হাওর বার্তা ডেস্কঃ গায়ে নীল রঙের জামা, পরনে খাকি রঙের প্যান্ট, হাতে লাঠি, মাথায় ছাতি। এভাবেই গ্রামবাসীকে নিরাপত্তা দিতে পুলিশেরই একটি অংশ হিসেবে এলাকায় চলাচল করে গ্রাম পুলিশ। তবে গ্রাম পুলিশকে আগের মত মানেনা গ্রামবাসী। সুলতানি ও নবাবি আমলে গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামে গণ্যমান্য প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত পঞ্চায়েতের মাধ্যেমে চলতো সালিশ বিচার। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাসহ গ্রামের সকল খবর রাখা ও ট্যাক্স আদায় করাসহ পঞ্চায়েত কাজে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ দেয়া হয় চৌকিদার। মাথায় কালো পাগড়ি লণ্ঠন, বল্লম ও লাঠি হাতে পাহারা দিত চৌকিদার আর লাল পাগড়িতে তাদের দলনেতা দফাদার।
পঞ্চায়েতের কোন আইনগত ভিত্তি না থাকায় ইংরেজ শাসকরা পল্লী অঞ্চলে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত করতে ১৮৭০ সালে লর্ড মেয়ো গ্রাম চৌকিদার আইন পাস করেন। ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় স্থানীয় আইনে তিন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি চৌকিদারি গ্রাম পঞ্চায়েত চালু থাকে।
১৯১৯ সালে বঙ্গীয় পল্লী স্বায়ত্তশাসন আইন, চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ও ইউনিয়ন কমিটিগুলো বিলুপ্ত করে ১০ থেকে ১২ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় ইউনিয়ন বোর্ড। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর ইউনিয়ন বোর্ড ভেঙ্গে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করেন।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ইউনিয়ন কাউন্সিল ভেঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন এবং জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান মেম্বার নির্বাচনের বিধান করে আইন পাস হয়। চৌকিদাররা আগের মতো ইউনিয়ন পরিষদের অধীনেই থাকেন।
এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৩ সালে এক অধ্যাদেশে চৌকিদার ও দফাদারের নামকরণ করা হয় গ্রাম পুলিশ। তৎকালিন ছ’ আনা (বর্তমানে ৩৭ পয়সা) থেকে বেতন শুরু চাকরিজীবন। প্রতি ইউনিয়নে দফদারকে কমান্ডার করে ৯জন গ্রাম পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়। গ্রাম পুলিশের ক্ষমতা, কর্তব্য ও আইন নির্ধারণ করা হয়।
পাহারা, টহলদারি, অপরাধের সকল বিষয়ে অনুসন্ধান, অপরাধ দমন, অপরাধী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারে পুলিশকে সহযোগিতা দেয়া, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা, ইউনিয়নের খারাপ ও সন্দেহভাজন লোকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা, গ্রামে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিসহ এলাকার সার্বিক আইন শৃঙ্খলা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হয়।
স্বল্প বেতনের চাকরি ঠিক মত প্রতিমাসে বেতন ভাতা পায় না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যদের চোখরাঙানি দেখে দিন কাটে গ্রাম পুলিশের। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের গ্রাম-মহল্লায় বিশেষ দূত হিসেবে সক্ষমতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ারিশ সনদ বা জন্ম নিবন্ধনসহ সঠিক ও গোপন তথ্য রাখা। থানা পুলিশের ডাকে তারা সাড়া দেয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক পরিমন্ডলে পদচারণ।
অন্যান্যদের থেকে গ্রাম পুলিশদের জীবনমান একটু আলাদা। বর্তমানে তেমন মূল্যায়ন নেই গ্রাম পুলিশের। অবহেলিত জীবনে পথচলা বড়ই কষ্টের। ‘সরকারের একটি অংশ’ বললে দুঃখ পেলেও মনে খুশি নিয়ে কাজ করে তারা।
জানা যায়, বাইরেও গ্রাম পুলিশকে আরও খবরাখবর রাখতে হয়। যেমন দাঙ্গার শঙ্কা, গোপনে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা, কোন শিশুকে বাড়ি থেকে বের করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া, আগুন ধরিয়ে ক্ষতি করা, মানুষ ও পশুর মহামারি ও সংক্রমণ, ফসলের পোকার আক্রমণ হলে থানা ও ইউনিয়ন পরিষদকে জানানো।
কোন অপরাধীর সম্পত্তির ক্রোক পরওয়ানা জারি হলে ঢোল সহরতে সহযোগিতা করা। কোন ব্যক্তির কাছে চোরাই মাল থাকলে অথবা ওই মাল চোরাই সন্দেহের যথেষ্ট প্রমান থাকলে তাকে আটক করতে পারে গ্রাম পুলিশ। কেউ বৈধ হেফাজত থেকে পালিয়ে গেলে এবং সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে কেউ বাধা দিলে সেই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দেয়ার ক্ষমতাও আছে গ্রাম পুলিশের।
আজকের গ্রাম পুলিশ আরও উন্নত। পরিবর্তন এসেছে পোশাকে। পাগড়ির বদলে দেয়া হয়েছে টুপি। খাকি প্যান্টের সঙ্গে নীল রঙের শার্ট। বর্তমানে একজন ইউনিয়ন কমান্ডারের (দফাদার) মাসিক বেতন ৩ হাজার ৪শ’ টাকা ও প্রতিজন গ্রাম পুলিশের বেতন ৩ হাজার টাকা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) অনুমোদনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গ্রাম পুলিশের নিয়োগ দেয়া হয়। প্রত্যেক গ্রাম পুলিশকে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে থানায় হাজিরা দিতে হয়।
উপজেলার বয়রাগাদী ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ প্রধান (দফাদার) মো. সোলাইমান সাংবাদিককে বলেন, কাজের যে পরিধি সে তুলনায় বেতন সামান্য। খসড়া বিধিমালায় গ্রাম পুলিশদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মতো বেতন স্কেল, অবসরকালীন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ আছে।
বিধিমালা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক গঠিত পে-কমিশন গ্রাম পুলিশদের বেতনের স্কেল সুপারিশ করে। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এক সাপ্তাহে একবার হাজিরা বাবদ ৩০০ শত টাকা করে মাসে ১২শত থেকে ১৫শত টাকা ও ৩০০০ হাজার টাকা ভাতা পায় গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) আর গ্রাম পুলিশ প্রধান (দফাদার) ৩ হাজার ৪শত টাকা পায় যা খুব কষ্টে সংসার চালাতে হয়। খুব হিমশিম খেতে হয়। কি করবো? ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্ট করে চলতে হয়। আমাদের দিকে কেউ দৃষ্টি দেয়না। তবে বছরে খাকি প্যান্ট ও নীল শার্টসহ দুই সেট পোশাক পাই। সাথে রয়েছে টুপি, টর্চ লাইট, জুতা ও মোজা।
১০-১২ জন গ্রাম পুলিশ দুঃখ করে বলেন, আপনে কি সাংবাদিক। আমাদের দুঃখের বিষয়ে কিছু লেখেন। মানুষের বহু কিছু লেখেন। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা একটু তুলে ধরেন। আর চলতে পারিনা। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি। ৩০০০ হাজার টাকা ভাতা দিয়ে কি সংসার চলে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসফিকুন নাহার সাংবাদিককে বলেন, বিষয়টা আমি শুনেছি, সামনের মিটিংয়ে উর্ধতন কর্মমর্তাদের বিষয়টি জানাবো। গ্রাম পুলিশদের সুযোগ সুবিধা যাতে বৃদ্ধি পায়।