সর্বদা আল্লাহর পর্যবেক্ষণের কথা মনে রাখুন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পূর্বসূরি এক বুজুর্গকে বলা হয়েছিল, দৃষ্টি অবনত রাখতে আমি কীসের সাহায্য নিতে পারি? তিনি বললেন, ‘এ কথা জানার মাধ্যমে যে, তোমার প্রতি মহাপর্যবেক্ষক আল্লাহর দৃষ্টি ওই দৃষ্টির চেয়ে বেশি দ্রুতগামী যেটি দিয়ে তুমি দর্শনীয় ব্যক্তির দিকে তাকাচ্ছ।’ 

আল্লাহর অন্যতম একটি নাম হলো ‘রাকিব’ অর্থাৎ মহাপর্যবেক্ষক, মহান তত্ত্বাবধায়ক। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের মহাপর্যবেক্ষক।’ (সূরা নিসা : ১)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর পর্যবেক্ষণকারী।’ (সূরা আহজাব : ৫২)। তিনি হৃদয়গুলো যা গোপন রাখে সেগুলো সম্পর্কে অবগত ও পর্যবেক্ষণশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছুই করে তিনি সেসবের নিয়ন্ত্রক। তিনি মহাসংরক্ষক, কোনো কিছুই তাঁর অগোচর নয়। সৃষ্টজীবের সবকিছু সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। তাদের সার্বিক অবস্থা তিনি দেখেন। তাদের যাবতীয় কর্মকা- তিনি পরিসংখ্যান করেন। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তিনি মনের সব চিন্তা-ভাবনা ও মনোভাবগুলোও পর্যবেক্ষণকারী, বিভিন্ন কাজ ও মৌলিক কর্ম তো আছেই।’

বান্দার হৃদয়ে এ মহান তাৎপর্যের উপস্থিতি তাকে এ কথায় বিশ্বাসী করে তোলে যে, আল্লাহর কাছে সব সময় তার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে জ্ঞান ও অবগতি আছে। তখন তার মধ্যে এ বিষয়ের সুদৃঢ় জ্ঞান জন্মে যে, আল্লাহ তার পর্যবেক্ষক, তার তত্ত্বাবধায়ক। তার কথার মহান শ্রোতা। তার কাজের মহান দর্শক। প্রতিটি মহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে এবং প্রতিটি চোখের পলকে তিনি তার কর্মের পর্যবেক্ষক।

আল্লাহর ‘রাকিব, হাফিজ, আলিম, মুহিত, খাবির, লাতিফ, মুহাইমিন’ এসব নামের তাৎপর্য জেনে তাঁর ইবাদত করাকে বান্দার পক্ষ থেকে ‘মুরাকাবা’ বলা হয়। কারণ তিনি যাবতীয় বিষয়ের রহস্য ও গোপনীয়তা জানেন, অন্তরের সব অভ্যন্তরীণ দিকগুলো জানেন। জগতের সব বস্তু সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ও প্রত্যক্ষদর্শী। বিশ্বের স্পষ্ট ও অস্পষ্ট সব শব্দ ও আওয়াজ তিনি শোনেন। সূক্ষ্ম ও বিরাট, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সব অস্তিত্বশীল বস্তু তিনি দেখেন। তিনি নিজের জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ, দর্শন ও অবগতির দ্বারা প্রত্যেকের নিকটবর্তী। এসব সুন্দরতম নামগুলো যে ব্যক্তি বুঝেছে এবং সেগুলোর দাবি অনুসারে আল্লাহর ইবাদত করেছে তখন তার প্রকৃত মুরাকাবা বা আল্লাহর উপস্থিতির ধ্যান অর্জিত হয়েছে, যা তার হৃদয়কে প্রতিটি পদক্ষেপে ও প্রতিটি ভাবনায় মহান আল্লাহর পর্যবেক্ষণের দিকে নিবেদিত করে দেয়।

