হাওর বার্তা ডেস্কঃ সেদিন একজন আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি কী একজন জোকার?’ বুঝতে অসুবিধা হলো না, ঠিক কোনো প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন কথাটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেয়া রাষ্ট্রপতির সেই আলোচিত ভাষণটি শুনেছেন অনেকেই। শুনেছেন এবং দেখেছেন। সেদিন যারা টেলিভিশন দেখতে পারেননি, তারাও আসলে মিস করেননি। দেখে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। ইউটিউবে রয়েছে, অনেকে আবার সেটিকে ফেসবুকেও শেয়ার করেছেন।
আমি বললাম, ‘না, জোকার কেন হবেন? হাস্যরসের ছলে উনি তো সিরিয়াস টাইপ কথাই বলেছেন। সহজভাবে বলেছেন কঠিন কথাগুলো। কেবলমাত্র অসামান্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই পারেন এভাবে কথা বলতে।’
‘না, আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। সিরিয়াস কথা সিরিয়াস ভঙ্গিতেই বলা উচিত। হাস্য-কৌতুকের মাধ্যমে বললে কথার গুরুত্ব কমে যায়। তাছাড়া উনি তো রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন, ওনার কাছ থেকে সেই রকম ভাবগাম্ভীর্যই আমরা আশা করি। বেশ গম্ভীর মুখেই ভদ্রলোক বললেন কথাগুলো।
বুঝলাম, রাষ্ট্রপতি কি বলেছেন-সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কিভাবে বলেছেন- সেটাই মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে এদের কাছে। এরা সেই গোত্রের লোক, যারা লক্ষ্য রেখে উপলক্ষ নিয়ে টানাটানি করতে পছন্দ করে। কিন্তু এদের সংখ্যা কত? রাষ্ট্রপতির ওই ভাষণের পর এ নিয়ে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। অসন্তুষ্ট লোকের বেশি দেখা মেলেনি। তারপরও সংখ্যাতাত্ত্বিক একটা ধারণা পেতে আবার সেই প্রযুক্তির সাহায্যই নিলাম। ইউটিউবে একাধিকজন আপ করেছেন এই ভাষণটি। একটি একাউন্টে দেখলাম প্রায় চার লাখ দর্শক ভাষণটি দেখেছেন। তার মধ্যে সাড়ে ছয় হাজারের মত দর্শক/শ্রোতা রাষ্ট্রপতির ভাষণটিকে পছন্দ করেছেন, অপছন্দ করেছেন ৩২০ জন। সেখানে ৩৩৩টি কমেন্ট পড়েছে। মন্তব্যগুলোর ৯৫ শতাংশই প্রশংসামূলক। তারা রাষ্ট্রপতির সেন্স অব হিউমারের প্রশংসা করেছেন। অনেকে বলেছেন, তিনি মানুষ হিসাবে ভালো, সহজ-সরল।
উদাহরণ হিসেবে কিছু মন্তব্য এখানে বরং কপি করে দিয়ে দিচ্ছি: তিনি হয়তো অনেক শিক্ষিত পিএইচডি হোল্ডার নন, কিন্তু অনেক ভালো মানুষ। অতিরিক্ত শিক্ষিত লোকজন এবং তাদের ইগোর কারণে দেশের আজকের এই অবস্থা। ভালো মানুষ হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ ওনাকে সারা জীবন মনে রাখবে । ওনাকে মন থেকে সম্মান।
‘আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হলেন আবদুল হামিদ।’ ‘মন খারাপ থাকলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেখলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।’
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো নেতাকে স্যার বলি না। কিন্তু আজ আমি আবদুল হামিদ স্যারকে একটা স্যালুট দিতে চাই। সালাম স্যার।’ ‘একটা দেশের রাষ্ট্রপতি এত ফ্রাংকলি কথা বলতে পারেন, ভাবতে পারা যায় না। এত সহজ সরল কিন্তু নির্মম সত্য কথা, সত্যি ওনার জ্ঞানের গভীরতার তুলনা হয় না।’
‘বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতিকে আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে খুবই ভালো লাগে। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে সমান জনপ্রিয় আর কোনো রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছেন কি না জানি না। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা আপনার জন্য।’
এরকম আরও অনেক মন্তব্য রয়েছে প্রশংসাসূচক। তবে সমালোচনাও যে একেবারে নেই, তা নয়। কিছু আছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই অপ্রাসঙ্গিক। যেমন একজন বলেছেন- বিচারপতি এস কে সিনহার বিষয়ে ওনার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। অপর একজন বলেছেন- যখন তিনি এরকম একটা দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিলেন, সেই একই সময়ে স্বাক্ষর করলেন ডিজিটাল সিকিউরিটির মতো একটা কালো আইনে।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি কে হবেন, কি হবে তার যোগ্যতা, কি থাকবে তার ক্ষমতা তার সবই সংবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি পদটি নির্দলীয়। আগের দলীয় পরিচয় যা কিছুই থাক না কেন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের আগেই তাকে সকল দল থেকে পদত্যাগ করে নিতে হয়। এভাবে নির্দলীয় হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা পূরণ করলেও সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতিকে কখনোই অতটা নির্দলীয় মনে করেন না। আবদুর রহমান বিশ্বাস, বি. চৌধুরী, ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ, জিল্লুর রহমান-সাবেক এই রাষ্ট্রপতিগণের কাউকেই জনগণ সম্পূর্ণ নির্দলীয় ভাবাপন্ন মনে করেনি। হয়তো সে কারণেই বর্তমান রাষ্ট্রপতিকেও অনেকে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি মনে করেন। আর এটা মনে করা অস্বাভাবিক কিছুও নয়। হতেই পারে। দীর্ঘ অর্ধশতক যে রাজনীতি করেছেন, হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতি হওয়ার লক্ষ্যে সেই দল থেকে পদত্যাগ করলেই যে তার চিন্তাভাবনা রাতারাতি রাজনীতি নিরপেক্ষ হয়ে যাবে, সেরকম মনে করা নিতান্তই বাতুলতা।
এহেন ‘অরাজনৈতিক’ রাষ্ট্রপতি যখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, রাজনীতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন বিষয়টা সর্বস্তরে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পায়। এ কাজটিই তিনি করেছেন এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে। তিনি রাজনীতিকে তুলনা করেছেন ‘গরিবের বউ’ হিসাবে।
গরিবের বউকে সবাই যেভাবে ভাবী বা ‘ভাউজ’ হিসাবে বিবেচনা করে, এই দেশে রাজনীতিকেও অনেকে যেন সেভাবেই বিচার করছে। আমলা, সরকারি চাকরিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী কিংবা সেনাকর্মকর্তারা যেভাবে অবসরে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই রাজনীতিবিদ বনে যান, সেই প্রবণতার সমালোচনা করেন তিনি। তার মতে, যারা রাজনীতি করবেন, তাদেরকে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। আর এ লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। এবং অতি অবশ্য কথাগুলো বলেন নিজের স্বভাবসুলভ রস মিশিয়ে।
সিরিয়াস কথা চোখ মুখ শক্ত করেই বলতে হবে- এমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই। মুখম-লের পেশির ওপর বাড়তি কোনো চাপ না দিয়েও যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা যায় সেটা আমাদের রাষ্ট্রপতি আগেও অনেকবার দেখিয়েছেন। দীর্ঘদিন উনি জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন, ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। কেবল থাকাই নয়, ওনাকে সবচেয়ে সফল স্পিকার হিসাবেও অভিহিত করা হয়। সরকারি কিংবা বিরোধী দল উভয়ের কাছেই তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। অথচ স্পিকারের কাজটিই কিন্তু অনেক সময় জটিল, এক পক্ষকে খুশি করলে অপর পক্ষ বেজার হয়। এমন জটিল পরিস্থিতিও তিনি সামাল দিতে পেরেছেন ওই দুর্দান্ত রসবোধের কারণেই। রসিকতা অনেক সময় সিরিয়াস কথা বলার একটা মোক্ষম মাধ্যম হতে যে পারে, সেটা আগের মতো এবারও দেখালেন তিনি।
এই রসিকতা যে কেবলই রসিকতা ছিল না, সেটা কিন্তু ওই ভিডিওটি দেখলেই বোঝা যায়। রাষ্ট্রপতির রসিকতা কি সকলকেই সমান আনন্দ দিয়েছে? তিনি যখন চাকরি শেষে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার কথা বলতে গিয়ে ভিসির কথা বললেন, তখন ছবিতে চকিতে একবার সেখানে উপবিষ্ট ভিসির মুখও দেখা গেল, তার মুখে একটু হাসি লেগেও ছিল, তবে সে হাসি যে আনন্দের নয়, অতি কষ্টের- বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
পুলিশের সাবেক প্রধানদের কথা বলেছেন। তার এলাকা কিশোরগঞ্জেও একজন সাবেক পুলিশ প্রধান রয়েছেন। শোনা যায়, নির্বাচনের জন্য তিনি নাকি বেশ প্রচার- প্রচারণা চালাচ্ছেন। হয়তো আগামীতে আওয়ামী লীগের নমিনেশনও পেয়ে যাবেন। তিনি কি খুশি হয়েছেন রাষ্ট্রপতির কথা শুনে? এমনকি যে আওয়ামী লীগের ভোটে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন, তারাও কি খুশি হতে পারবেন ওনার এই বক্তব্যে?
রাষ্ট্রপতি কিন্তু সকল দলের প্রতিই আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু তার এ আহ্বানে শেষ পর্যন্ত কোনো দলই যদি সাড়া না দেয় (দেবে বলে আমি অন্তত আশা করি না), তখন হয়তো এই রসিকতাই একটা সুযোগ করে দেবে ওনাকে বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচতে।
মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক