বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হিমায়িত চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আশির দশকের লাভজনক এ খাতটি আজ লোকসানি শিল্পে রূপ নিয়েছে। রপ্তানির জন্যে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ৭৮টির কারখানার মধ্যে ইতিমধ্যে ৫০টি বন্ধ হয়ে গেছে। চালু আছে মাত্র ২৮টি কারখানা।
এরমধ্যে খুলনাঞ্চলের ৫৮টির মধ্যে ২৪টি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টির মধ্যে মাত্র ৪টি কারখানা চালু আছে। আন্তর্জাতিক বাজারের তেজীভাব কমে যাওয়ায় দেশের বাগদা চিংড়ির রপ্তানি কমে গেছে। তুলনামূলকভাবে কম দামে ক্রেতারা অন্য চিংড়ি কিনতে পেরে বেশী দামের বাগদা চিংড়ি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ। এতে কারখানা মালিকগুলো বিপাকে পড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান মতে, ২০০১ সাল থেকে মাছ রপ্তানি বাড়তে থাকে। ধাক্কা খায় ২০০৮-০৯ অর্থ-বছরে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কিছুটা কাটিয়ে ওঠায় ২০১০-১১ অর্থ বছরে ঘুরে দাঁড়ায় দেশের চিংড়ি শিল্প। এই সময়ে আমাদের চিংড়িতে নানা অপদ্রব্য প্রবেশের কথা ওঠে। আলোচনায় আসে পুশ প্রথা।
খুলনা মহানগরীর পশ্চিম রূপসার নতুন বাজার এবং পূর্ব রূপসা এলাকার কিছু মাছ ব্যবসায়ী পানি ও জেলি পুশ করে মাছের ওজন বাড়িয়ে তা’ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করায় বিশ্ব বাজারে চিংড়ি শিল্প প্রশ্নের মুখে পড়ে।
পুশের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর মনোভাব দেখালেও মাঠ পর্যায়ে এই কু-অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে না। কারও কারও মতে, কোম্পানির রিসিভ ইনচার্জগণের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণেই এই কু-প্রথার অবসান ঘটছে না। এরা গ্রহীতাকে মাছের ওজনের বেশী দেখানোর মাধ্যমে সুবিধা নিয়ে থাকে। অবশ্য, কোম্পানির মালিকেরা এটি অবাস্তব বলে মনে করেন।
তাদের মতে, চিংড়ি রিসিভের সময় তাতে পুশ দেয়া কি না তা’ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। ডিপো মালিকরা বেশী লাভের আশায় চিংড়িতে পুশ দেয়। ওইস্তরেই এটি রোধ করতে হবে। এজন্যে মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের আরও সক্রিয় ভূমিকা জরুরি।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেন, মূলত: কোম্পানিগুলোর কমিশন এজেন্টের (চিংড়ি সংগ্রহের মধ্যস্বত্ত্বভোগী) কারণেই মাছের বাজার নষ্ট হচ্ছে। কমিশন এজেন্ট প্রথা বাতিল করা হলে উৎপাদকরাও উপকৃত হবে। সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে কোম্পানীগুলো মাছ কিনলে বৈদেশিক বাজার হারাতে হবে না বলে তিনি দাবি করেন। বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও চিংড়ি শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশাবাদী।
তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া-কমার বিষয়টি সাময়িক। সঠিক তদারকির মাধ্যমে আমরা মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বিশ্ববাজারে আবারও আমরা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস্ এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)-র পরিচালক এস. হুমায়ন কবীর বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র ১৫/২০ বছরের মধ্যে চিংড়ি শিল্প লাভজনক খাত হিসেবে পরিচিতি পায়। একারণে ওই সময়ে প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে। এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৮টিতে। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টে যেতে থাকে। মাত্র তিন বছর আগেও চিংড়ি শিল্প ছিল দেশের দ্বিতীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। যা অবস্থার অবনমন ঘটেছে।
তিনি জানান, বর্তমানে খুলনায় যে ২৪টি এবং চট্টগ্রামে ৪টি মাছ কোম্পানি চালু আছে, অদূর ভবিষ্যতে সেগুলোও টিকে থাকবে কি-না, তা-নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় বাজার ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে সময়োপযোগী নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।