দুনিয়ার এ জীবনে বান্দার কর্তব্য হচ্ছে তার মন যেন সব সময় মহাপর্যবেক্ষক আল্লাহর স্থায়ী তত্ত্বাবধানে থাকে। সে শুধু তার দিকেই অভিমুখ করবে। সে শুধু তাকেই ভয় করবে। সে সব সময় তাঁর নির্দেশগুলো রক্ষা করবে। তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলো মানবে। সে সেদিকেই মনোনিবেশ করবে যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং তাঁর কাছে নিয়ে যায়। তাই যখনই বান্দা নিজের রবের মুরাকাবা বা ধ্যান করবে তখন তার জন্য নিজের সৃষ্টিকর্তার বিষয়ে লজ্জাশীল হওয়া, স্রষ্টার বড়ত্ব ও শ্রদ্ধা ঘোষণা করা, তাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন ও অস্তিত্বশীল করেছেন তাঁর জন্য ভয়, ভালোবাসা, বিনয় প্রকাশ, নতি স্বীকার করা ও অনুগত হওয়া অবধারিত হয়ে পড়বে।

দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা নিশ্চিত হবে যখন বান্দা নিজের রবের মুরাকাবা করবে, তাঁর সন্তোষজনক বিষয়াদি তালাশ করবে, নবীর সুন্নত অনুযায়ী সার্বক্ষণিক তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করবে, ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি ওই ব্যক্তির মতো আন্তরিক ও একনিষ্ঠ হবে যে জানে যে, মানুষ যদি তার বাহ্যিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে পারে তবে আল্লাহ তার ভেতর-বাহির উভয়টাই পর্যবেক্ষণ করেন, যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে জমিনের ও আসমানের কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়।’ (সূরা আলে ইমরান : ৫)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের মনে যা আছে সব জানেন, তাই তোমরা তাঁকে ভয় করো।’ (সূরা বাকারা : ২৩৫)। মুরাকাবা বা আল্লাহর ধ্যান বান্দার ওপর নিজের হিসাব নেওয়া ও জবাবদিহি করাকে অবধারিত করে দেয়। এটা করতে হবে আল্লাহর এ কথায় সাড়া দিতে ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, মন যেন ভেবে দেখে সে আগামী দিনের জন্য কী কাজ করেছে।’ (সূরা হাশর : ১৮)।

ইবনুল কায়্যিম বলেন, ‘বান্দা যেন ভেবে দেখে সে শেষ দিবসের জন্য কী বরাদ্দ করেছে। সেগুলো কি সৎকর্ম যা তাকে মুক্তি দেয় নাকি সেগুলো অসৎকর্ম যা তাকে ধ্বংস করে?’ শেষে তিনি বলেন, ‘হৃদয়ের সংশোধন হবে মনের জবাবদিহি করার মাধ্যমে আর তা নষ্ট হবে হিসাব নিতে অবহেলা করলে ও তাতে শিথিলতা করলে।’
আল্লাহর মুরাকাবা বা ধ্যান প্রকৃতপক্ষে বান্দাকে ইবাদতের ক্ষেত্রে সাধনা করতে উদ্বুদ্ধ করে, আসমান-জমিনের রবের নির্দেশের বিরোধী সব কিছু থেকে মুক্ত রাখতে প্রেরণা দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করত এবং আশা ও ভয় নিয়ে আমাকে ডাকত। তারা আমার প্রতি বিনয়ী হয়েছিল।’ (সূরা আম্বিয়া : ৯০)।

মোমিনের সব সময় নিজের রবের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। আনুগত্যের ক্ষেত্রে সে একনিষ্ঠতার সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে আদেশ পালন করবে। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে তা মানবে। রবের দিকে মনোনিবেশ করে সব সময় বারবার এ বিষয়ে অবিচল থাকবে। আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর মুরাকাবা করে ও তাঁকে ভালোবেসেই সবচেয়ে বেশি তাঁর বিধানের সীমারেখা ও নিষেধাজ্ঞা মান্য করা যায় এবং প্রিয় বান্দারা যে স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছেন সে স্তর পর্যন্ত পৌঁছা যায়। আল্লাহ আমাদের এবং আপনাদের তাঁকে ভয় করার ও তাঁর কাছে আশা করার সুযোগ দান করুন।

