দেশের অন্যতম মৎস্য অভয়ারণ্য মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিলের সাথে মোটামোটি আমরা সবাই পরিচিত। বিশেষ করে শীত কালের (শুষ্ক মসুমের) বাইক্কা বিলের সাথে পরিচিতিটা একটু বেশি। কারন শীতে হাজার হাজার অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে এই বিলের চারপাশ। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিলের সুনাম দারুণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে।।
কিন্তু পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলের সাথে আমরা ক’জনাইবা পরিচিত। আমরা একদমই পরিচিত নই থৈথৈ করা পানির বাইক্কা বিলের সৌন্দর্যের সাথে। প্রায় একশ হেক্টর আয়োতনের এই সংরক্ষিত জলাশয়টি মৎস্যসম্পদে পরিপূর্ণ। এখানে নানাজাতের মাছের সাথে রয়েছে সাপ-ব্যাঙ আর জলজ উদ্ভিদের নিত্য বসবাস।
তবে পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলে যাওয়া খুব কষ্টের। রাস্তার দুর্ভোগ মনে রাখার মতো! সোজাসাপ্টা কথা বাইক্কা বিলের শ্রাবণধারার টলমল সৌন্দর্য দেখতে হলে ভ্রমণগ্লানিকে হিসেবে রাখতে হবে। বাইক্কা বিলের পানিঘেরা রূপকে প্রত্যক্ষ করতে হলে কিছুটা পথ পায়ে হেটেই যেতে হবে।
মাটির রাস্তা তাই কিছুটা বিড়ম্বনা পেয়েই যেতে হবে বাইক্কা বিলে। এই সময়ে বাইক্কা বিলে যাবার সড়কে কিছুটা কাঁদা মাটি থাকায় চলে না কোনো সিএনজি অটোরিক্সা, প্রাইভেট গাড়ি অথবা অন্য যানবাহন। এক্ষেত্রে নিজের ‘পা’-ই একমাত্র উপযোগি।
বাইক্কা বিলে পৌঁছে দেখবেন মাঠ-ঘাট-প্রান্তরের মতো বিলেও শুধুই পানির ছড়াছড়ি। নির্দিষ্ট সীমারেখা থেকে বর্ধিত হয় পানির উপস্থিতি। মাছগুলো ছুটাছুটি করতে করতে পানির উপর হঠাৎ মুখ উচিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে। জলজপাখিগুলো গলা ছাড়ে ডাক ছাড়ে। সঙ্গীর উদ্দেশ্যে।
ঝিমিয়ে পড়া হিজল-করচ গাছের পাতাগুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। ঢোলকলমি চোখ তুলে তাকায় আগত অতিথির দিকে। কাছে-দূরে ব্যাঙের অবিরাম ডাক। বিলের জলে পানকৌড়ি, ছোট সরালি আর পাতিহাঁসের ডুব দেয়ার দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলের চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর হিজল-করচের ডুবে যাওয়া বনটি যেন নতুন প্রাণ জেগেছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে।
হাইল হাওরে অবস্থিত সংরক্ষিত মৎস্য অভয়াশ্রম ‘বাইক্কা বিল’। ইউএসআইডি’র অর্থায়নে মাচ প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য ও পাখির অভয়াশ্রম। ২০০৩ সালের ১লা জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এই বিল শুধু মাছের জন্যই নয়, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।
অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত এ বিল এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। নয়নাভিরাম এই জলাভূমিতে রয়েছে হাজারও শাপলা পদ্মসহ নানান জলজ উদ্ভিদ।
বাইক্কা বিল ছাড়াও শ্রীমঙ্গলে যা যা দেখবেন:
প্রকৃতিই শ্রীমঙ্গলের প্রাণ। সবুজের নিসর্গে ভরা ৪৪টি চা বাগান, জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সমৃদ্ধ বনাঞ্চল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতালদের বৈচিত্র্যময় জীবনচিত্র, রামনগরের প্রসিদ্ধ মণিপুরী তাঁতশিল্প ও কাপড়, বৃটিশ চা ব্যবস্থাপকদের কবরস্থান ডিনস্টন সিমেট্রি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, ৫শ বছরের পুরানো নির্মাই শিববাড়ি, লেবু-পান-আনারস বাগানের প্রাকৃতিক রূপ প্রভৃতি।
কিভাবে আসবেন:
শ্রীমঙ্গলের সঙ্গে সারা দেশের রেল ও সড়কপথে রয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে তিনটি, চট্টগ্রাম থেকে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন আসে শ্রীমঙ্গল। ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল আসতে পারেন। ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ বা শ্যামলী বাসে করে শ্রীমঙ্গল আসতে পারবেন। এছাড়া মহাখালি থেকে এনা পরিবহন উত্তরা হয়ে শ্রীমঙ্গলে আসে। শহরে এসে অটোরিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, জিপ, শ্রাইভেটকার বা মাইক্রো ভাড়া করে আপনি দর্শনীয় স্থানে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন:
পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য এখানে বেশ কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টহাউস, কটেজ রয়েছে। নির্জন পরিবেশে পাহাড়ি টিলার ওপর নির্মিত টি-রিসোর্ট ও পাঁচ তারকা মানের গ্র্যান্ড সুলতান টি-রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের নজরকাড়া সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করে তোলবে। বিভিন্ন পাহাড়ি টিলার ওপর নির্মিত কটেজগুলোতে রাতযাপন করে পর্যটকরা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগ পাবেন।
কোথায় খাবেন:
শ্রীমঙ্গলে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। পরিষ্কার-পরিছন্ন ও একটু ভালোমানের খাবার খেতে হলে আপনাকে অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে যেতে হবে। সেখানে বাঙালি খাবারের সঙ্গে চাইনিজ খাবারও পাবেন। এছাড়া দামি খাবারের জন্যও শহরে অনেক রেস্টুরেন্ট চোখে পড়বে।