ঢাকা ১১:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের নির্ভয়া কবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:১৩:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯
  • ২৭৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নুসরাত বাঁচতে চেয়েছিলেন। যেমন-তেমনভাবে বেঁচে থাকা নয়, আত্মসম্মান নিয়ে, মানুষের মর্যাদা নিয়ে। আগুনে তাঁর সারা শরীর ঝলসে গেছে, তারপরও তিনি বাঁচতে চেয়েছেন। যখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল, মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করছে, তখন তিনি বাঁচতে চেয়েছেন তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে রয়ে গেল। জীবনের শ্বাস শেষবারের মতো বুকভরে নিয়ে বলেছিল, আমি বিচার চাই।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী মেয়েটিকে মরতে হলো কেন? এর জন্য দায়ী কে? অনেকেই বলবে যে সমাজে তাঁর বাস ছিল, এই মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। নুসরাতকে সে আশ্রয় দিতে পারেনি, ক্ষমতাবানদের নোংরা নখর থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু সমাজ কথাটা বড় বিমূর্ত, বড় অ্যাবস্ট্রাক্ট। এই বিমূর্ত ধারণা থেকে সরে এলেই প্রকৃত অপরাধীদের আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

অপরাধী সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, যিনি নুসরাতকে লাঞ্ছিত করেছিলেন, তাঁকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অপরাধী সেই মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী, যাঁরা জানতেন কী হয়েছে, কিন্তু মুখ বুজে ছিলেন। নুসরাতের ‘বন্ধুরা’, যাঁরা এই অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিল করেছেন, তাঁরাও অপরাধী। অপরাধী সেই মাদ্রাসার পরিচালনা বোর্ডের সব সদস্যরা, যাঁরা এই অধ্যক্ষের নোংরা অভ্যাসের কথা জেনেও মুখ বুজে ছিলেন। সবকিছু জানাজানি হলে মাদ্রাসার বদনাম হবে, আলেম সমাজের বদনাম হবে, এই যুক্তিতে পুরো ব্যাপার ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। এই বোর্ডের একজন সদস্য টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অধ্যক্ষের নামে কুৎসিত গালি দিয়ে বলেছেন, এমন কাজ তিনি আগেও করেছেন। যদি আপনারা সে কথা জানতেনই, তাহলে এমন লোককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেননি কেন? আপনি, আপনারা প্রত্যেকে সমান অপরাধী। অপরাধী স্থানীয় থানার কর্মকর্তা, যিনি নুসরাতের অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধী সেই থানার সব সদস্য, যাঁরা এই অভিযোগের কথা জেনেও সে কর্মকর্তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। দোষী স্থানীয় মাস্তান ও পরজীবী রাজনীতিবিদ, যারা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নুসরাতের পরিবারের ওপর চাপ দিয়েছিল।

এদের সবাইকে যদি আপনারা সমাজ বলতে চান, বলতে পারেন।

আমি বলেছি, নুসরাত আমাদের নির্ভয়া। ২০১২ সালে দিল্লির এক চলন্ত বাসে পাঁচ যুবকের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২১ বছরের এক ছাত্রী, যাঁকে আমরা নির্ভয়া নামে চিনি। নির্ভয়া, কারণ মৃত্যু যখন কড়া নাড়ছিল, মেয়েটি তখনো বলেছেন, ‘আমি বিচার চাই।’ মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ বিবৃতিতে মেয়েটি বলেছেন, ‘আমি চাই প্রতিটি অপরাধীর ফাঁসি হোক। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হোক, যেন এমন কাজ আর কখনো না করতে পারে। আমি সচেতনভাবেই এই বক্তব্য দিচ্ছি।’

নির্ভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার জন্য দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভারতীয় আদালত চূড়ান্ত সাজা দিয়েছেন-মৃত্যুদণ্ড। এই বিচারের রায়ে বলা হয়েছে, তাঁর হত্যার জন্য দায়ী যুবকদের কাছে মেয়েটি ছিলেন শুধুই মনোরঞ্জনের একটি উপকরণ। তাঁকে মানুষ হিসেবে বিবেচনার প্রয়োজনও তারা দেখেনি।