তিনি বলেন, ‘যে তাঁর রবের সামনে দ-ায়মান হওয়াকে ভয় করে তার জন্য রয়েছে দুটি বাগিচা।’ (সূরা রাহমান : ৪৬)। ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার শাহরগের চেয়েও বেশি নিকটবর্তী।’ পরিশেষে তিনি বলেন, ‘মূর্খদের হৃদয় দূরত্ব অনুভব করে, তাই তাদের থেকে গোনাহ সংঘটিত হয়। তাদের পক্ষে যদি মহান পর্যবেক্ষক আল্লাহর মুরাকাবা বাস্তবায়িত হতো তাহলে তারা তাদের হাতগুলোকে ভুলত্রুটি থেকে বিরত রাখত।’ পূর্বসূরি এক বুজুর্গকে বলা হয়েছিল, দৃষ্টি অবনত রাখতে আমি কীসের সাহায্য নিতে পারি? তিনি বললেন, ‘এ কথা জানার মাধ্যমে যে, তোমার প্রতি মহাপর্যবেক্ষক আল্লাহর দৃষ্টি ওই দৃষ্টির চেয়ে বেশি দ্রুতগামী যেটি দিয়ে তুমি দর্শনীয় ব্যক্তির দিকে তাকাচ্ছ।’

নবী করিম (সা.) আমাদের ঠিক এরকম বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ নিজের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ নেতা, আল্লাহর ইবদতে লালিত যুবক, মসজিদের সঙ্গে যে ব্যক্তির মন জড়িত, আল্লাহর জন্য যে দুই ব্যক্তি পরস্পরকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্যই মিলিত হয় আর আল্লাহর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়। ওই লোক যাকে কোনো সুন্দরী প্রভাবশালী নারী কুপ্রস্তাব দিলে সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি। ওই লোক যে সদকা করে তা গোপন রাখে, এমনকি তার বাম হাত টের পায় না তার ডান হাত কী করেছে। ওই লোক যে নির্জনে আল্লাহর জিকির করে, ফলে তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।’
আল্লাহর মুরাকাবা ব্যক্তিকে গোনাহ ও হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র রাখে। মনকে যাবতীয় কলুষিত বিষয় ও অপবিত্র বস্তু থেকে পবিত্র রাখে। এর মাধ্যমে সৎ ও সুন্দর সমাজ গঠিত হয়।

আল্লাহর মুরাকাবা বা ধ্যান অপরাধমুক্ত ও অন্যায়-অশ্লীলতামুক্ত সমাজ গঠন করে। সে সমাজের সন্তানরা ভালো ও উত্তম গুণাবলির অধিকারী হয়। তারা তাকওয়া ও সৎকর্মে পরস্পর সহযোগিতা করে সন্তোষজনক জীবনযাপন করে। তারা আল্লাহর রজ্জু মজবুত করে আঁকড়ে ধরে রাখে। আল্লাহর কলেমাকে কেন্দ্র করে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে। সব ধরনের বিরোধ, দলবাজি ও বিভক্তিকে তারা পাশ কাটিয়ে চলে। একপেশে চিন্তা ও বাড়াবাড়ি ধরনের মতাদর্শ থেকে তারা দূরে থাকে। তারা তাদের দ্বীনের মূলনীতির আলোকে এবং তার উদারতা, ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান, মধ্যমপন্থা, সম্প্রীতি, ন্যায় ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে বসবাস করে। তারা তাদের রবের তত্ত্বাবধানে থেকে অবিচলতার সঙ্গে ও সংশোধনের পথে নিরাপদে স্থিতিশীল জীবন পরিচালনা করে। আল্লাহর ইবাদত করে ও শোকর আদায় করে। এক কাতারে ঈমানি ভালোবাসায় ও ইসলামী সম্প্রীতিতে আবদ্ধ হয়। তাদের সোগান হলো, ‘মোমিনরা ভাই ভাই।’ (সূরা হুজরাত : ১০)।

৪ মহরম ১৪৪০ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর