ঢাকা ০৮:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওর উৎসব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:১৮:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫
  • ৪৮৫ বার

‘কে যাস রে ভাটির গাং বাইয়া,আমার ভাইজানরে কইয়ো নাইওর নিত আইয়া’
গ্রামের ঘাটের হিজল গাছের গুঁড়িতে থুতনি ছুঁইয়ে কোনো গেরস্থ নয়াবউ মনে মনে গেয়ে চলেন। হওরের এই গান আর নতুন বৌ এর জীবন মিলেমিশে একাকার। তাহেরপুরে আছে বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের বুকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সারি সারি নৌকা। হঠাৎ ঠাওরে আসবে লম্বা লম্বা নৌকা। বর্ষা মৌসুমে কিছু দিন হাওরে জাল দিয়ে মাছ মারা নিষিদ্ধ। তাহেরপুর থেকে পসরা নিয়ে বাড়ি ফিরছে কোনো নৌকা। কোনো নৌকা আবার তাহেরপুর পানে ধেয়ে আসছে। নৌকাগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য কিন্তু চোখে পড়ার মতো। ঢাকার রিকশা সাজ-সজ্জাকরণের মতো করে সাদা রঙের ওপর লাল, নীল রঙের নকশা আঁকা। যার সঙ্গে সুশান্ত পালের শখের হাঁড়ির নকশার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। টাঙ্গুয়া হাওরে চলছে নৌকাবাইচ। সেই মৌলভীবাজার থেকে বাইচের নৌকা এসেছে বাইচ খেলতে। বাইচ নৌকার দুই পাশে সারি সারি বাইচাল পেছনে হাল ধরে একজন আর নৌকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মন্দিরা বাজিয়ে তাল দিচ্ছেন একজন, সেই তালে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে বাইচালরা_ হেই য়ো হে-হেই য়ো হে…। থেকে থেকে ছারা ছারা বাড়ি। মাইকে চটুল গান বাজিয়ে বউ নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে কোনো বরযাত্রী। বিচিত্র জীবনাচার হাওরের। কত জ্ঞানী-গুণী জন্ম নিয়েছেন এই সুনামগঞ্জে। এই জনপদে জন্ম নিয়েছেন রাধারমণ, দূরবীন শাহ, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মহসিন রেজা চৌধুরী, মনিরুজ্জামান মনির, নির্মুলেন্দু চৌধুরী, আবদুল হাই, ব্রহ্মানন্দ দাস, লালানিরেন্দু দে, বিপিন পাল, ক্ষিরোদ শর্মা, তরণী কান্ত দে, ছাদির উদ্দিন আহমদ, শাহ আবু তাহের ছাড়াও অনেক কীর্তিমান পুরুষ। শাহ আবদুল করিমের ভবতরীর হাহাকার_
কোন মিস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়।
ঝিলমিল, ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।
হাওর মানে পানি। আর পানির বাহন নৌকা। হাওর আর নৌকা একে অন্যের পরিপূরক। পানিবন্দি এই বিশাল সুনামগঞ্জ অঞ্চলের বর্ষার রূপ একেবারেই ভিন্ন। ছবির মতো ছাড়িয়ে যেতে থাকে গাছের সারি, পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, পালকির মতো কোনো ডিঙা আর হাওরের বুকে ভেসে থাকা নৌকার মতো ছোট ছোট গ্রাম।
নদী-খাল ভূমি থেকে আলাদা করার কোনো উপায় নাই। বর্ষা নদী সমতল সব একাকার করে দিয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি, নদী বা সমুদ্রের মতো নয়, মুক্ত অবারিত এক সৌন্দর্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি, মাছ ধরা, কিচির-মিচির, পানকৌড়ির কাকচক্ষু হাওরের জলে ডিঙির মতো ভেসে থাকা। টলটলে স্বচ্ছ পানিতে মাছের দৌড়ঝাঁপ, সাজানো শ্যাওলা যেন সাগর তলার বাগান। রাশি রাশি পানি মারিয়ে সারি সারি হিজল বন। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সারি সারি নৌকা।