ফেনী মাদ্রাসার তিনি অধ্যক্ষ, তিনি মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি, থানার কর্মকর্তা, তাঁরাও নুসরাতকে শুধুই মনোরঞ্জনের উপকরণ ভেবেছেন। নুসরাত জানিয়ে যাননি, তাঁর মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের কী শাস্তি হওয়া উচিত। নুসরাত কেবল বিচার চেয়ে গেছেন। কিন্তু কে বিচার করবে এই অপরাধের? ঘটনাটির তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে, যে পুলিশের একজন তাঁর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, এ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

ঘটনাটি যে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে, তার একমাত্র কারণ নুসরাতের পরিবার। অভাবী, গ্রামীণ মানুষ, ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ শুনতেই তারা অভ্যস্ত। অথচ তারাই নুসরাতের পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশার ক্ষীণ প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। হুমকি এসেছে, আমি নিশ্চিত, উৎকোচের প্রলোভন এসেছে। তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। নুসরাত ছাড়া এই ঘটনার সাহসী যোদ্ধা হলেন তাঁর মা, ভাই, নিকট আত্মীয়রা।

আশার কথা, অপরাধীদের প্রায় সবাই ধরা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত যে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে, তার কারণ এই নয় যে বিবেকের তাড়না তাদের দংশন করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে প্রত্যেক অপরাধীকে চিহ্নিত করে বিচার করা হয়। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন জাগে, ওপরওয়ালার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের আইন ও বিচার বিভাগের টনক কেন নড়ে না? এমন ঘটনা এই প্রথম নয়, শেষও নয়। তাহলে কি শুধু প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করার পরেই যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের বিচার পাওয়া সম্ভব?

সত্যি কথাটা হলো, ধর্ষণ অথবা যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাকে আমরা এখনো মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে নিই না। সমাজের ওপরতলার মানুষ হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। নুসরাতের মতো নিম্নবর্গের মেয়েদের ভাগ্যে এমন অভিজ্ঞতা কার্যত দৈনন্দিন। ঢাকার গার্মেন্টসশিল্পে কাজ করেন যেসব মেয়ে, তাঁদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন, বাস্তব চিত্রটি পেয়ে যাবেন।

যৌন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনের কিন্তু অভাব নেই। ‘ইভ টিজিং’–এর মতো ঘটনার জন্যও আইন রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আইন হয়েছে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি কর্মস্থলে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি থাকতে হবে। হাতে গোনা দু-চারটি ক্ষেত্র ছাড়া এই আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। কারণ, ‘এ আর এমনকি ব্যাপার’। একটি হিসাবে দেখছি, যৌন নির্যাতনের ঘটনার মাত্র ২০ শতাংশ আদালত পর্যন্ত গড়ায়, আর বিচার হয় মাত্র ৬ শতাংশ। একটি মেয়ের কথা জানি, তাঁর মামলা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। মেয়েটি যতবার সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান, ততবার তাঁকে নতুন করে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। কিন্তু অপরাধের শাস্তি হয় না।

নির্ভয়ার মামলার রায় ঘোষণার পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নারী বিচারপতি বানুমাথি প্রশ্ন করেছিলেন, নারীর অধিকার প্রশ্নে যত আইন হয়েছে, সেগুলো কি শুধু কাগুজে বাঘ? রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে মেয়েরা যদি সুবিচার না পান, তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন?

নুসরাতের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই প্রশ্নের একটি উত্তর আমরা পাচ্ছি বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি নিজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, কিন্তু জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন প্রবল প্রতিবাদের আগুন। এখন এই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।

নির্ভয়ার বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘আজ রাতে আমার মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।’ আমাদের নির্ভয়া নুসরাত কবে তেমন ঘুমের সুযোগ পাবেন?

