সিলেটের হাওরাঞ্চলে খাল-বিলে নেমেই শিকারিদের কবলে পড়ছে শীতপ্রবণ সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসা অতিথি পাখি। সাইবেরিয়া অঞ্চলে তামমাত্রা দ্রুত কমতে থাকায় এখন প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক অতিথি পাখি সেই এলাকা ছাড়ছে। এদের একটি অংশ একটু উঞ্চতার খোঁজে নামছে বাংলাদেশের হাওর-বাওর জলাশয়ে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে এসব অতিথি পাখি শুরুতেই পেশাদার শিকারিদের কবলে পড়ছে। সিলেটের হরিপুর, ঘিলাছড়া, মাইজগাঁওসহ বিভিন্ন বাজারে ইতিমধ্যে অতিথি পাখি প্রকাশ্যে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
শনিবার সকাল আনুমানিক ১০টায় সিলেটের জাফলং থেকে আসার পথে জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে প্রকাশ্যে অতিথি পাখি বিক্রি করতে দেখা যায়। এ সময় পরিচয়ন গোপন রেখে এই প্রতিবেদক ছবি তুলতে গেলে চতুর পাখি শিকারী কৌশলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায়। পাখি শিকারি এ সময় দুটি পাখির দাম হাঁকে ৪০০ টাকা।
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ (ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার প্রটেকশন) বিভাগের ডিএফও (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) মো. সাঈদ আলী মৌসুমের শুরুতে অতিথি পাখি শিকারিদের কবলে পড়ার কথা স্বীকার করে’ ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম’কে বলেন, আমরা এ বিষয়ে লোকজনকে মোটিভেটেড করার চেষ্টা করছি। এছাড়া হাওরে আসা অতিথি পাখিরা যাতে শিকারিদের কবলে না পড়ে সে বিষয়ে আমাদের ওয়াচাররা কাজ করছে। ইতিমধ্যে আমরা কুলাউড়া ও নবীগঞ্জ থেকে ৪২টি পাখি শিকারিদের কবল থেকে উদ্ধার করে হাওরে অবমুক্ত করেছি।
দ্য সাইবেরিয়ান টাইমসের তথ্যমতে সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল পৌনে ১০টায় সেই অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (নরলিস্ক এলাকা)। অথচ রবিবারও একই এলাকার তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৬ ডিগ্রি। শীতের তাড়া খেয়ে একটু উঞ্চতার খোঁজে এসব পরিযায়ী পাখি প্রথমে উপকূলীয় এলাকায় নামলেও এখন দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরসহ সিলেট অঞ্চলের হাওর-বাওরে এখন পাখির দেখা মিলছে।
দেশের খ্যাতিমান পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, অতিথি পাখি আসার আন্তর্জাতিক দুটি রুটে পড়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। ভারত হয়ে সেন্টাল এশিয়ান রুট এবং চীন হয়ে অস্ট্রেলেশিয়া রুট। এই দুটি রুটে বাংলাদেশর অবস্থান হওয়ায় প্রতি বছর শীতের তাড়া খেয়ে সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে লাখ লাখ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে। বিশেষ করে তীব্র শীতের দেশ থেকে একটু উঞ্চতার খোঁজে এসব পাখি হাজার হাজার মাইল পথ দিয়ে আসে বাংলাদেশের বিভিন্ন দ্বীপ ও হাওরে অবস্থান নেয়। তাদের মতে উপকূলীয় এলাকায় আগস্ট মাসে এবং সিলেটের হাওরাঞ্চলে অক্টোরের মাঝামাঝি শুরু হয় পাখি আসার মৌসুম।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকেই হাকালুকি, কাউয়াদিঘী, হ্ইল হাওরসহ এদেশের হাওর-বাওরে অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যায়। আর এরপর থেকেই শুরু হয়েছে এসব পাখি শিকারে পেশাদার শিকারিদের তৎপরতা।
পাখি বিশেষজ্ঞ বশির আহমদ হাকালুকি হাওরে ওয়াইল্ড লাইফ সেক্টরে কাজ করেছেন ৯ বছর ধরে। তিনি ঢাকাটাইমসকে জানান ’এই ৯ বছরই হাকালুকি হাওরে অক্টোবরের মাঝামাঝি পাখি আসতে দেখি। তবে এ বছর সম্ভবত মৌসুম আগেই শুরু হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, গত সেপ্টেম্বর মাসে মহেশখালীতে কাঁদাখোচা গ্রুপের ৪-৫ প্রজাতির পাখি তিনি নিজে দেখেছেন।
সেন্টার ফর ন্যাচারেল রিসোর্স স্টাডিস (সিএনআরএস) ’র সিআরইএল (ক্লাইমেট রেজিলিয়ন ইকো সিস্টেম লাইভহোড) নামক একটি প্রকল্প চলছে। ইউএস এইড-এর অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের সাইট অফিসার তৌহিদুর রহমান। তিনি জানান, হাকালুকি হাওরে অতিথি পাখির মধ্যে বর্তমানে গাংচিল জাতীয় পাখি দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য পাখিও আসার সময় হয়ে গেছে। এসব পাখি যাতে শিকারীরা ধরতে না পারে সে জন্য আমরা আমাদের বিসিজি টিমগুলোকে সতর্ক রেখেছি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের চেয়ারম্যান ও দেশের খ্যাতিমান পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক জানান, উপূলীয় এলাকার বিভিন্ন দ্বীপে আমাদের পাখি গণনার কাজ শুরু হয়ে গেছে। গত শুক্রবার আমাদের একটি দল পাখি গণনার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে রওয়ানা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মহেশখালী, কুদুবদিয়া, সেন্টমার্টিনে ইতিমধ্যে অন্তত ২০ প্রজাতির জলচর পাখি এসেছে। তিনি শিকারীরা যাতে এসব পাখি ধরতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তর তথা প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপের অনুরোধ জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. সালাউদ্দিন জানান, অতিথি পাখি শিকারের বিষয়টি দেখতে বন বিভগের সংশ্লিষ্ট বিভাগতে বলা হয়েছে।