সুনামগঞ্জ শহরে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে হাসন রাজার বাড়ি। ভাবলে কেমন লাগে এই বাড়িতেই হাসন রাজা জন্মেছেন ১৮৫৪ সালে। এখানে বসে রচনা করেছেন অসামান্য সব গান। বাড়ির দাওয়া, বারান্দা ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এই বুঝি দেখা হয়ে গেল লম্বা কুর্তা পরা সাধকজাত কবিয়াল জগৎপাগল রাজার সঙ্গে। জাদুঘরে পরিবর্তিত রাজার বাড়িতে আছে কলকাতার একটি স্টুডিও থেকে সংগ্রহ করা ১৯৬২ সালে তোলা কবির একটি ছবি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা আরও কিছু ছবি। জাদুঘরটিকে জীবন্ত করে রেখেছে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত নানা জিনিসপত্র। ভবপাগল হাসন রাজা হাওর-বাঁওড়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই মানুষটি মা হুরমত জাহান বিবির কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত। হাসনকে এখানে কবর দেওয়ার ব্যাপারটি তার ইচ্ছাতেই হয়েছে বলে শোনা যায়। হাসন রাজা সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে_ হাসন রাজার শেষ বয়সে আসাম থেকে একজন লোক এসেছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। লোকটি এসে হাসন রাজাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসন রাজার বাড়ি কোথায়?’ তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমিই হাসন রাজা।’ হাত তুলে মায়ের কবরটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে হাসন রাজার বাড়ি।’ নিজের দেখানো সেই বাড়িতেই শান্তিতে ঘুমায় কবি। চাইলে দু’দণ্ড দাঁড়াতে পারেন কবির সম্মানে।
সুন্দর সাজানো গোছানো শহর সুনামগঞ্জ। পরিষ্কার পরিপাটি ছিমছাম শহর। প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী লাউড়ের তীরে অবস্থিত সুনামগঞ্জের সীমান্ত নদী যাদুকাটাকে বলা হয় রূপের নদী। সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় এর সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ে যেন। সন্ধ্যাকালে মনে হবে এ যেন কাশ্মীরের ঝিলম নদী। যাদুকাটার উৎপত্তি স্থলে আছে টিলার মতো ঘন সবুজের পাহাড়, নাম বারেকের টিলা। স্থানীয়রা একে ‘আইফেল টাওয়ার’ বলে ডাকে।
জল টলমল এই নদীর তলদেশ চিক চিক করে বালুর দানা আর নুড়িপাথর। বছরের নির্দিষ্ট দিনে এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো মেলা ‘বারুণি’। এই সময় সনাতন ধর্মের লোকজন তীর্থরূপী যাদুকাটায় স্নান করার আশায় এসে জড়ো হন নদীতীরের অদ্বৈত মহাপ্রভু চৈতন্যের নবগ্রামে। তা ছাড়াও বছরের বারো মাস এখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা লক্ষণীয়। খাসিয়া পাহাড় থেকে যাদুকাটা নদীর উৎপত্তি। আরেকটি ছোট সীমান্ত নদী ‘রক্তি’ হয়ে এসে মিশেছে সুরমা নদীতে। বারো মাসই নদীটি থেকে বারকি শ্রমিকরা বালু ও পাথর আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
নদীটির আদি নাম রেণুকা।
প্রচলিত আছে, নদী তীরবর্তী কোনো গ্রামের এক বধূ মাছ মনে করে একদা নিজের পুত্রকে কেটে ফেলেছিলেন। যার নাম ছিল যাদু। তখন থেকেই এর নাম হয় যাদুকাটা। বহু জনশ্রুতি ও মিথের পর নদীটির বর্তমান নাম যাদুকাটা। হিন্দু ধর্মমতে, শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর মায়ের ইচ্ছানুসারে এই নদীতে বছরের নির্দিষ্ট দিনে পৃথিবীর সপ্তবারির জল একত্রিত হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মীদের বিশ্বাস, এখানে দোল পূর্ণিমার রাতে সপ্তবারির জল একত্রিত হয়। আর এ কারণেই সারাদেশের পুণ্যার্থীরা এখানে এসে বছরের নির্দিষ্ট দিনে মিলিত হয় স্নানের আশায়।
