, ‘শফিক নির্বাচিত হলে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসন নতুন জীবন পাবে।’

দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। কারণ নির্বাচনের পর দুই প্রার্থীই সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হওয়ার দাবি করেন। অবশেষে নির্বাচন কমিশন ২০১২ সালের ২৪ জুন মুরসিকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫১.৭ শতাংশ। এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার পরই ইখওয়ান এবং ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি থেকে নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগ করেন মুরসি। এরপর ২০১২ সালের ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

এক বছর তিন দিনের ক্ষমতা- রাজধানী কায়রোতে মিসরের সাংবিধানিক আদালতে শপথ নেন মুরসি। তিনিই ছিলেন মিসরের প্রথম ইসলামপন্থি প্রেসিডেন্ট যিনি কখনো সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না। শপথ গ্রহণের পর কায়রো বিশ^বিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণে তিনি জানান, সেনাবাহিনীকে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের মতোই রক্ষা করবেন। এই বাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিকল্প হতে পারে না। মাত্র এক বছর ৩ দিন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন মুরসি। প্রথমেই তিনি চীন সফর করেন, পরে যান রাশিয়ায়। এভাবে ব্রাজিল, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত সফর করেন।

২০১২ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ অভিবাসনের চেষ্টা চালালে তিনি প্রতিবাদ জানান এবং তেলআবিব থেকে মিসরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। প্রধানমন্ত্রী কিনদিলকে গাজায় পাঠান সাহায্যের চিহ্নস্বরূপ। কিনদিল হামাসের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঐকমত্য ঘোষণা করেন এবং খুলে দেওয়া হয় রাফাহ সুড়ঙ্গ। এই ঘটনায় আরব বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হন মুরসি।

মিসরের সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্যও বিরাট অংকের বাজেট নির্ধারণ করেন মুরসি। নির্বাচনী প্রচারণায় মিসরকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতায় এসেই নতুন খাদ্য গুদাম বানানোও শুরু করেন এবং কৃষকদের চাষ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সহযোগিতা ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাদ্য আমদানি করা রাষ্ট্র হলো মিসর।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিলেন মুরসি। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হাইয়ার সেকেন্ডারি লেভেলে তিনি পাশ্চাত্য সিলেবাস বাতিল করার পদক্ষেপ নেন এবং মিসরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাধান্য দিয়ে বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে মিসরের বাজার তুর্কিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।

মুরসির এসব নানা উদ্যোগ আসলে কোনো ফল বয়ে আনেনি। কারণ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামানো তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাকেই ফুটিয়ে তুলছিল। তার নানা উদ্যোগ আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সেনা সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাকে উৎখাতের চক্রান্ত চলতে থাকে, যার পরিণতি পায় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই।

ক্ষমতায় সিসি, জেলখানায় মুরসি-২০১৩ সালের জুলাই মাসে শুরুতে মিসরের রাজনীতি নতুন মোড় নিল। মুরসিবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থি মোর্চার ব্যানারে আবারও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সংঘটিত হয় মিসরে। দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনী স্পষ্টতই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিয়েছিল। ফলে মাত্র চারদিনের আন্দোলনেই পতন ঘটে মুরসি সরকারের। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সংবিধান স্থগিতের ঘোষণা দেন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। শুধু ক্ষমতাচ্যুতিই নয়, মুরসি-সহ আরও বেশ কয়েকজন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মুরসির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। এসব কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতা, বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটনশিল্পকে জাগিয়ে তুলতে না পারা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা আনায় ব্যর্থতা। সমালোচকদের মতে, মাত্র এক বছরের মধ্যে এতগুলো বিষয় সম্পাদন করা খুব দুরূহ ব্যাপার বটে, তবে ওই সময়ের মধ্যে ভালো কিছু করার ইঙ্গিতও দিতে পারেননি মুরসি। দেশটির আল-হায়াত টিভির জরিপে দেশটির সাধারণ মানুষ তাদের আশাহতের কথা জানায়। জরিপে ৭৩ শতাংশ মানুষ মত দেয়, এক বছরে জনগণের জন্য কোনো ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি মুরসি। ৬৩ শতাংশ মনে করেন, মুরসির শাসনকালে তাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত কমে গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার পাশাপাশি কৌশলেও ভুল ছিল মুরসির। তিনি তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের কাছাকাছি ভাবাদর্শেই মিসরকে পরিচালনার চেষ্টা করছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের তিনি মূল্যায়ন করেননি। ফলে মুরসি ও তার দল রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। বিরোধীরা সরকারের ব্যর্থতাগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। জনগণের সামনে ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরে আন্দোলনের ডাক দেয় এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তারা সফলও হয়।

বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, ক্ষমতায় আসার পর সিসি’কে সেনাবাহিনী থেকে না সরিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করে অনেক বড় ভুল করেছিলেন মুরসি। এই ভুলের অনেক বড় খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। ধূর্ত সিসি সুযোগ পাওয়া মাত্রই মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তব্যে সিসি জানান, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় মিসরের প্রধান বিচারপতি আদিল আল-মনসুরকে।

মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরোধীরা উল্লাসে মেতে ওঠে এবং প্রতিবাদ জানাতে তার সমর্থকরাও রাস্তায় নেমে আসে। অনেক জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। মুরসি সমর্থকদের বিক্ষোভ দমনেও কঠোর মনোভাব দেখানোর পাশাপাশি মুরসি-সহ তার ঘনিষ্ঠ ১২ জন রাজনৈতিক সহযোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে গৃহবন্দি করে দেশটির সেনাবাহিনী।

জানা যায়, স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে যে জমায়েত হয়েছিল, মুরসিবিরোধী আন্দোলন তাকেও ছাড়িয়ে যায়। অনেকের মতে, মুবারকের সময় দেশটির মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে সৌহার্দ্য ছিল মুরসি ক্ষমতায় আসার পর তা নষ্ট হয়ে যায়।

সরকারবিরোধীরা অভিযোগ করে, তারা মুবারকের স্বৈরশাসন থেকে যেমন বাঁচতে চেয়েছিল, তেমনি চেয়েছিল স্বাধীনভাবে চলতে, ফিরতে, কথা বলতে, উঠতে-বসতে। কিন্তু মুরসি তাদের স্বাধীনতার স্বাদ দিতে ব্যর্থ হন। তার গোড়া এবং কট্টরপন্থি ভূমিকা নিরপেক্ষ মানুষদের হতাশ করেছিল।

তবে অনেকেই মনে করে মুরসির সরলতাই তার পতনের কারণ। তিনি রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় থাকা তার শত্রুদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গেলে অফিসাররা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। তিনজন অফিসার দুজনের মধ্যবর্তী ব্যক্তিকে মুরসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, ইনি ব্রিগেডিয়ার ইবরাহিম শারবিনী।

মুরসি মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাকে তো আমি আগে থেকেই চিনি; তিনিই তো আমাকে রাত ২টায় বাসা থেকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন। এবং তার সঙ্গে পাশের আপনারা দু’জনও সেদিন ছিলেন।’ একথা শুনে উপস্থিত সকলেই একযোগে হেসে ওঠেন। এই হাসির আড়ালেই চলছিল মুরসিকে সরিয়ে দেওয়ার খেলাটি। এই খেলাই একসময় তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে আর ২০১৪ সালের ৮ জুন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান সিসিকে নিয়ে আসে মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায়।