হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জ-৪ আসন (মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম) বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এই আসন থেকে টানা সাতবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এ কারণেই এ আসনে সারা দেশের মানুষ বাড়তি আগ্রহ নিয়ে নির্বাচনের ফলাফলের অপেক্ষায় থাকেন। এ আসনটি মূলত কৃষি নির্ভর এলাকা। কৃষি কাজই এ অঞ্চলে প্রধান পেশা। শতকরা ৮০ভাগ লোক কৃষি পেশায় নিয়োজিত। হাওর এলাকা হওয়ায় এ এলাকায় প্রায়শই অকাল বন্যায় ফসলসহ গবাদি পশু ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ভাটি এলাকা হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটা পিছিয়ে। যে প্রার্থী তাদের এসব দুর্ভোগে মাথার ছায়া হয়ে পাশে থাকবেন সেটাই প্রত্যাশা এ অঞ্চলের মানুষের।
তাই আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে চলছে ভোটের হিসাব নিকাশ। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে? কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে ঘুরবে তাদের ভাগ্যের চাকা এ নিয়ে চলেছে আলোচনা। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে নির্বাচনী প্রচারনা চালাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীগণ। ইতিমধ্যে তারা মাঠে-ঘাটে প্রচার প্রচারণা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করছেন।
শত দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও হাওরের রাজনীতির চাকা অনেকটা সচল রয়েছে। হাওরে এই তিন উপজেলাতেই আওয়ামী লীগে কিছুটা, বিএনপিতে প্রচন্ড কোন্দল রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনতা। এসব কোন্দল মেটাতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। এসব কোন্দলের কারণ হিসেবে বিগত উপজেলা ও ইউনিয়ন নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী মনোয়ন দেয়াকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তবে জাতীয় একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগে কোন্দলের প্রভাব পরবে না বলে জানিয়েছেন সরকার দলীয় স্থানীয় তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ।
স্থানীয় জনগণের অনেকই জানান, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আসন বিধায় তাঁর হস্তক্ষেপে কোন্দল মেটানো কোনো বিষয় হবে না। কারণ ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জয়লাভ করেন। টানা রাজনৈতিক জীবনে তিনি ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার ও সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব মোঃ জিল্লুর রহমানের প্রয়ানের পর আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পেলে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনটি শূন্য হয়।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত উপ-নিবার্চনে রাষ্ট্রপতি তনয় প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে বিএনপির কোন প্রার্থী না থাকায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মহিতুল ইসলাম অসীমকে পরাজিত করে তৌফিক এমপি হন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নিবার্চনে অন্য কোনো দলের প্রার্থী অংশগ্রহণ না করায় তিনি পুনঃরায় এমপি নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর হাওরের তিনটি উপজেলায় ব্যপক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এসব কাজের মধ্যে হাওরের বিভিন্ন সড়ক, ব্রীজ, কালভার্ড, তিন উপজেলা সংযোগ সড়ক, প্রশাসনিক ভবনসহ উল্লেখযোগ্য অনেক দৃশ্যমান কাজ শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের নাম বেশ আলোচিত হচ্ছে। তিনি ইতিমধ্যে তিনটি উপজেলার মানুষের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্রপতি পুত্র হওয়া সত্বেও তিনি বঙ্গভবনের মতো জায়গা ছেড়ে বছরের প্রায় সময়ই নিজ আসনে পড়ে থাকেন বলে স্থানীয় জনগণ জানান। তাই সঙ্গত কারণেই এমপি তৌফিক আওয়ামী লীগের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন।
(মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রাম) উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, গত দুই বছরে রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক এলাকায় পাঁচ শতাধিক জনসভা, কর্মিসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগদান করেছেন। গত বছর হাওরে অকাল বন্যায় ফসল হানির ঘটনায় এমপি তৌফিকের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কৃষকদের মাঝে সার, বীজ, নগদ অর্থ বিতরণসহ, ঋণ মওকুফের মতো কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। হাওরের এই সংসদীয় আসনের এমন কোনো জায়গা বাদ নেই যেখোনে তিনি যান নি।
নির্বাচনের হালচাল নিয়ে ইটনা উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খলিলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমাদের অবস্থা অনেক ভালো। আমরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো ইনশাল্লাহ। এমপি তৌফিক উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করে যাচ্ছেন, মানুষের সুখে দুঃখে পাশে থাকেন। এ কারণেই মানুষ এমপি তৌফিককে পুনরায় এমপি হিসেবে চান।
মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক সমীর কুমার বৈষ্ণব জানান, আমাদের নির্বাচনী মাঠের অবস্থা গোছালো। নির্বাচনী হাওয়া নৌকার অনুকূলে আছে। মাঠ পর্যায়ে সকল কার্যক্রম চলছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম জনগণের কাছে পৌছাতে পেরেছি এবং দৃশ্যমান প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। জনগণ আমাদের পাশে আছে। এমপি মহোদয় এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে, উপজেলায় কাজ করে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এমপি তৌফিকই এগিয়ে রয়েছেন।
অষ্টগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম জেমস জানান, এমপি তৌফিক এলাকার জন্য নিবেদিত। তিনি একদিনের জন্যও এলাকা ছাড়তে চান না। দেশে তার মতো জনবান্ধব এমপি দ্বিতীয়টি নেই বলে তিনি মনে করেন। প্রতিদিনই কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করে তিনি সবার দোয়া চান। এভাবেই তার নির্বাচনী প্রচার প্রায় শেষ পর্যায়ে।
অপরদিকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ করে তাহলে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের নাম শোনা যাচ্ছে স্থানীয় বিএনপি সমর্থিত নেতা কর্মীদের মুখে। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ও অনল বর্ষী বক্তা খ্যাত ফজলুর রহমান আবদুল হামিদের চির প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে পরিচিত। ফজলুর রহমানের বাড়ি ইটনা উপজেলায়।
জানা যায়, এ্যাডভোকেট মো. ফজলুর রহমান এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে দল ত্যাগ করেন। মো. ফজলুর রহমান ১৯৮৬ সালের নিবার্চনে আওয়ামী লীগের টিকিটে কিশোরগঞ্জ-১ (তৎকালীন সদর উপজেলা) আসন থেকে এমপি হন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগে টিকতে না পেরে পরে তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে যোগ দেন ও দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে এ দল থেকে নিবার্চন করেও তিনি তৎকালীন এমপি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে নির্বাচনে পেরে উঠতে পারেন নি। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ছেড়ে পরবর্তীতে তিনি বিএনপিতে চলে যান। পরে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সবের্শষ বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মনোনীত হন। তাই এবারও এ আসনে তারই বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে তার অনুসারিরা মনে করেন। ফজলুর রহমান ছাড়াও এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান বিএনপির নেতা সৈয়দ মহিতুল ইসলাম অসীম, সাবেক এমপি ফরহাদ আহাম্মদ কাঞ্চনের ছেলে ড্যাব নেতা ডা. ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী লাকী। তারা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা ও এলাকার দলীয় কর্মী-সমথর্কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা যায়।
কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি তৌফিকের প্রতিদ্বন্ধী সৈয়দ অসীম স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও তিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেন। ফজলুর রহমান বিরোধী বিএনপি সমর্থিত অন্যান্য নেতা কর্মীদের সাথে আলাপ করলে তারা জানায় বিএনপি থেকে সৈয়দ অসীম মনোয়ন প্রত্যাশা করছেন। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তিনিই হবেন বিএনপির প্রার্থী।
(মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রাম) তিনটি উপজেলাতেই বিএনপিতে বিরোধ রয়েছে। যে কারণে এখানে দলের সাংগঠনিক দুবর্লতা প্রবল। এই কোন্দল আগামী নির্বাচনে বিএনপিতে প্রভাব ফেলবে বলে স্থানীয় বিএনপি সমর্থিত একাধিক নেতা কর্মীরা জানান। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতা-কর্মীগণ মনে করেন এ আসনে আবদুল হামিদের কোনো বিকল্প নেই। তার অবতর্মানে আর কাউকে তার সমকক্ষ ভাবা হয়নি। আবদুল হামিদের মতো নন্দিত আর কাউকে মানতে নারাজ সরকার দলীয় নেতা কর্মীগণ।
হাওরের নিবার্চনী রাজনীতির চালচিত্র নিয়ে এ আসনের সরকার দলীয় এমপি ও রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক সাংবাদিকদের জানান, হাওরের ব্যাপক উন্নয়নে তার পিতা রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের গৃহীত কাযর্ক্রমকে তিনি অব্যাহত রেখেছেন। হাওরের জনগণকে সাথে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তার বাবার রাজনৈতিক শিক্ষা কখনোই ব্যর্থ হবে না। তার বিশ্বাস, হাওরবাসী নিশ্চয়ই তাকে মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, বড় দলে কিছু সমস্যা থাকবেই। তবে কেন্দ্রের চূড়ান্ত ঘোষণার পর সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই নৌকার পক্ষে কাজ করবে।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এ্যাডভোকেট মো. ফজলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ কর হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমি নির্বাচন নিয়ে এই মুহুর্তে কোনো বক্তব্য দেবো না। আমাদের নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রস্তুতি নাই। জাতীয় ভাবে ৭ দফা দাবি পেশ করেছি। এ দাবি না মানা পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার প্রচারনায় বিএনপি আসবে না।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী সৈয়দ মহিতুল ইসলাম অসীম সাংবাদিকদের বলেন, আগে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা ভাবছি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপর নির্ভর করবে নির্বাচন করবো কি না। ৭ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত প্রচার প্রচারনা আপাতত বন্ধ। তবে পরোক্ষভাবে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। আমি আশাবাদী বিএনপি থেকে আমাকে মনোনয়ন দেয়া হবে। এমপি তৌফিককে কেমন ভাবছেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে উনাকে নিয়ে ভাববো। তবে ব্যক্তি হিসেবে উনি ভদ্র ও সজ্জন ব্যক্তি।
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ডা. ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী লাকী সাংবাদিকদের জানান, বিএনপি থেকে ফজলুর রহমান প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আমার পিতা বিএনপির সাবেক এমপি ফরহাদ আহাম্মদ কাঞ্চনই একমাত্র আবদুল হামিদকে পরাজিত করেছিলেন। নির্বাচন ছেলে খেলা নয়। নির্বাচন করতে গেলে দরকার জনগণের জোয়ার, অর্থ, শক্তি। এ তিনটিই আমার আছে। প্রচার প্রচারনায় এলাকায় ঘুরছি, মনোনয়ন নিয়েই মাঠে মানবো। তরুন প্রজন্মকে প্রাধ্যান্য দিলে অবশ্যই আমি মনোনয়ন পাবো।
সব কিছু মিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে এ আসনে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকই বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। সব ঠিক থাকলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই আশা করছেন এ এলাকার সাধারণ ভোটাররা। যে প্রার্থীই নির্বাচিত হোক না কেন হাওর উন্নয়নে নজর দিবেন সেটাই প্রত্যাশা হাওরবাসীর।