হাওরের অনুপম প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণ এবং তার সুপরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যটনসহ আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি করে হাওর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মূলত প্রতি বছর পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা এ আয়োজন করে। এ বছর তিন দিনব্যাপী পঞ্চম জাতীয় হাওর উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আয়োজকরা জানান, এবারের আয়োজন হবে আরও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। ১০, ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই উৎসবে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানগুলো অংশ নেবেন মাননীয় মন্ত্রী ও সাংসদবর্গ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের জাতীয় পর্যায়ের জননন্দিত ব্যক্তিরা।
একেক বছর হাওর অধ্যুষিত একেক জেলায় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ বছর উৎসবের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। প্রথম হাওর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওর তীরে। দ্বিতীয়টি হয়েছিল সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জে শৈলচাপরা হাওরের তীরে, তৃতীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় হাওর জনপদের কেন্দ্র কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায় এবং চতুর্থ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায়।
এবারের উৎসবের আঙ্গিক হিসেবে প্রধানত থাকবে হাওরে প্রচলিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, লোকজ যাত্রা-পালা, জারিগান, লোকমেলা, কৃষি ও কুটিরশিল্প প্রদর্শনী, উঠোন বৈঠক, আলোচনা, সেমিনারসহ নানা ধরনের আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট শিল্পীবৃন্দ ও সংগঠনগুলো।
হাওরের অপরূপ রূপ, রঙ, আর স্বকীয়তা রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতন করতে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার প্রতি বছরের হাওর উৎসব সফল হোক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওর উৎসব

আপডেট টাইম : ১০:১৮:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫

‘কে যাস রে ভাটির গাং বাইয়া,আমার ভাইজানরে কইয়ো নাইওর নিত আইয়া’
গ্রামের ঘাটের হিজল গাছের গুঁড়িতে থুতনি ছুঁইয়ে কোনো গেরস্থ নয়াবউ মনে মনে গেয়ে চলেন। হওরের এই গান আর নতুন বৌ এর জীবন মিলেমিশে একাকার। তাহেরপুরে আছে বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের বুকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সারি সারি নৌকা। হঠাৎ ঠাওরে আসবে লম্বা লম্বা নৌকা। বর্ষা মৌসুমে কিছু দিন হাওরে জাল দিয়ে মাছ মারা নিষিদ্ধ। তাহেরপুর থেকে পসরা নিয়ে বাড়ি ফিরছে কোনো নৌকা। কোনো নৌকা আবার তাহেরপুর পানে ধেয়ে আসছে। নৌকাগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য কিন্তু চোখে পড়ার মতো। ঢাকার রিকশা সাজ-সজ্জাকরণের মতো করে সাদা রঙের ওপর লাল, নীল রঙের নকশা আঁকা। যার সঙ্গে সুশান্ত পালের শখের হাঁড়ির নকশার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। টাঙ্গুয়া হাওরে চলছে নৌকাবাইচ। সেই মৌলভীবাজার থেকে বাইচের নৌকা এসেছে বাইচ খেলতে। বাইচ নৌকার দুই পাশে সারি সারি বাইচাল পেছনে হাল ধরে একজন আর নৌকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মন্দিরা বাজিয়ে তাল দিচ্ছেন একজন, সেই তালে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে বাইচালরা_ হেই য়ো হে-হেই য়ো হে…। থেকে থেকে ছারা ছারা বাড়ি। মাইকে চটুল গান বাজিয়ে বউ নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে কোনো বরযাত্রী। বিচিত্র জীবনাচার হাওরের। কত জ্ঞানী-গুণী জন্ম নিয়েছেন এই সুনামগঞ্জে। এই জনপদে জন্ম নিয়েছেন রাধারমণ, দূরবীন শাহ, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মহসিন রেজা চৌধুরী, মনিরুজ্জামান মনির, নির্মুলেন্দু চৌধুরী, আবদুল হাই, ব্রহ্মানন্দ দাস, লালানিরেন্দু দে, বিপিন পাল, ক্ষিরোদ শর্মা, তরণী কান্ত দে, ছাদির উদ্দিন আহমদ, শাহ আবু তাহের ছাড়াও অনেক কীর্তিমান পুরুষ। শাহ আবদুল করিমের ভবতরীর হাহাকার_
কোন মিস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়।
ঝিলমিল, ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।
হাওর মানে পানি। আর পানির বাহন নৌকা। হাওর আর নৌকা একে অন্যের পরিপূরক। পানিবন্দি এই বিশাল সুনামগঞ্জ অঞ্চলের বর্ষার রূপ একেবারেই ভিন্ন। ছবির মতো ছাড়িয়ে যেতে থাকে গাছের সারি, পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, পালকির মতো কোনো ডিঙা আর হাওরের বুকে ভেসে থাকা নৌকার মতো ছোট ছোট গ্রাম।
নদী-খাল ভূমি থেকে আলাদা করার কোনো উপায় নাই। বর্ষা নদী সমতল সব একাকার করে দিয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি, নদী বা সমুদ্রের মতো নয়, মুক্ত অবারিত এক সৌন্দর্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি, মাছ ধরা, কিচির-মিচির, পানকৌড়ির কাকচক্ষু হাওরের জলে ডিঙির মতো ভেসে থাকা। টলটলে স্বচ্ছ পানিতে মাছের দৌড়ঝাঁপ, সাজানো শ্যাওলা যেন সাগর তলার বাগান। রাশি রাশি পানি মারিয়ে সারি সারি হিজল বন। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সারি সারি নৌকা।
সুনামগঞ্জ শহরে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে হাসন রাজার বাড়ি। ভাবলে কেমন লাগে এই বাড়িতেই হাসন রাজা জন্মেছেন ১৮৫৪ সালে। এখানে বসে রচনা করেছেন অসামান্য সব গান। বাড়ির দাওয়া, বারান্দা ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এই বুঝি দেখা হয়ে গেল লম্বা কুর্তা পরা সাধকজাত কবিয়াল জগৎপাগল রাজার সঙ্গে। জাদুঘরে পরিবর্তিত রাজার বাড়িতে আছে কলকাতার একটি স্টুডিও থেকে সংগ্রহ করা ১৯৬২ সালে তোলা কবির একটি ছবি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা আরও কিছু ছবি। জাদুঘরটিকে জীবন্ত করে রেখেছে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত নানা জিনিসপত্র। ভবপাগল হাসন রাজা হাওর-বাঁওড়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই মানুষটি মা হুরমত জাহান বিবির কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত। হাসনকে এখানে কবর দেওয়ার ব্যাপারটি তার ইচ্ছাতেই হয়েছে বলে শোনা যায়। হাসন রাজা সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে_ হাসন রাজার শেষ বয়সে আসাম থেকে একজন লোক এসেছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। লোকটি এসে হাসন রাজাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসন রাজার বাড়ি কোথায়?’ তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমিই হাসন রাজা।’ হাত তুলে মায়ের কবরটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে হাসন রাজার বাড়ি।’ নিজের দেখানো সেই বাড়িতেই শান্তিতে ঘুমায় কবি। চাইলে দু’দণ্ড দাঁড়াতে পারেন কবির সম্মানে।
সুন্দর সাজানো গোছানো শহর সুনামগঞ্জ। পরিষ্কার পরিপাটি ছিমছাম শহর। প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী লাউড়ের তীরে অবস্থিত সুনামগঞ্জের সীমান্ত নদী যাদুকাটাকে বলা হয় রূপের নদী। সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় এর সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ে যেন। সন্ধ্যাকালে মনে হবে এ যেন কাশ্মীরের ঝিলম নদী। যাদুকাটার উৎপত্তি স্থলে আছে টিলার মতো ঘন সবুজের পাহাড়, নাম বারেকের টিলা। স্থানীয়রা একে ‘আইফেল টাওয়ার’ বলে ডাকে।