সূত্র: প্রথম আলো

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আমাদের নির্ভয়া কবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন

আপডেট টাইম : ০৫:১৩:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নুসরাত বাঁচতে চেয়েছিলেন। যেমন-তেমনভাবে বেঁচে থাকা নয়, আত্মসম্মান নিয়ে, মানুষের মর্যাদা নিয়ে। আগুনে তাঁর সারা শরীর ঝলসে গেছে, তারপরও তিনি বাঁচতে চেয়েছেন। যখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল, মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করছে, তখন তিনি বাঁচতে চেয়েছেন তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে রয়ে গেল। জীবনের শ্বাস শেষবারের মতো বুকভরে নিয়ে বলেছিল, আমি বিচার চাই।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী মেয়েটিকে মরতে হলো কেন? এর জন্য দায়ী কে? অনেকেই বলবে যে সমাজে তাঁর বাস ছিল, এই মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। নুসরাতকে সে আশ্রয় দিতে পারেনি, ক্ষমতাবানদের নোংরা নখর থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু সমাজ কথাটা বড় বিমূর্ত, বড় অ্যাবস্ট্রাক্ট। এই বিমূর্ত ধারণা থেকে সরে এলেই প্রকৃত অপরাধীদের আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

অপরাধী সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, যিনি নুসরাতকে লাঞ্ছিত করেছিলেন, তাঁকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অপরাধী সেই মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী, যাঁরা জানতেন কী হয়েছে, কিন্তু মুখ বুজে ছিলেন। নুসরাতের ‘বন্ধুরা’, যাঁরা এই অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিল করেছেন, তাঁরাও অপরাধী। অপরাধী সেই মাদ্রাসার পরিচালনা বোর্ডের সব সদস্যরা, যাঁরা এই অধ্যক্ষের নোংরা অভ্যাসের কথা জেনেও মুখ বুজে ছিলেন। সবকিছু জানাজানি হলে মাদ্রাসার বদনাম হবে, আলেম সমাজের বদনাম হবে, এই যুক্তিতে পুরো ব্যাপার ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। এই বোর্ডের একজন সদস্য টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অধ্যক্ষের নামে কুৎসিত গালি দিয়ে বলেছেন, এমন কাজ তিনি আগেও করেছেন। যদি আপনারা সে কথা জানতেনই, তাহলে এমন লোককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেননি কেন? আপনি, আপনারা প্রত্যেকে সমান অপরাধী। অপরাধী স্থানীয় থানার কর্মকর্তা, যিনি নুসরাতের অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধী সেই থানার সব সদস্য, যাঁরা এই অভিযোগের কথা জেনেও সে কর্মকর্তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। দোষী স্থানীয় মাস্তান ও পরজীবী রাজনীতিবিদ, যারা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নুসরাতের পরিবারের ওপর চাপ দিয়েছিল।

এদের সবাইকে যদি আপনারা সমাজ বলতে চান, বলতে পারেন।

আমি বলেছি, নুসরাত আমাদের নির্ভয়া। ২০১২ সালে দিল্লির এক চলন্ত বাসে পাঁচ যুবকের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২১ বছরের এক ছাত্রী, যাঁকে আমরা নির্ভয়া নামে চিনি। নির্ভয়া, কারণ মৃত্যু যখন কড়া নাড়ছিল, মেয়েটি তখনো বলেছেন, ‘আমি বিচার চাই।’ মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ বিবৃতিতে মেয়েটি বলেছেন, ‘আমি চাই প্রতিটি অপরাধীর ফাঁসি হোক। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হোক, যেন এমন কাজ আর কখনো না করতে পারে। আমি সচেতনভাবেই এই বক্তব্য দিচ্ছি।’

নির্ভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার জন্য দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভারতীয় আদালত চূড়ান্ত সাজা দিয়েছেন-মৃত্যুদণ্ড। এই বিচারের রায়ে বলা হয়েছে, তাঁর হত্যার জন্য দায়ী যুবকদের কাছে মেয়েটি ছিলেন শুধুই মনোরঞ্জনের একটি উপকরণ। তাঁকে মানুষ হিসেবে বিবেচনার প্রয়োজনও তারা দেখেনি।