জল টলমল এই নদীর তলদেশ চিক চিক করে বালুর দানা আর নুড়িপাথর। বছরের নির্দিষ্ট দিনে এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো মেলা ‘বারুণি’। এই সময় সনাতন ধর্মের লোকজন তীর্থরূপী যাদুকাটায় স্নান করার আশায় এসে জড়ো হন নদীতীরের অদ্বৈত মহাপ্রভু চৈতন্যের নবগ্রামে। তা ছাড়াও বছরের বারো মাস এখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা লক্ষণীয়। খাসিয়া পাহাড় থেকে যাদুকাটা নদীর উৎপত্তি। আরেকটি ছোট সীমান্ত নদী ‘রক্তি’ হয়ে এসে মিশেছে সুরমা নদীতে। বারো মাসই নদীটি থেকে বারকি শ্রমিকরা বালু ও পাথর আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
নদীটির আদি নাম রেণুকা।
প্রচলিত আছে, নদী তীরবর্তী কোনো গ্রামের এক বধূ মাছ মনে করে একদা নিজের পুত্রকে কেটে ফেলেছিলেন। যার নাম ছিল যাদু। তখন থেকেই এর নাম হয় যাদুকাটা। বহু জনশ্রুতি ও মিথের পর নদীটির বর্তমান নাম যাদুকাটা। হিন্দু ধর্মমতে, শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর মায়ের ইচ্ছানুসারে এই নদীতে বছরের নির্দিষ্ট দিনে পৃথিবীর সপ্তবারির জল একত্রিত হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মীদের বিশ্বাস, এখানে দোল পূর্ণিমার রাতে সপ্তবারির জল একত্রিত হয়। আর এ কারণেই সারাদেশের পুণ্যার্থীরা এখানে এসে বছরের নির্দিষ্ট দিনে মিলিত হয় স্নানের আশায়।
হাওরের অনুপম প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণ এবং তার সুপরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যটনসহ আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি করে হাওর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মূলত প্রতি বছর পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা এ আয়োজন করে। এ বছর তিন দিনব্যাপী পঞ্চম জাতীয় হাওর উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আয়োজকরা জানান, এবারের আয়োজন হবে আরও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। ১০, ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই উৎসবে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানগুলো অংশ নেবেন মাননীয় মন্ত্রী ও সাংসদবর্গ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের জাতীয় পর্যায়ের জননন্দিত ব্যক্তিরা।
একেক বছর হাওর অধ্যুষিত একেক জেলায় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ বছর উৎসবের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। প্রথম হাওর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওর তীরে। দ্বিতীয়টি হয়েছিল সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জে শৈলচাপরা হাওরের তীরে, তৃতীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় হাওর জনপদের কেন্দ্র কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায় এবং চতুর্থ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায়।
এবারের উৎসবের আঙ্গিক হিসেবে প্রধানত থাকবে হাওরে প্রচলিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, লোকজ যাত্রা-পালা, জারিগান, লোকমেলা, কৃষি ও কুটিরশিল্প প্রদর্শনী, উঠোন বৈঠক, আলোচনা, সেমিনারসহ নানা ধরনের আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট শিল্পীবৃন্দ ও সংগঠনগুলো।
হাওরের অপরূপ রূপ, রঙ, আর স্বকীয়তা রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতন করতে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার প্রতি বছরের হাওর উৎসব সফল হোক।