ফেনী মাদ্রাসার তিনি অধ্যক্ষ, তিনি মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি, থানার কর্মকর্তা, তাঁরাও নুসরাতকে শুধুই মনোরঞ্জনের উপকরণ ভেবেছেন। নুসরাত জানিয়ে যাননি, তাঁর মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের কী শাস্তি হওয়া উচিত। নুসরাত কেবল বিচার চেয়ে গেছেন। কিন্তু কে বিচার করবে এই অপরাধের? ঘটনাটির তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে, যে পুলিশের একজন তাঁর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, এ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

ঘটনাটি যে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে, তার একমাত্র কারণ নুসরাতের পরিবার। অভাবী, গ্রামীণ মানুষ, ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ শুনতেই তারা অভ্যস্ত। অথচ তারাই নুসরাতের পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশার ক্ষীণ প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। হুমকি এসেছে, আমি নিশ্চিত, উৎকোচের প্রলোভন এসেছে। তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। নুসরাত ছাড়া এই ঘটনার সাহসী যোদ্ধা হলেন তাঁর মা, ভাই, নিকট আত্মীয়রা।

আশার কথা, অপরাধীদের প্রায় সবাই ধরা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত যে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে, তার কারণ এই নয় যে বিবেকের তাড়না তাদের দংশন করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে প্রত্যেক অপরাধীকে চিহ্নিত করে বিচার করা হয়। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন জাগে, ওপরওয়ালার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের আইন ও বিচার বিভাগের টনক কেন নড়ে না? এমন ঘটনা এই প্রথম নয়, শেষও নয়। তাহলে কি শুধু প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করার পরেই যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের বিচার পাওয়া সম্ভব?

সত্যি কথাটা হলো, ধর্ষণ অথবা যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাকে আমরা এখনো মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে নিই না। সমাজের ওপরতলার মানুষ হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। নুসরাতের মতো নিম্নবর্গের মেয়েদের ভাগ্যে এমন অভিজ্ঞতা কার্যত দৈনন্দিন। ঢাকার গার্মেন্টসশিল্পে কাজ করেন যেসব মেয়ে, তাঁদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন, বাস্তব চিত্রটি পেয়ে যাবেন।

যৌন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনের কিন্তু অভাব নেই। ‘ইভ টিজিং’–এর মতো ঘটনার জন্যও আইন রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আইন হয়েছে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি কর্মস্থলে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি থাকতে হবে। হাতে গোনা দু-চারটি ক্ষেত্র ছাড়া এই আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। কারণ, ‘এ আর এমনকি ব্যাপার’। একটি হিসাবে দেখছি, যৌন নির্যাতনের ঘটনার মাত্র ২০ শতাংশ আদালত পর্যন্ত গড়ায়, আর বিচার হয় মাত্র ৬ শতাংশ। একটি মেয়ের কথা জানি, তাঁর মামলা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। মেয়েটি যতবার সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান, ততবার তাঁকে নতুন করে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। কিন্তু অপরাধের শাস্তি হয় না।

নির্ভয়ার মামলার রায় ঘোষণার পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নারী বিচারপতি বানুমাথি প্রশ্ন করেছিলেন, নারীর অধিকার প্রশ্নে যত আইন হয়েছে, সেগুলো কি শুধু কাগুজে বাঘ? রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে মেয়েরা যদি সুবিচার না পান, তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন?

নুসরাতের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই প্রশ্নের একটি উত্তর আমরা পাচ্ছি বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি নিজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, কিন্তু জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন প্রবল প্রতিবাদের আগুন। এখন এই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।

নির্ভয়ার বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘আজ রাতে আমার মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।’ আমাদের নির্ভয়া নুসরাত কবে তেমন ঘুমের সুযোগ পাবেন?

সূত্র: প্রথম আলো